আবুল বাশার: ‘ইয়াস’ (Yaas) যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, সন্দেহ নেই। আমফানের মতো ভয়াবহ, এমনটাই বলা হচ্ছে। যা এতদূর ভয়ংকর রুদ্ররূপী বিভীষিকা, তার নাম কি হতে পারে ‘জুঁইফুল’? ভারতীয় হাওয়া অফিস (আইএমডি) থেকে বলা হয়েছে, এই ঝড়ের নামকরণ করেছে ‘ওমান’ এবং নামটি নাকি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ জুঁইফুল বা ইয়াসমিন বা জেসমিন।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘আত্মশাসন’ না মানাটা হবে আত্মহত্যা]
‘ওমান’ একটি আরবি-ভাষী দেশ। যদিও এদেশে ইংরেজির ব্যবহার যথেষ্ট, উর্দু-হিন্দিও চলে, তৎসহ চলে নানা ভাষা; কিন্তু ভুললে চলবে না, আরবি এই দেশের দরবারি ভাষা। নেট ঘেঁটে কোথাও পাওয়া গেল না, এদেশে ফারসির চর্চা আছে খুব। এখন প্রশ্ন হল, একটি আরবি-ভাষী দেশ ভয়াবহ ঝড়ের নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে হঠাৎ ফারসির কাছে হাত পাতবে কেন?
ভাষা-বংশের হিসাবে আরবি আর ফারসি তো সম্পূর্ণ আলাদা জাতের বা গোত্রের ভাষা। ফারসিকে আমরা সংস্কৃতের সহোদরা বলতে পারি। ফারসি লাতিনের উৎস থেকে আর আরবি হিব্রু থেকে বয়ে-চলা ভাষা। এখন কথা হচ্ছে, ওমান তার নিজের ভাষা ফেলে ফারসির মাধুকরী করতে যাবে কোন দুঃখে? আর মজার কথাটা এই যে, এই ‘ফারসি’ শব্দটাই ফারসি নয়– উচ্চারণের দিক থেকে এটি আরবি। আরবরা ‘প’ উচ্চারণ পারে না, কারণ তাদের ভাষায় প (পে) বর্ণটাই নেই। ওরা ‘পারসি’-কে তাই ‘ফারসি’ উচ্চারণ করে। তাই বলে তারা পারসি বা পারস্যের কাছ থেকে ঝড়টাও উচ্চারণের ফিকিরে ধার নেবে? কাজেই মজার কথাটা এই যে, ‘ইয়াসমিন’ কথাটাও ‘ইয়াস’-এর মতোই আরবি।
হ্যাঁ, আমি ‘ইয়াস’ (Yaas)-কে ‘আরবি’ শব্দই বলছি, কেননা এই আরবি-ই। শব্দের উৎস বিচারের ব্যাকরণগত পদ্ধতি আছে। আরবির বর্ণসংখ্যা ২৮ এবং ফারসির ৩২- ফারসির অতিরিক্ত ৪টি বর্ণ হল ‘পে’, ‘চে’, ‘ঝে’ আর ‘গাফ্’- এই চার বর্ণ বা অক্ষর-গঠিত শব্দ অবশ্যই ফারসি। এ নিয়ে বিস্তারে আলোচনা আজকের মতো তোলা রইল। পরিসরমতো একদিন আলোচনা করব। আপাতত বলি যে ইরান, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান- এই তিন দেশে ফারসি চলে- এরা ফারসি-ভাষী দেশ।
দ্বন্দ্বটাকে অভিধানের সাহাযে্যই সমাধান করা যায়। আরবি শব্দকোষে কি শব্দটি পাব? উত্তর হচ্ছে, পাব। হাওয়া অফিস যেভাবে ‘Yaas’ লিখেছে, সেভাবেই দেখতে পারি- আরবি ভাষায় ‘ইয়া’ নামের অক্ষরটির দু’টি রূপ- একটি ছোট, একটি বড়। উর্দু ভাষায় এই ‘ইয়া’-কে ছোটি ‘ই’ ও বড়ি ‘ই’ বলা হয়। বড়ি ‘ই’ এ-কারের কাজ করে, ছোটি ‘ই’ দীর্ঘ ই-কারের কাজ দেয়। ‘Yaas’ এক্ষেত্রে ছোট ‘ই’ অর্থাৎ দীর্ঘ ই-কারের উচ্চারণ ঘটাতে ‘ইয়া’-কে বলবৎ করেছে। এ-কারের ‘ইয়া’-কে নয়। এ-কারের ‘ইয়া’ শব্দের শেষে আসে। এই ‘ইয়া’-র সঙ্গে, অর্থাৎ ই (ঈ)-এর সঙ্গে আলিফ অর্থাৎ আ-কার যুক্ত করে ‘ইয়াস’ বা ‘ঈয়াস’ শব্দটি গড়া- এর অর্থ ‘নিরাশা’ বা ভীতিপ্রদ যা, অর্থাৎ ভয়-জাগানো বা ভয়-মেশানো ‘নিরাশা’-ই হল ‘ইয়াস’ (কিংবা ঈয়াস)। আরও বলার, আরবির ‘Yaas’ বানানে যে ‘s’ আছে, সেটা ‘দন্ত্য-স’। এবং সেটি আরবির ‘ছোট সি’। ফলে, ‘Yaas’ শব্দটি ফারসি নয়। আসলে, আরবি থেকেই ফারসিতে এসেছে।
ফারসি রস-সঞ্চারী, সৌন্দর্য-তন্ময় ভাষা হলেও আমাদের আলোচ্য শব্দটি জুঁইফুলের সুগন্ধ ছড়ায় না। কারণ, ভাষাটি আরবি এবং ভয়াবহ নিরাশা-সঞ্চারক ঝড়কেই ইঙ্গিত করছে। ওমান ঠিক নামই নির্বাচন করেছে তার নিজের শব্দকোষ থেকে।