উচ্চশিক্ষার দিকে পাড়ি দেওয়া একজন ছাত্রী ‘আমব্রেলা’ বানান জানবে, আমরা তা প্রত্যাশা করি। কিন্তু যারা শুধু এই ভুলটুকু নিয়ে আমোদ লুঠছে, তারা এই বিষয়ে সচেতন তো যে, দেশটার ‘আমব্রেলা’-য় অজস্র ফুটো, জল ঢুকছে। এই নিয়ে ভারতভাগ্যবিধাতার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার সাহস তাদের আছে তো? আর, এই প্রশ্নগুলো যাঁদের কাছে যেভাবে করার কথা, মিডিয়া তা করছে কি? লিখছেন কুণাল ঘোষ
কেকে-র মৃত্যুতে আবেগের অগ্ন্যুৎপাত আপাতত স্তিমিত। রূপঙ্করের উপর বিশেষণ প্রয়োগের হুজুগও প্রায় নেই। আপাতত ইস্যু ‘আমব্রেলা’। ইংরেজিতে কেন ফেল? আন্দোলনরত সাংবাদিকের প্রশ্ন এবং ছাত্রীর ভয়াবহ উত্তর নিয়ে আমরা ব্যস্ত। সেই সঙ্গে একজন অভিভাবিকার বাইট, যে, তাঁর মেয়ের বন্ধুরা তো বাংলায় ‘মেসেজ’ করে, তা-ও ইংরেজিতে পাস করেছে। অথচ তাঁর নিজের মেয়ে ইংরেজিতে ‘মেসেজ’ করতে পারলেও পরীক্ষায় কিনা ইংরেজিতে ফেল করল? কী করে হয়?
এসব নিয়ে মিডিয়া হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হইহই কাণ্ড! আমরা প্রত্যেকে জ্ঞান দিতে ব্যস্ত। সোশ্যাল মিডিয়া মানে অবাধ গণতন্ত্র। বারো ভূতের কারবার। এবং দশচক্রে ভগবানকে ভূত করার এক অপূর্ব গণতান্ত্রিক আধুনিক মঞ্চ। এই মঞ্চ কখনও ইচ্ছামতো ভাষণবাজির; কখনও এটাই ডিজিটাল ফাঁসির মঞ্চ। তো, এই ‘আমব্রেলা’ বিতর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের যা বিশ্লেষণ দেখলাম, তাতে বুঝলাম- চর্চা দ্বিমুখী। প্রথমত, এই ছাত্রীটির তো লেখাপড়ার এই ছিরি! সামান্য ‘আমব্রেলা’ বানান জানে না। তবু লজ্জা নেই। ফেল করে আবার পাসের দাবিতে আন্দোলনে বসেছে। এরা দায়ী, এদের অভিভাবকরা দায়ী, এদের শিক্ষকরা দায়ী, গোটা ব্যবস্থা দায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি।
[আরও পড়ুন: আত্মনির্ভরতা কোন পথে, শুধু সুদ বাড়িয়ে কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম রিজার্ভ ব্যাংক?]
কিন্তু বিষয়টা এমনও নয় যে, অতীতে কোনও কালে কখনও কোনও খারাপ পড়ুয়া ছিল না। এবং যুগে যুগে বাংলার সব পড়ুয়াই অক্সফোর্ডের পড়ুয়াদের হারিয়ে দেওয়ার মতো ইংরেজি জেনে এসেছে। এমনও নয়, এই মেয়েটিই প্রথম নাম ডুবিয়ে দিল। ‘আমব্রেলা’ বানান নিয়ে তার যা কীর্তি, তা নিশ্চিতভাবে বিপজ্জনক, কিন্তু পৈশাচিক আনন্দের ট্রোলিংয়ের ডিজিটাল ফাঁসির মঞ্চে বোধহয় দেখা গেল না আরও আরও অনেক কিছু।
যাই হোক, দ্বিতীয় প্রশ্ন, সাংবাদিকের স্বাধীনতা কতখানি? এই মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ছাত্রীর মেধাপরীক্ষা নেওয়াটা স্বাধীনতা, না কি এটা স্বাধীনতার অপব্যবহার? একটি আপাত উত্তর আছে। যে বা যারা ফেল করেও পাসের দাবিতে আন্দোলন করছে, তাদের আসল অবস্থাটা সামনে এনে দেওয়া। এবং সেটিকে প্রতীক ধরে আনুষঙ্গিক বহুবিধ মশকরা এবং আক্রমণের আয়োজন করা। পোস্ট ‘ভাইরাল’ করে-করে ‘লাইক’ বাড়ানো।
কিন্তু এর আর-একটি দিক রয়েছে। আমি কোনও অবস্থায় ছাত্রীর সঠিক ইংরেজির ‘আমব্রেলা’ বানান না-জানা সমর্থন করছি না। বানান জানা উচিত। ভিডিওটি যে বা যাঁরা দেখবেন, তাঁদের কাছে এই ছাত্রী এবং সঙ্গীদের আচরণ হাসির খোরাক হবেই। কিন্তু একজন শ্রমজীবী সাংবাদিক হয়েও সাংবাদিকের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমার আরও কিছু ভাবনা আছে।
এক, মেয়েটির অজ্ঞানতা দেখানোয় ভুল নেই। কিন্তু কলকাতা থেকে দূরে যখন কোনও সাধারণ ঘরের মেয়ে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে লেখাপড়া চালায়, চিরকালীন গড়পড়তা সাধারণ ভীতির অঙ্ক এবং ইংরেজির পাঠ্যক্রমে যুদ্ধ করে, তখন তাদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে লড়াইটা মিডিয়ার কভারেজে আসে তো? যতক্ষণ না কেউ খুব ব্যতিক্রমী ভাল ফল করছে, ততক্ষণ মিডিয়া দেখতে পায় তো? নিম্নমেধার কোনও চঞ্চল ছাত্রীর ট্রোলিংয়ে আমাদের সমাজপতি-মন জ্ঞানদাতার ভূমিকায়। কিন্তু তাদের জীবনের লড়াইয়ে আমাদের প্রবল অনাগ্রহ।
দুই, সাংবাদিক প্রশ্ন করেছেন। ঠিক করেছেন। কিন্তু সাংবাদিকরা ইংরেজি দূরের কথা, বাংলার সব বানান জানেন তো? নিদেনপক্ষে কোথায় ‘ই’ আর কোথায় ‘ঈ’ ব্যবহার হয়, জানেন? কাগজের প্রুফ দপ্তর ক্লান্ত লেখকদের বানান ঠিক করতে-করতে। টিভির পর্দাতেও কুৎসিত ভুল। তারপর তড়িঘড়ি ঠিক হয়। অধিকাংশ পোর্টালের বানান-জ্ঞান দেখলে গা গুলোয়। সেখানে ‘সফট টার্গেট’ মেয়েটিকে দিয়ে কী প্রমাণ হয়? ওর যদি ইংরেজিতে ফেল করা-ই উচিত, তাহলে দুর্বল ভাষাজ্ঞানের সাংবাদিকদেরও চাকরি ছাড়া উচিত নয় কি?
তিন, মেয়েটি ‘সফট টার্গেট’। প্রশ্ন করা সহজ। কিন্তু জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে বড় বড় মানুষের বহু ভুল, বহু ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তির মায়াজাল, প্রতিশ্রুতি ও রূপায়ণের তফাত, যার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বার্থ জড়িত, তাঁদের উলটো প্রশ্ন করা যায় তো?
যে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন এড়াতে সাংবাদিক বৈঠকই করেন না, সেই দেশে আমজনতার ভুলকে তুলে ধরা সত্যিই কি কৃতিত্বের? আমরা ‘আমব্রেলা’ বানান জানার প্রশ্ন নিয়ে মেতে থাকি, দেশটার ‘আমব্রেলা’-য় যে অজস্র ফুটো, জল ঢুকছে, তা নিয়ে কৈফিয়ত চাওয়ার সাহস দেখাতে পারি না।
এই প্রশ্নগুলো যাঁদের কাছে যেভাবে করার কথা, মিডিয়া করছে কি? ভিনরাজ্যের স্টেশনে পরিযায়ী শ্রমিক এক মায়ের মৃতদেহ ঘিরে খেলছিল অবোধ শিশু। ছবি, খবরে মিডিয়ার দর্শক তো বাড়ল। চোখের জলের বন্যা বইল। তো, সেই শিশুটি আজ ইংরেজিতে ‘আমব্রেলা’ বানান শিখছে কি না, বা তার জন্য যা যা দরকার, সেসব খোঁজ মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া রাখছে কি? লকডাউনে কর্মচ্যুত পরিবারের যে ছেলেটা স্কুল ছেড়ে শ্রমিক হয়ে গেল, তার ‘আমব্রেলা’ বানান মনে থাকবে কী করে, মিডিয়া কোনও টিপস দেবে?
আবার বলছি, যুগের হাওয়ায় চারপাশ এলোমেলো। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা জটিল। করোনাভাইরাস এসে পুরো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছে। সেখানে প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করা পড়ুয়াদের কয়েকজনের, বা সিস্টেমের কোনও একটি অংশ নিয়ে ‘খিল্লি’ করে একটি অন্ধকারকে নিশ্চয়ই তুলে ধরা যায়, কিন্তু বাকি আলোকে অস্বীকার করা, বা অন্ধকারটুকুর কারণকে বিশ্লেষণ না করাটা বোধহয় নিরপেক্ষতা হতে পারে না। ‘আমব্রেলা’ বানানের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটির আচরণ আমাদের মধ্যে আকস্মিক মজার উদ্রেক করে ঠিক। একটি সমস্যাকে চিহ্নিত করে, সেটাও ঠিক। কিন্তু আয়নার দিকে না তাকিয়ে শুধু ডিজিটাল বিপ্লবে কি প্রকৃত দায়িত্ব পালন করছি আমরা? সীমিত সংখ্যক সব সুযোগ পাওয়া সচ্ছল পরিবার বা ব্যতিক্রমী মেধাবী পড়ুয়াদের বাদ দিলে আমরা, নিজেরা সবটা জানি তো? আচমকা ক্যামেরার সামনে কেউ প্রশ্ন করে বসলে সব ঠিকঠাক বলতে পারব তো?
আমি মনে করি, মেয়েটির ‘আমব্রেলা’ বানান ইংরেজিতে ঠিক বলা উচিত ছিল। মনে করি, এই না-বলতে পারাটা লজ্জার, তার শিক্ষকদেরও ব্যর্থতা। কিন্তু এই মেয়েটির ভিডিও নিয়ে যে বিপুল বহুমুখী চর্চা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটু ভেবে দেখার জন্য এই আলোচনাটি পেশ করলাম।
শেষে ওই চিরন্তন দু’লাইন: “তেলের শিশি ভাঙলো বলে/ খুকুর ’পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো!” এটাকেই একটু এখনকার মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলে ভাবতে সুবিধা হয়, এই আর কী।