৯ ও ১০ ডিসেম্বর ১১০টি দেশের নেতাদের ভারচুয়াল উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হল ‘গণতন্ত্র শিখর সম্মেলন’। সেখানে চিন ও রাশিয়া ডাক পায়নি, এদিকে তাইওয়ান পেয়েছে। আবার, ইরান, ইরাক ডাক পেলেও ডাক পায়নি বাংলাদেশ। প্রধান উদ্যোক্তা জো বাইডেনের মানদণ্ড নিরপেক্ষ তো? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব খেপেছে চিন ও রাশিয়া। গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাক না পেয়ে তুলোধোনা করেছে আমেরিকাকে (America)। গোসা একেবারেই অহেতুক মনে করা ঠিক হবে না। কারণ, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মাপকাঠিতে কারা গণতন্ত্রী কারা নয়, সেই বিচার প্রশ্নাতীত হতে পারেনি। এত ধুমধাম করে শতাধিক দেশকে নিয়ে তাঁর গণতন্ত্র শিখর সম্মেলন তাই নতুন দুই ছায়াজোটের জন্ম দিতে পারে। মোটা দাগের সেই ভাগাভাগিতে একধারে আশ্রয় নিতে পারে বাইডেন-স্বীকৃত ‘গণতন্ত্রী’-রা, অন্যদিকে চিন-রাশিয়ার অনুগামী ‘কর্তৃত্ববাদী’-দের’ সঙ্গে দুর্বল ও অনিশ্চিত গণতান্ত্রিক দেশগুলো। তৃতীয় পক্ষও অবশ্য একটা থাকবে, অনেকটা সেই নির্জোট আন্দোলনকারী কিংবা পাকিস্তানের মতো, যারা আমেরিকা বা চিন কাউকেই চটাতে চাইবে না। গণতন্ত্রের বাধাহীন বিকাশ ও চর্চা এর ফলে কতটা সফল হবে বলা কঠিন।
[আরও পড়ুন: পুরনো বন্ধুত্বের স্পর্শ, অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার পাশেই ভারত]
মুক্ত বিশ্বের স্বঘোষিত নেতা হিসাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন-ই এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা। ৯ ও ১০ ডিসেম্বর ১১০টি দেশের নেতাদের ভারচুয়াল উপস্থিতিতে তা অনুষ্ঠিত হল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চ্যালেঞ্জার হওয়ার সময় থেকেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, দুর্নীতিরোধ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাইডেন তাঁর মতাদর্শের ব্যাখ্যা শুনিয়ে আসছেন। ক্ষমতাসীন হয়ে এমন ধরনের কিছু করা তাই মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু করেছেন যা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা-বহির্ভূত তো বটেই, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। চিন-রাশিয়ার উষ্মা ও স্বাভাবিক রাজনীতি পাশে সরিয়ে তাই বলা যায়, বাইডেনের মানদণ্ড নিরপেক্ষ তো নয়ই, গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রেও সহায়ক নয়।
আমন্ত্রিত দেশের তালিকা বিষয়টি স্পষ্ট করে দিচ্ছে। ওয়াশিংটন থেকে ‘ফ্রিডম হাউস’ প্রতি বছর গণতান্ত্রিক দেশের তালিকা প্রস্তুত করে। সেই তালিকায় তিন ধরনের দেশ স্থান পায়। সর্বার্থে গণতন্ত্রীরা ‘মুক্ত’ দেশের তালিকায় থাকে। কেউ ‘আংশিক মুক্ত’ তালিকায়। কারও মূল্যায়ন হয় ‘মুক্ত নয়’ হিসাবে। চিন, রাশিয়া, সৌদি আরব এবার ডাক পায়নি। কেননা, তারা ‘মুক্ত নয়’। অথচ ডাক পেয়েছে তাইওয়ান। ক্ষুব্ধ চিন এই রাজসূয় যজ্ঞকে তাই ‘নিছক তামাশা’ বলেছে। রাশিয়া বলেছে, ‘এটা হল ওয়াশিংটনের ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা।’
পশ্চিম এশিয়া থেকে আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিল শুধু ইজরায়েল ও ইরাক। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ইজরায়েল ওই তল্লাটের ‘একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ’। তাদের সর্বঋতুর সঙ্গী। কিন্তু ইরাক? একদা যার ধ্বংসের মূল হোতা ছিল আমেরিকা, তার অন্তর্ভুক্তি কি প্রায়শ্চিত্ত? প্রশ্ন উঠেছে কেননা জর্ডন, মিশর, মরক্কোকেও বাইডেন ডাকেননি! ‘আরব বসন্ত’-র ধাত্রীভূমি তিউনিশিয়াকেও নয়! এদের একপাশে সরিয়ে রাখা গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে স্বস্তিদায়ক কি?
সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল তিনটি। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটানো, দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সদর্থক পদক্ষেপ। এ বছর যে-যে দেশ সম্মেলনে যা বলছে, আগামী বছর তা পর্যালোচনা হওয়ার কথা। সেই নিরিখে আমেরিকার উদ্যোগে গণতন্ত্র শিখর সম্মেলন হয়তো আগামী দিনে জলবায়ু সম্মেলনের মতো এক বার্ষিক মিলনানুষ্ঠানের রূপ নেবে। ভবিষ্যতের সেই ঠিকানায় কারা আমন্ত্রণ পাবে তা পরের কথা। আপাতত দেশে দেশে চলছে কাটাছেঁড়া। কেন অমুক ডাক পেল, কেন আমরা পেলাম না এই হা-হুতাশ সর্বত্র।
উপমহাদেশের ছবিও এমনই মিশ্র। ‘ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ বছর বছর গণতান্ত্রিক দেশের যে-তালিকা তৈরি করে তাতে ‘হাইব্রিড রিজিম’ বা মিশ্র শাসনের দেশের সংখ্যা ৩৫। এগুলো সেই সব দেশ যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলেও বিভিন্ন ধরনের দমন-পীড়ন প্রবল। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী শাসন। ভারতের বিশ্বস্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশ পড়েছে ওই তালিকায়। অথচ ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সূচকে চার ধাপ (৭৬) এগিয়েছে। কিন্তু সম্মেলনে তারা ডাক পায়নি! ডাক পায়নি ভুটান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কাও। ফ্রিডম হাউসের রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো ভারতও ‘আংশিক মুক্ত’! ১০০-র মধ্যে ভারতের স্কোর ৬৭। গত মার্চে মোদির ভারতকে ‘ফ্রিডম হাউস’ ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ থেকে নামিয়ে ‘আংশিক গণতন্ত্র’ তালিকাভুক্ত করে। সুইডেনের ‘ভি-ডেম ইনস্টিটিউট’ বলে, ভারত হয়ে উঠেছে এক ‘নির্বাচন ভিত্তিক স্বৈরতান্ত্রিক দেশ’। আর, ‘ইকনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ অনুযায়ী আজকের ভারতের গণতন্ত্র ‘ত্রুটিপূর্ণ’। তিনটি সংস্থাই ভারতীয় গণতন্ত্রের অধোগতির জন্য দায়ী করেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ‘হিন্দুত্ববাদী’ বিজেপি সরকারকে, যাদের হাতে ‘লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার, দুর্বল হচ্ছে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অত্যাচারিত হচ্ছেন সাংবাদিক ও অধিকাররক্ষাকর্মী, আক্রান্ত হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা এবং খর্ব হচ্ছে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা।’
ফ্রিডম হাউস বলেছিল, ‘মুক্ত গণতন্ত্রের উচ্চাসন থেকে ভারতের এই পতন গণতন্ত্রের বিকাশে প্রভাব ফেলবে’। তারা বলেছিল, ‘সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতোই স্বৈরাচারী। বাংলাদেশ ও নেপালের চেয়েও ভারতের পরিস্থিতি খারাপ’। এসব উপেক্ষা করে সম্মেলনে মোদি সগর্বে জানান, ভারতে বহুত্ববাদের চেতনার বিকাশ ঘটেছিল আড়াই হাজার বছর আগে লিচ্ছবি ও শাক্যের মতো নির্বাচিত প্রজাতান্ত্রিক শহর-রাজ্যে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত।
গণতন্ত্রের সূচকে বেমানান হওয়ায় সে সময় ভারতের বেজায় রাগ হয়েছিল। প্রতিবাদীও হয়েছিল। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনও কিছু বিষয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে, এ দেশে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত। তাছাড়া, ভূ-রাজনৈতিক কারণেও ভারতের সাহচর্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। চিন-রাশিয়াকে চটালেও ভারতকে রসে-বশে রাখা ছাড়া বাইডেনের গত্যন্তর নেই। মোদিও সেই সুযোগে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক দর্শন’ মেলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য সেই সুযোগ পেলেন না। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীতে বাইডেনের এই উপেক্ষা বাংলাদেশকে আহত করেছে। পাকিস্তান আমন্ত্রিত হল (যদিও তারা যায়নি) অথচ বাংলাদেশ হল না, এটা শুধু তাদের দুঃখিতই করেনি, অপমানিতও বোধ করছে তারা। সে দেশের ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’(র্যাব)-এর প্রাক্তন ও বর্তমান সাতকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। র্যাবের প্রাক্তন ডিজি বেনজির আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের আইজি। মানবাধিকার হরণ, বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও দুর্নীতির গাদা গাদা অভিযোগ এই নিষেধাজ্ঞার কারণ। বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন বর্ষে এই ধিক্কার ও ধাক্কা তারা কল্পনা করেনি।
এখানেই চলে আসছে রাজনীতি ও কূটনীতির মিশেল। অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, ইরাক, পাকিস্তান, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, সার্বিয়া ও জাম্বিয়া আদৌ গণতান্ত্রিক কি? তারা ডাক পেলেও বাংলাদেশের অনাহূত থাকা সম্ভবত এটাই বোঝায়, পাকিস্তানের অঙ্গহানি যুক্তরাষ্ট্র আজও তাদের পরাজয় বলে মনে করে। এই তালিকাতেই স্পষ্ট, আমেরিকা তাদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছে যাদের সঙ্গে তারা সম্পর্ক দৃঢ় করতে আগ্রহী। ভারত তার কৌশলগত অংশীদার, পাকিস্তানকে তার প্রয়োজন আফগানিস্তানের জন্য। নেপাল ও মালদ্বীপের আমন্ত্রণ পাওয়ার পিছনে রয়েছে চিনের ছায়া। সেই নিরিখে বাংলাদেশকেও তাদের ডাকা উচিত ছিল, যেহেতু পদ্মাপাড়ে চিনের নজর নিবদ্ধ বহুদিন। তা ছাড়া অত্যধিক ভারত নির্ভরতা কমাতে হাসিনাও খেলে থাকেন চিনা তাস।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে উপেক্ষার বড় কারণ হতে পারে ‘নির্বাচনী অস্বচ্ছতা’-র অভিযোগ, যা শাসক দল ও সরকার পুরো অস্বীকার করতে পারে না। গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। দরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্রমবিকাশ। বন্ধু প্রতিবেশীর জন্য সেই দায়িত্ব পালনের দায় রয়েছে ভারতেরও। নিজের স্বার্থেই ভারতের তা পালন করা প্রয়োজন। এই সম্মেলন সেদিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশ দু’জনের কাছেই বার্তাবহ। জো বাইডেনেরও বোঝা দরকার, বাংলাদেশকে দেওয়ালে ঠেসে ধরলে আখেরে ক্ষতি গণতন্ত্রের।