সন্তানসম্ভবার পেটে লাথি, টাকা না দিলে সদ্যোজাতকে খাট থেকে ফেলে দেওয়া-ছাড়াও আয়াদের বিরুদ্ধে লাখো অভিযোগ! কিন্তু অন্ধকার এর চেয়েও গাঢ়! রাত বাড়লেই হাসপাতালে বসে আয়াদের মদের আসর, জমে আদিরসাত্মক আড্ডা৷ হাসপাতালের পর্দার আড়ালে কী কী চলে, ফাঁস করলেন দীপেন্দু পাল
Advertisement
দেঙ্গার বাসিন্দা রেশমা বিবির প্রসবের পরে যখন তাঁর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, তখন শুশ্রূষার জন্য হাসপাতালের আয়া এক হাজার টাকা দাবি করেছিলেন৷ টাকা না পেয়ে তিনি ট্রলি থেকে ধাক্কা মেরে রেশমাকে ফেলে দেন বলে অভিযোগ ওঠে৷ তার কিছুক্ষণ পরেই রেশমার মৃত্যু হয়৷ খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে এই খবর দেখে আম জনতার ড্রয়িং রুমে তুফানি বিতর্ক জমে ওঠে৷ চলে প্রশাসন, স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের মুণ্ডপাত৷ তারপর কয়েকটি সন্ধ্যা কেটে যেতেই প্রাইম টাইমে শাহরুখের জন্মদিন, অর্ণব গোস্বামীর পদত্যাগ-সহ অন্যান্য ইস্যুতে ফের মজে যায় বাঙালি৷ এক ফাঁকে, খাটের গদির তলায় সযত্নে রাখা হেল্থ ইন্স্যুরেন্সের কাগজটা দেখে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে৷ ‘থাক বাবা, আমার তো বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসার বন্দোবস্ত আছে৷’ আচ্ছা, শেষ কবে সরকারি হাসপাতালের চৌকাঠ মাড়িয়েছিলেন মনে পড়ে? বলতে পারেন, যাঁদের সরকার, তাঁরাও কেন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন না কখনও? জানতে হলে আপনাকে কোনও এক কর্মদিবসে ঘুরে আসতে হবে খাস কলকাতার যে কোনও একটি সরকারি হাসপাতালের অন্দরমহলে!
সকাল ১০টা, খাস কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার একটি সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের দৃশ্য! তিনতলায় বিভাগ হলে কী হবে, তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি, বারান্দা, এমনকী, জানালার নিচেও স্যালাইনের বোতল টাঙিয়ে রোগিনীকে শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ ‘বড় ডাক্তারবাবু’ আসবেন দুপুরে কোনও এক সময়৷ তার আগে রাউন্ডে জুনিয়র ডাক্তাররাই ভরসা৷ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, পর্যাপ্ত আলো-পাখাহীন ঘরের অবস্থাও তথৈবচ৷ এক হাতেরও কম দূরত্বে পাশাপাশি খাট৷ আরশোলা, ছারপোকাদের উপদ্রব, চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ নিয়ে রোগীদের দৈনিক জীবনযাপন৷ প্রত্যেকে ধরেই নিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে রয়েছি, এর চেয়ে উন্নত পরিষেবা পাওয়ার অধিকার তাঁদের নেই৷ এক খাটেই পাশাপাশি শুয়ে রোগী ও রোগীর পরিবারের সদস্য৷ একজন নয়, একাধিক৷ এ দৃশ্য কোনও ব্যতিক্রম নয়, সপ্তাহের যে কোনও কর্মদিবসে যে কোনও সরকারি হাসপাতালে গেলে আপনিও এই ছবি দেখতে পাবেন৷
সরকারি হাসপাতালে আয়া ও স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ড্যান্ট নিষিদ্ধ হয়েছে এক দশকেরও বেশি৷ স্বাস্থ্য দফতরের বড় কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, আয়াদের হাসপাতালে থাকার কোনও অনুমতি নেই! কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হাসপাতালে থেকে গিয়েছেন তাঁরা৷ কিন্তু সব জেনেশুনেও কেন চোখ বুজে থাকেন হাসপাতালের সুপার? সেখানেই আইনের গেরো! নিয়মের কোপ থেকে বাঁচতে এই আয়ারা কখনই নিজেদের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন না৷ তাঁরা নিজেদের রোগীর বাড়ির লোক হিসেবে পরিচয় দেন৷ সরকারি হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে বাড়ির একজন লোক থাকার কথা, কিন্তু অনেকেরই তেমন লোকবল নেই৷ সত্যি বলতে, অধিকাংশ হাসপাতালে রোগীর একজন আত্মীয়ও থাকার কোনও বন্দোবস্ত নেই৷ তাই রোগীর পরিজনেরাও অক্লেশেই আয়াদের নিজেদের বা়ড়ির লোক হিসেবে পরিচয় দেন৷ খাতায়-কলমে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বিনামূল্যে হলেও এই আয়াদের তুষ্ট করতে লক্ষ্মীর মুখ দেখাতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপে৷ সবচেয়ে বেশি অত্যাচার চলে প্রসূতি বিভাগে৷ প্রসূতিদের পরিজনেদের একাংশের অভিযোগ, সদ্যোজাতকে দেখা, লিফ্টে তোলা, পোশাক পাল্টানো, বে়ডে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ছুটির দিন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয়৷ তবে অন্যান্য বিভাগেও আয়াদের সমান দাপট৷ কারণ, ‘বড় ডাক্তারবাবু’ আসেন দিনে একবার৷ আর জুনিয়র ডাক্তাররা, মেডিক্যাল পড়ুয়ারা মেরেকেটে আরও দু’বার৷ বাদ বাকি সময়টা একজন রোগী সম্পূর্ণ আয়াদের ‘দখলে’৷ তাই রোগীর চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগে ডাক্তারদের দোষারোপ করতেই পারেন, কিন্তু আয়াদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও অভিযোগ করা চলবে না! ঠিক এই কারণে, আয়াদের সমঝে চলেন হাসপাতালের ডাক্তাররাও৷ আয়াদের দাবি পূরণ না করলে রোগী মল-মূত্র মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকলেও কেউ ফিরে দেখবে না! ডাক্তার যেমন আসার আসবেন, এমনকী, প্রয়োজনে মুখে মাস্ক বেঁধে রোগীকে দেখেশুনে চলে যাবেন৷ বাদ বাকি ২৩ ঘন্টা ৫৮ মিনিটই রোগী ঠিক ওই অবস্থাতেই শুয়ে থাকবেন- কেউ এগিয়ে আসবে না৷ তারপর ইসিজি থেকে শুরু করে সিটি স্ক্যান- মাথার উপর আয়ার ছত্রছায়া না থাকলে আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ এমনকী, পেশেন্টকে আইসিসিইউ ঢোকাতেও আয়াকে টাকা দিতে হয়, এরকম অভিযোগও রয়েছে৷
রাতের বেলা পরিস্থিতি তো আরও মারাত্মক! সরকারি হাসপাতালের ভিতরেই বসে এই আয়াদের মদের চক্র, লুডো-তাসের আড্ডা৷ হার্টের পেশেন্ট হোক বা সন্তানসম্ভবা- অদূরে শয্যাই শুয়ে কাতরালেও তখন কেউ এগিয়ে আসার নেই! এক যদি না পাশের শয্যায় কোনও সহৃদয় ব্যক্তি থাকেন৷ হাসপাতালের করিডরে রাত ১০টা বাজলেই শুরু হয়ে যায় এই আয়াদের রাতের আড্ডা-চক্র৷ পুরুষ ও মহিলা আয়াদের মধ্যে চলে আদিরসাত্মক চুটকির আদানপ্রদান৷ বাকিটুকু ছাপার অযোগ্য! সে কথা বিলক্ষণ জানেন হাসপাতালের অন্যান্য কর্তা-কর্মীরাও৷ কয়েকজন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও কোনও এক অদৃশ্য জাদুবলে বারবার পরাজিত হয়েছেন৷ দুষ্টের কাছে পরাজিত হয়েছেন শিষ্টরা৷ একাংশের ডাক্তার, নার্সরাও এই কুকর্মের প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত৷ আয়াদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তুললে ডাক্তার-নার্সদের রীতিমত ধমক দেন এই আয়ারা৷ বলেন, “কী করবেন করে নিন৷ সুপারকে বলবেন তো? যান বলুন গিয়ে৷ আমাদেরও ইউনিয়ন আছে৷ দেখে নেব৷” কিন্তু সব দেখেশুনেও কেন চোখ বুজে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, “যাঁরা থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছেন, তাঁদের ধরা হবে কী করে? শাস্তি দেওয়ার জন্য তো তাঁদের পদটাকে স্বীকৃতি দিতে হবে৷” তাহলে এ রোগের দাওয়াই? আয়াদের দাপট কমাতে সবার আগে রোগীর আত্মীয়দের সচেতন হতে হবে৷ কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না৷ নিজেরা রোগীর দায়িত্ব নিতে চান না বলে তাঁরা আয়াদের দ্বারস্থ হবেন, এমনটা করলে চলবে না! আর প্রশাসনের কী করণীয়? প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে এই চক্র ভেঙে দিতে৷ সাহসী হতে হবে, রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করলে চলবে না৷ তাহলেই অদূর ভবিষ্যতে সরকারি হাসপাতালগুলিতে আয়ার দাপট কমতে পারে৷ ফিরতে পারে হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ৷
The post আয়ার ছত্রছায়ায় সরকারি হাসপাতালের রোজনামচা appeared first on Sangbad Pratidin.