shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: অগ্নিকন্যার অগ্নিপথ

তৃণমূল কংগ্রেসের পঁচিশে পা।
Posted: 09:16 AM Jan 01, 2022Updated: 10:08 AM Jan 01, 2022

পঁচিশে পা দিল তৃণমূল কংগ্রেস। ঘাসফুল শিবিরের জন্মদিনে বিশেষ প্রতিবেদন ‘অগ্নিকন্যার অগ্নিপথ’। লিখেছেন কুণাল ঘোষ

Advertisement

তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল কেন?
বামফ্রন্ট জমানায় কংগ্রেস নানা কারণে সিপিএমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাচ্ছিল না। সিপিএম জমানার অপশাসন ও সন্ত্রাসের অবসান ঘটানো এবং বাংলার উন্নয়ন, এই প্রাথমিকতা থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম।
তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয় কবে?
১৯৯৭ সালের ২১ জুলাই ধর্মতলায় যুব কংগ্রেসের সমাবেশ থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের ডাক। কর্মীরা জনপ্লাবনে বুঝিয়ে দেন তাঁরা যে কোনও সিদ্ধান্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে আছেন। ৯ আগস্ট নেতাজি ইন্ডোরে এআইসিসি প্লেনারির সময়ই মেয়ো রোডের জনসমুদ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেস কমিটি নামে দলের মধ্যেই মঞ্চ ঘোষণা করেন যুবনেত্রী। ২১ ডিসেম্বর কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী জানিয়ে দেন যুবনেত্রীকে প্রদেশ নির্বাচন কমিটির প্রধান করা যাবে না। ২২ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় ক্ষুব্ধ মমতা ঘোষণা করেন তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেই ভোটে লড়তে চান। বিকেল চারটের সময় এআইসিসি দিল্লি থেকে বলে যুবনেত্রীকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। সন্ধে ছটায় পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সেই বহিষ্কার ঘোষণা করে। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করে।

[আরও পড়ুন: অভিষেক-বার্তা]

তৃণমূল কংগ্রেসের মূল সম্পদ কী?
মূল সম্পদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল সম্পদ এক অগ্নিকন্যার অগ্নিপথের যাত্রা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে টালির ঘরে থেকে ভাইবোন সামলে, পিতৃবিয়োগের পর রোজগারের লক্ষ্যে সকাল থেকে পরিশ্রম করেও প্রতিবাদী সত্তার প্রবল বিচ্ছুরণে সব প্রতিকূলতা চুরমার করে, বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েও নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দুতে থাকা। বিরোধী নেত্রী হিসাবে এবং পরে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও। মমতা মানে মানুষের সমর্থন এবং আবেগ। মানুষ ভালবাসেন, বিশ্বাস করেন, আস্থা রাখেন। আমজনতার মসিহা। দিদি আছেন, উনিই দেখছেন। এই অনুভূতিতে বাজিমাত। নেত্রীর মুখটাই তৃণমূলের আসল সম্পদ, যার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার জাদু আছে। ঠিক পাশের বাড়ির ইমেজের অতিসাধারণ জীবনযাত্রার হাওয়াই চপ্পল পরা মেয়ের মধ্যে এত আগুন? এত জেদ? এত সাহস? এত ক্ষুরধার রাজনৈতিক চেতনা? বাংলা মুগ্ধ। দেশ অবাক। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা, পরিচিতির ধার এবং ভার। সাতবারের সাংসদ, দু’বার রেলমন্ত্রী, দু’বার দিল্লিতে অন্য মন্ত্রী, তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতির পালাবদলের তারকাদের মুখ আর মুখোশ চেনার এক্স-রে আই এখন আরও তীক্ষ্ণ। আর এখন, এই তীব্র আবেগের সঙ্গে যুক্ত আজকের প্রজন্মের যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকাঠামোগত সাংগঠনিক সময়োপযোগী পদক্ষেপ। আর রয়েছেন কিছু নেত্রী অন্তপ্রাণ নেতা, সংগঠক এবং অবশ্যই কর্মীরা, নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত ভালবাসা নিয়ে।


তৃণমূল কংগ্রেসের গঠনগত বৈশিষ্ট্য কী?
জননেত্রী। জনসংযোগ। জনস্বার্থ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ধরনটাই বৈশিষ্ট্য। নিজে বামপন্থী ঘরানার আচরণ আর দলে সর্বশ্রেণির সম্মেলন। প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee) ব্যাখ্যা মনে পড়ছে -‘‘মমতার দলটাই ইনহেরেন্ট কোয়ালিশন। ও সবাইকে একমঞ্চে এনে ফেলেছে।’’ সমাজের সব পেশার মানুষ এখানে আন্দোলনে, মঞ্চে, পুরসভায়, পঞ্চায়েতে, বিধানসভায়, সংসদে। কৃষক, শ্রমিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক থেকে খেলোয়াড়, সাংবাদিক, গায়ক, অভিনেতা, আমলা। দলে এসেছেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা। গোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে দল। সঙ্গে ‘ডি টু এইচ’ ফর্মুলা। ডিরেক্ট টু হোম। কর্মসূচি শুধু রাজপথে নয়, নেত্রীর খবর পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ির সকলের কাছে, সব শ্লটে। উন্নয়নের স্কিমগুলির প্রশ্নেও তাই। ইমেজ ও উপকার। মানুষের মন বোঝা এবং মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলাই তৃণমূলনেত্রী ও তাঁর দলের বৈশিষ্ট্য। এই কারণেই জেলায় জেলায় ছুটে গিয়ে হয় প্রশাসনিক বৈঠক। এই কারণেই রাস্তার ধারের কৃষকের দেওয়া চিরকুট সযত্নে রেখে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী কড়া সুরে বলে ওঠেন, ‘‘ময়ূরেশ্বরের বিডিও কোথায়? সার নিয়ে কালোবাজারি হচ্ছে কেন?’’ কিংবা পাহাড়ে চা বাগানে চা পাতা তোলা শেখার খেলাচ্ছলে মহিলা শ্রমিকদের সঙ্গে সংসারের গল্প সেরে ডিএমকে ডেকে বলতে পারেন, ‘‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওষুধ বাড়াতে হবে।’’ এটাই তৃণমূলের নির্বিকল্প বৈশিষ্ট্য। এই কারণেই বিধানসভা ভোটের আগে গাদাখানেক বিশ্বাসঘাতক বড় বড় কথা বলে দল ছাড়লেও তারা ‘ডি টু এইচ’ রাজনীতির কার্যকারিতাটাই ধরতে পারেননি। আর এসবের সঙ্গে আছে ‘পার্সোনাল টাচ’। ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকর্ষণীয় বর্ণময় ব্যক্তিত্ব। আড্ডায় বসে গান তৈরি করছেন, কথা বলতে বলতে হাতে তুলে, আনপ্রেডিক্টেবল পরের পর পদক্ষেপ-ভাললাগাটাকে নিজের দিকে টেনে নিতে জানেন নেত্রী।


তৃণমূলের কৃতিত্ব কী?
প্রথমত, অগ্নিকন্যার একক লড়াইয়ে একটি দল প্রতিষ্ঠিত ও সফল। মনে রাখুন নেতাজি ছিলেন মহামানব, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ে সফল হননি। নতুন দল গড়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সফল হননি। বাংলায় তিনবার ক্ষমতায়, কেন্দ্রে দু’বার রেলমন্ত্রী, সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল, সাফল্যের এই রেকর্ড নতুন দলের প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) পর একেবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আটের দশক থেকে এখনও জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের লাগাম ধরে থাকার ধারাবাহিকতাও বেনজির। দ্বিতীয়ত, ২০০৪-২০০৬-এর ব্যাড প্যাচ কাটিয়ে প্রবলতর কামব্যাক। তৃতীয়ত, বিরোধী ভূমিকায় যতটা সফল, জমিরক্ষা-সহ গণআন্দোলনে যে সাফল্য, সরকারপক্ষ থেকে কাজ করার ভূমিকায় ততটাই সফল। চতুর্থত, দলকে সময়োপযোগী কাঠামো দিতে থাকা। পঞ্চমত, মনের দরজা খুলে সব অংশের মানুষকে জায়গা দেওয়া।
তৃণমূল কংগ্রেসের অবদান কী?
১) দু’দফার রেলমন্ত্রিত্বে বাংলার বিপুল প্রাপ্তি, উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র রেল। ২) বামজমানার অবসান ও বহুপ্রতীক্ষিত পরিবর্তন। ৩) জাতীয় স্তরে দাপটের সঙ্গে বাংলার প্রতিনিধিত্ব। ৪) রাজ্য সরকারে থেকে বিকল্প উন্নয়নের মডেলে আমজনতার প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন। একটি পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ৫) রাজনীতিতে অন্য জগতের তারকাদের সসম্মানে কাজের সুযোগ। ৬) রাজনীতিতে পরের পর নতুন প্রজন্মকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা। ভবিষ্যতের উপযুক্ত ভিত।

[আরও পড়ুন: সর্বভারতীয় স্তরে আরও একধাপ এগোলেন মমতা]

তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা কোথায় এবং কতখানি?
২৪ বছরে চালচিত্র বদলেছে। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা একই, বরং বেড়েছে। একটা সময়ে সিপিএমের জমানার বিরুদ্ধে তৃণমূল ছিল জনস্বার্থে মূল বিকল্প। আজ সিপিএম পরাজিত, দুর্বল। কিন্তু দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলনেত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস বিকল্প শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এমনকী, নতুন কিছু রাজনৈতিক সমীকরণের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখছে তৃণমূল। বাংলাকে আবার দিল্লিজয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলার সামাজিক স্কিমগুলি মডেল হয়ে উঠছে। বাংলা তো বটেই, একাধিক রাজ্য ও জাতীয় স্তরেও তৃণমূল প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। সমর্থকের গর্ব, সমালোচকের মূল লক্ষ্যবস্তু-প্রাসঙ্গিক না হলে হয়?


তৃণমূলের সবটাই কি নির্ভুল, নির্দোষ?
না। দল বড়। অনেক কাজ। সংগঠনে, সরকারে। বেশিটাই ঠিক। ৯৫% ঠিক। ৩% অসম্পূর্ণ বা জটিল। ২% ভুল, অন্যায়। দল দেখছে, চিহ্নিত করছে, সংশোধন করছে। দল সমাজের বাইরে নয়। ভ্রান্তি, অবক্ষয় মেরামতি করেই আরও সতর্কতা, নজরদারি বাড়িয়ে দল আরও বৃহত্তর দায়িত্বপালনে এগিয়ে চলেছে। সংগঠন, কর্মসূচি এবং সরকারি কর্মসূচিকে আরও সময়োপযোগী, অভিযোজিত, জনমুখী করে এগিয়ে চলার বার্তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। ২৪ বছর গেল। ২৫ শুরু। অগ্নিকন্যার অগ্নিপথ চলতেই থাকবে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement