shono
Advertisement

ভারতীয় রাজনীতির ভাষ্য নতুন করে লিখেছে বিজেপি

ছড়ি ঘোরানোর ভূমিকায় ‘নব্য’ ভারতে এ এক ‘নব্য’ বিজেপি।
Posted: 05:56 PM Mar 12, 2022Updated: 06:03 PM Mar 12, 2022

দু’হপ্তা আগে এই কলামেই, আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম, কেন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি জেতার অবস্থানে রয়েছে। সমালোচকরা বলেছিল, উত্তরপ্রদেশে তুমুল লড়াই হতে চলেছে। বলে যে ছিলাম, তার জন্য আমার খারাপই লাগছে। কিন্তু সত্যিটা এই, যে, নির্বাচনের হাওয়া একমাত্র মাঠে নামলেই বোঝা যায়। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

 

ভারতীয় রাজনীতিতে একটা সপ্তাহ যদি অনেকখানি সময় হয়, তাহলে দশটা বছর তো অনন্ত! ২০১২ সালের কথাই ভাবুন না। সেবারে বিজেপি মাত্র ৪৭টা আসন পেয়েছিল। মাত্র ১৫ শতাংশ ভোটের কৃপায়। সমাজবাদী পার্টি পেয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে সেবারে নিযুক্ত ছিলেন আরএসএসের সঞ্জয় যোশী, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চক্ষুশূল, টেঁটিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে যা বোঝায়। ফলে, নরেন্দ্র মোদি প্রচারে এলেনই না। ঠিক ১০ বছর পরের চিত্র দেখুন। বিজেপি ‘চৌকা’ হাঁকিয়েছে। যেমন-তেমনভাবে নয়, রীতিমতো ৪৫ শতাংশেরও বেশি ভোট শেয়ার নিয়ে। আর, প্রধানমন্ত্রী রূপে নরেন্দ্র মোদি দেশের সুপ্রিম লিডার। বিপরীতে, সমাজবাদী পার্টি দেশের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্যের প্রধান বিরোধী আসনে। কিন্তু বাস্তবিক প্রভাব থেকে বহুদূরে তার অস্তিত্ব ঠংঠং করছে। কীভাবে এমন নাটকীয় পরিবর্তন এল?

এককথায় বললে, ছড়ি ঘোরানোর ভূমিকায় ‘নব্য’ ভারতে এ এক ‘নব্য’ বিজেপি। মোদি-শাহর এই জমানায় আদবানি-বাজপেয়ীর যুগের ভদ্রসুলভ ন্যায়সংগতির ধার ধারানো নেই। বিজেপি এখন এমন একরোখা নির্বাচনী মেশিন, যেখানে পুরোদস্তুর বলপ্রয়োগে বিরোধী শক্তিকে দুরমুশ করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি এমনই রাজনৈতিক দণ্ডমুণ্ডময় যেখানে চমৎকারভাবে জানা আছে, কীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর চতুর মিডিয়া ম্যানেজমেন্টকে একত্র করে বিরোধী পক্ষকে আছাড় মারা যায়। শুধু তা-ই নয়, এমনকী, ফ্যাকাসে করতে করতে জন পরিসরের ভাষ্য থেকে সম্পূর্ণত উবিয়ে দেওয়াও ঘটবে। ঘটছে।

[আরও পড়ুন: কেন এত ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ইউক্রেনে পড়তে যায়?]

এই প্রক্রিয়া প্রকরণে ভারতীয় রাজনীতির ভাষ্য নতুন করে লিখেছে বিজেপি। তথাকথিত জাত-ভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতিকে ঠেলে দিয়েছে খাদের ধারে। না, তার মানে এই নয় যে, সামাজিক গড়পড়তা রূপ এবং জাতি-বর্ণের কাঠামোকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। এই সমস্তটাই সেজে উঠেছে এমনভাবে যে বিজেপির পরিচয় আর কোনও নির্দিষ্ট জাতের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ নেই। হিন্দুত্বের তকমা তো গতস্য ব্যাপার। বর্তমানে, সাংস্কৃতিক হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম-বিরোধী মনোভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে এক ধর্মীয়-রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে উঠেছে বিজেপি। এবং, তা এমনই যে, গড়ে উঠেছে ‘হিন্দুত্ব-প্লাস’ এক নির্বাচনী চত্বর। যার মাধ্যমে বিজেপির সামাজিক প্রসার বেড়েছে তরতরিয়ে। সেখানে কেবলই ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে এর রূপ আর সংকীর্ণ করে রাখা যাবে না।

বিজেপির বিস্তৃতির এমন তুরীয় আবেদনের উৎস আসলে লক্ষ্যযুক্ত গরিব-কল্যাণমুখী প্রকল্প, সরকারি কর্মসূচির এক সুবিশাল সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এমন নয় যে, আগে এমন গরিব-কল্যাণমূলক কার্যক্রম ছিল না। ২০১৪-পূর্ববর্তী জমানায় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম বেশ ভালই সফল হয়েছিল। কিন্তু এই কার্যক্রম, তা সে শৌচালয় নির্মাণ হোক বা গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণ, বিনামূলে্য রেশন হোক বা আবাস যোজনা- এমনভাবে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় সেঁধিয়ে নিয়েছে বিজেপি, সেটাই হয়ে উঠেছে রদবদলের চাল। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় কী বিপুল মহিলা-ভোট পড়েছে বিজেপিতে দেখুন। বোঝা যাবে, ‘মহিলা’ এবং ‘যোজনা’, যা কিনা এতকাল ‘মুসলিম-যাদব’ ভোট গণিতের সমীকরণ ছিল, তা হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপী নব্য ফ্যাক্টর।

কিন্তু, প্রধান বার্তাবাহক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি না থাকলে, বিজেপির এই আকর্ষণীয় উত্থান সম্ভব হত না। এমন তো নয় যে, পরিপূর্ণ প্রশাসনিক কার্যকারিতা দেখিয়েছে বলেই চার রাজ্যে প্রত্যাবর্তন ঘটল বিজেপি সরকারের। উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলায় কঠোর বুনিয়াদ আনার জন্য যোগী আদিত্যনাথ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন বটে। কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ‘ইউপি শাইনিং’ প্রোপাগান্ডা দিয়ে কি আর এই বাস্তব ঢাকাচাপা দেওয়া যাবে যে, এই রাজ্যে এখন লাখো লাখো বেকার হয়রান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? গত পাঁচ বছরে হয়তো মণিপুর খানিক শান্তি স্থাপন করা গিয়েছে, কিন্তু রাজ্যের ‘পার ক্যাপিটা ইনকাম’ দেশের অন্যতম নিচে। উত্তরাখণ্ডে এক বছরে বিজেপির তিনজন মুখ্যমন্ত্রীর আসা-যাওয়ায় প্রমাণিত হয়, সেখানে নেতৃত্বের কতটা অভাব। গোয়াতেও তাই। প্রমোদ সাওয়ান্তের সরকার সেখানে কোভিড-ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে মহামারী-জনিত দুর্নীতি- বিবিধ ক্ষেত্রে ব্যর্থ।

এত কিছুর পরেও, বিজেপি যদি তার মাটি শক্ত রাখতে সম্ভব হয়, তবে তা একমাত্র মোদির কারণে। যেভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশে ‘কর্মভূমি’-র মধ্য দিয়ে জনসংযোগ তৈরি করেছেন, তা কেবলই নিছক নেতা-ভোটার সমীকরণ নয়। উদাহরণস্বরূপ- এমন হিন্দুত্বের প্রাণভূমিতে, এক মহিলা ভোটার দুঃখপ্রকাশ করছেন, কীভাবে চিকিৎসার অভাবে কোভিডে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁর স্বামী এবং তাঁর সন্তান আজও বেকার। তদুপরি ভোটটা তিনি ‘মোদিজি’-কেই দেবেন। ব্যাপারটা এমন যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে এমন গভীর এক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন, যেখানে ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগান কেবলই স্লোগান নয়। তা হয়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের অন্তরের প্রগাঢ় বিশ্বাস। রীতিমতো বাজারি করে তোলা ‘প্রধান-সেবক’ বা ‘কর্মযোগী’ ভাবমূর্তি সমালোচকদের ব্যঙ্গের বিষয় হয়ে উঠলেও, আদর্শের যুদ্ধ থেকে ক্রোশ দূরে থাকা জনগণের কাছে প্রধানমন্ত্রী একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, যিনি কিনা দুর্নীতিগ্রস্ত জড় একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে হুংকার তুলেছেন।

বিরোধী দলগুলোও মোদি-পরিচালিত বিজেপিকে ‘প্রকৃত শত্রু’-র দৃষ্টান্ত সরবরাহ করেছে। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব হোন বা জাতীয় স্তরে রাহুল গান্ধী, এঁরা দু’জনেই মেধারহিত সাম্রাজ্যবাদী এক সংস্কৃতির প্রতিভূ, যাঁরা জন্মের খাতিরে ক্ষমতাপ্রাপ্ত, কিছুই তাঁদের অর্জিত নয়। ‘নব্য’ ভারতের কাছে এমন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের নিয়ে প্রবল অসূয়া। এসব এখন সেকেলে। এবং এই নেতারাও তাঁদের অতীত ও বংশ পরিচয় গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। ফলে, সমাজবাদী পার্টিকে রাজনৈতিক গুন্ডারাজ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করা সহজ হয়ে যায় বিজেপির পক্ষে। কিংবা, কংগ্রেসের গা থেকে দুর্নীতির দাগ তোলা যায় না, যা জনগণমননে সেঁটে রয়ে গিয়েছে। একটা পার্টির মধ্যে যখন ‘পরিবার’ ঢুকে পড়ে, তখন নেতৃত্ব শৈলী ও সাংগঠনিক কর্মধারার নিরিখে তাদের গায়ে কাদা ছেটানো সহজ হয়ে যায় বিজেপির পক্ষে।

সেই কারণেই হয়তো অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর ‘আম আদমি পার্টি’-র তুমুল জয় কাকতালীয় বিষয়
নয়। দুর্নীতি-বিরোধী মঞ্চ কিঞ্চিৎ তৈরি করার হেতু, কেজরিওয়ালও পাঞ্জাবের প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। একদিকে ছিল ধসে যাওয়া ও দলবাজিতে ন্যুব্জ কংগ্রেস।

[আরও পড়ুন: আনিস হত্যাকাণ্ড: রক্তমাখা হাতে দরদের নাটকে অরাজকতা কেন?]

আর অন্যদিকে সামন্ততান্ত্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত অকালি দল। মোদির মতোই, কেজরিওয়ালও রাজনীতিতে, পরিবর্তন ও আশাবাদের প্রতীক। শুধু তফাত এই, বিজেপির মতো বিপুল পুঁজি তাঁর নেই। যে কারণে, বিজেপি হয়তো এই উঠতি কেজরিওয়ালকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ভয় পাবে, অন্য যে কোনও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে। গত সাতবছরে এরকমই তুমুল হাওয়াবদল ঘটেছে ভারতীয় রাজনীতিতে। কে জানে, আগামী পর্যায়ে, ২০২৯-এ কী হবে? মোদি বনাম কেজরিওয়াল নয় তো?

পুনশ্চ দু’-হপ্তা আগে এই কলামেই, আমি ব্যাখ্যা দিয়ে এই ধারণার অবতারণা করেছিলাম, কেন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি জেতার অবস্থানে রয়েছে। সে সময় আমি এই কথা বলার জন্য রীতিমতো সমালোচিত হয়েছিলাম। সমালোচকরা বলেছিল, উত্তরপ্রদেশে তুমুল লড়াই হতে চলেছে। বলে যে ছিলাম, তার জন্য আমার খারাপই লাগছে। কিন্তু সত্যিটা এই, যে, নির্বাচনের হাওয়া একমাত্র মাঠে নামলেই বোঝা যায়। সমমনস্ক মানুষদের নিয়ে গমগমে গুহায় ঢুকে বসে থাকলে আঁচ পাওয়া যায় না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement