shono
Advertisement
R g kar hospital

সোদপুরের অন্ধকার কোন্নগরেও! 'পুজো বলে কিছু নেই', ফুঁপিয়ে কাঁদছেন 'বিনা চিকিৎসায়' মৃত বিক্রমের মা

হুগলির কোন্নগরের জোড়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা বিক্রম ভট্টাচার্য সেপ্টেম্বরের শুরুতে পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন। আর জি কর হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
Published By: Subhankar PatraPosted: 02:13 PM Oct 10, 2024Updated: 02:34 PM Oct 10, 2024

সুমন করাতি, হুগলি: মা দুর্গার বোধন হয়েছে। পাড়া আলোয় ঝলমল করছে। ঢাকের বাদ্যি ভেসে আসছে টালির চালের ঘরে। মৃত ছেলের ছবি আঁকড়ে বসে আছেন মা। বিড়বিড় করে চলেছেন, "সেদিন একটু চিকিৎসা পেলে ছেলে এই পুজোতে সঙ্গেই থাকত।"

Advertisement

আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে আজও ঢেউ আছড়ে পড়ছে কলকাতার রাজপথে। তাঁর ছেলের 'জাস্টিসে'র নেই কোনও আওয়াজ। আক্ষেপ 'অভাগা' মায়ের। সঙ্গী হয়েছে অনটনও। ছেলের রোজগারের উপর অনেকাংশে নির্ভর ছিলেন তাঁরা। কাজ গিয়েছে কবিতার স্বামীরও। যেন কালো অন্ধকার মেঘ ভিড় করে আসছে শুধু তাঁদের বাড়ির উপর!

ঘরের পুরোটাই জুড়ে একটা খাট। পাশে কোনও মতে রাখা আলনা। ঝোলানো কিছু মলিন কাপড়। আলনার উপর সবুজ রঙের দেওয়ালে ঝুলছে বিক্রমের ছবি।

হুগলির কোন্নগরের জোড়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা বিক্রম ভট্টাচার্য সেপ্টেম্বরে পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে। পরিস্থিতি তখনই সঙ্কটজনক। ওয়ালশ তাঁকে 'রেফার' করে আরজি করে।

তখন চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ এবং খুনের প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলছে। আরজি কর হাসপাতালেই মৃত্যু হয় ২৮ বছরের তরুণের। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। বিক্রমের মা কবিতা দাস হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়েই বিলাপ করেছিলেন, "ডাক্তারবাবুরা যদি একটু দেখতেন, ছেলেটাকে একটু রক্ত দেওয়া যেত, ও বেঁচে থাকত।"

সময় থেমে থাকেনি। নিয়ম মেনে পুজো এসেছে। কিন্তু কবিতাদেবীর কাছে তাঁর ছেলে নেই। তাঁর চোখের জলের ফোটা পড়ছে ছেলের ছবির মুখের উপর। কবিতা বলছেন, "আমার জীবনে পুজো বলে আর কিছু নেই। আর কিছু থাকবেও না। কোনও দিন না।"

হুগলির উদ্বাস্তু কলোনি কোন্নগরের জোড়াপুকুর। সেই কলোনিতেই বিক্রমদের টালির চালের বাসা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশোনা এগোতে পারেননি বিক্রম। শিখেছিলেন গাড়ি চালানো। সেই ছিল তাঁর পেশা।

কবিতার প্রথম পক্ষের সন্তান বিক্রম। বিবাহবিচ্ছেদের পর কবিতা সংসার করছেন সুজিত দাসের সঙ্গে। বিক্রমের মৃত্যুর পরে হাসপাতাল, থানা-পুলিশ, প্রশাসনে ছোটাছুটি করতে হয়েছে সুজিতকেই। সৎপুত্র বিক্রমের পারলৌকিক কাজও করেছেন সুজিতই। অন্যের টোটো চালাতেন সুজিত। পরিবারে বিপর্যয়ের পর সেই কাজ কামাই হয়েছে। তাই তাঁর কাজও চলে গিয়েছে। সুজিত বলছিলেন, "ছেলেটাও চলে গেল। আমার কাজটাও টিকিয়ে রাখতে পারলাম না। পুজোর আগে পুরো ঘরে বসা।"

হোসিয়ারি শিল্পে ছোটখাটো কাজ করেন কবিতা। তাঁদের সংসারে অভাব প্রকট। টালির চালে প্লাস্টিকের তাপ্পি, ঘরের ভিতরের চালের ঝুল-ধরা বাঁশ তার সাক্ষী। পুজোয় সন্তানশোক তো আছেই। পাশাপাশি দাস পরিবারে মিশে গিয়েছে দৈনন্দিন অনটনও। প্রতি বার পুজোর সপ্তাহখানেক আগে 'বোনাস' পেতেন বিক্রম। মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েই সকলের জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। এ বারের পুজোয় তিনি ফ্রেমে বন্দি হয়ে দেওয়ালে ঝুলছেন।

বিক্রমের পুজোর অতীতচারণ করতে গিয়ে ডুকরে উঠছিলেন কবিতা। বলছিলেন, "পুজোয় বেশির ভাগ সময়েই গাড়ি চালিয়ে লোকজনকে কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত ও। ফিরে এসে আমায় ছবি দেখাত।"

বেশির ভাগ সময় দিদার কাছেই থাকতেন বিক্রম। সত্তরোর্ধ্ব সেই বৃদ্ধাও শোকে পাথর। এখনও তিনি অসংলগ্ন কথা বলেন। যিনি রোজ দুবেলা তাঁর 'দাদুভাই'য়ের ছবি ঝেড়েমুছে রাখেন। পুরনো পোশাকের আলনার পাশে সে ছবি যত্নের ঝকঝক করছে। কিন্তু তাতে কোনও প্রাণ নেই।

কবিতা বলছিলেন, ঢাকের আওয়াজ তাঁর কানে বিষমাখানো তিরের ফলার মতো। উৎসবের আলো তাঁর চোখ ঝলসে দিচ্ছে। বিক্রমের মা বলছেন, "চোখের সামনে ছেলেটাকে মরতে দেখেছি। ট্রলিতে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলেছিল, একটু রক্ত দিতে বলো না মা! একটু রক্ত দিতে বলো! ওরা শোনেনি।" 

সোদপুরে অভয়ার বাড়িতেও অন্ধকার। দুজনের মৃত্যুর কারণও আলাদা। কিন্তু সন্তান বিয়োগের দুঃখ কোথাও যেন মিলিয়ে দিয়েছে দুই 'অভাগা' মাকে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • মা দুর্গার বোধন হয়েছে। পাড়া আলোয় ঝলমল করছে। ঢাকের বাদ্যি ভেসে আসছে টালির চালের ঘরে। মৃত ছেলের ছবি আঁকড়ে বসে আছনে মা।
  • বিড়বিড় করে চলেছেন, "সেদিন একটু চিকিৎসা পেলে ছেলে এই পুজোতে সঙ্গেই থাকত।"
  • সোদপুরে অভয়ার বাড়িতেও অন্ধকার। কিন্তু সন্তান বিয়োগের দুঃখ কোথাও যেন মিলিয়ে দিয়েছে দুই 'অভাগা' মাকে।
Advertisement