shono
Advertisement

ছুঁয়েছিলেন সমুদ্রের রহস্যকে! টাইটানিক ডুববে, জানতেন তিনি?

জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই মার্কিন লেখক আজ হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে।
Posted: 02:47 PM Jun 07, 2021Updated: 02:47 PM Jun 07, 2021

দীপায়ন দত্ত রায়: ১৮৭২ সালে প্রকাশিত জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ্’ উপন্যাসের ইংরেজ নায়ক ফিলিয়াস ফগ ৮০ দিনে দুনিয়া চষে ফেলেও আফসোস করেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীকে চিনতে পারিনি, কেননা এ-পৃথিবীর সমস্ত সাগর, মহাসাগর এখনও আমার অদেখা, অজানা। সমুদ্র এখনও আমার কাছে এক অপার অজ্ঞাত রহস্য।’ তা, এই অপার রহস্যময় অতলান্তের প্রহেলিকা যদি কারও লেখায় ছদ্ম-ভবিতব্যের বেশে ধরা দেয়? যদি কেউ কাকতালীয়ভাবে বা অতিলৌকিক প্রজ্ঞায় ভর করে জানাতে পারেন সমুদ্র সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী? এসব প্রশ্ন কৌতূহলের পাশাপাশি উদ্রেক করে অনন্ত বিস্ময়ের।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কোণঠাসা হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের জাগরণ চাইছে বিজেপি?]

মর্গ্যান অ্যান্ড্রু রবার্টসনের (১৮৬১-১৯১৫) কথা বলছি। জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই মার্কিন লেখক আজ হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। বিজ্ঞানী হলেও মোটামুটিভাবে জীবনের শেষ ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল তাঁর সাহিত্যজীবন। একাধিক ছোটগল্প (যার অধিকাংশই সমুদ্র-বিষয়ক) ও ছ’-খানা উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত এবং ১৯১২ সালে পরিমার্জিত তাঁর উপন্যাস ‘ফিউটিলিটি’ (নামান্তরে ‘দ্য রেক্ অফ দ্য টাইটান’)। এই একটি উপন্যাসের জন্যই আজও রবার্টসনকে মনে রাখা যেতে পারে। কী ছিল এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু?

১৫ এপ্রিল, ১৯১২-এর মধ্যরাতে সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে তলিয়ে যায় সে-যুগের সবচেয়ে বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ আরএমএস টাইটানিক (RMS Titanic)। ‘টাইটানিক’-এর অর্থ ‘সুমহান’ বা ‘অতিকায়’। কিন্তু এই দুর্ঘটনার ঠিক প্রায় দেড় দশক আগে মর্গ্যান রবার্টসন নামের এক স্বল্পখ্যাত ভদ্রলোক লিখে ফেলেছিলেন ‘বিধির বিধান’! তিনি তাঁর ‘ফিউটিলিটি’ (১৮৯৮) উপন্যাসে আশ্চর্যজনকভাবে এক বিলাসতরীর গল্প গাঁথেন, যেখানে ‘টাইটান’ নামের এক অতিকায় জাহাজ সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথেই উত্তর আটলান্টিকে ডুবে গেল, তা-ও আবার এপ্রিলের এক শীতগ্রস্ত রাতে, আর সঙ্গে সঙ্গে সলিলসমাধি হল ১৫০০ জন যাত্রীর। সত্যের সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল!

এই অবধি জানলে মনে হতে পারে, নিখাদ কাকতালীয় ঘটনা, লেখকের কিছু অনুমান চোদ্দো বছর পরের বাস্তবের সঙ্গে মিলে গিয়েছে মাত্র। কিন্তু তাই কি? নেহাত ‘অনুমান’ বলে তাচ্ছিল্য করার উপায় কি আদৌও রেখেছেন রবার্টসন? ‘ফিউটিলিটি’ উপন্যাসে যে-জাহাজটি ডোবে, সেই টাইটানের দৈর্ঘ্য ছিল মোটামুটি ৮০০ ফুট, যা বাস্তবের টাইটানিকের দৈর্ঘ্যের প্রায় কাছাকাছি। শুধু তা-ই নয়, ১৯১২-র এপ্রিলের কনকনে ঠান্ডা আটলান্টিকে অত বেশিসংখ্যক যাত্রীর সলিলসমাধির অন্যতম কারণ ছিল পর্যাপ্ত লাইফবোট বা জীবনতরীর অভাব। বিস্ময়করভাবে টাইটানিকের নির্মাণের এই গলদটির সঙ্গেও হুবহু সাদৃশ্য ছিল রবার্টসনের উপন্যাসের জাহাজটির। টাইটানেরও জীবনতরীর সংখ্যা সীমিত হওয়ায় প্রাণহানির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। বাস্তবের মতো উপন্যাসেও প্রায় দেড় হাজার যাত্রী জলে ডুবে প্রাণ হারান। আর, এসবের বাইরেও রয়েছে অনেক ছোটখাটো সংগতি। যেমন, টাইটান আর টাইটানিকের গতিবেগ এক, উপন্যাস আর বাস্তবের জাহাজ দু’টির অন্দরসজ্জাও রীতিমতো সদৃশ।

প্রকৃত দুর্ঘটনার এতদিন আগে লেখা একটি উপন্যাস কী করে এত নির্ভুলভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবসদৃশ বর্ণনা দিতে পারে? শুধু কি নিখাদ পূর্বানুমান-ই ভিত্তি ছিল লেখকের? রবার্টসনের কোনও কোনও সমসাময়িক মনে করেছেন, এই লেখক অতিলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন।
কেউ আবার ভেবেছেন, রবার্টসনের উপন্যাসের গল্পকে বাস্তবে চরিতার্থ করতে কেউ অন্তর্ঘাত করেছে, যার নেপথ্যে রয়েছে বড়সড় যোগসাজশ। চক্রান্তের এই তত্ত্ব অবশ্য যথার্থ প্রমাণাভাবে ধোপে টেকেনি।

১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ‘ফিউটিলিটি’ উপন্যাসটি কিন্তু তার জন্মলগ্ন থেকে মোটেই সমাদৃত ছিল না। বহু প্রকাশকের দুয়ারে ঘুরে শেষমেশ মিলবুর্গ ফ্রান্সিসকো ম্যান্‌সফিল্ডের (সে-যুগের নামকরা লেখক ও প্রকাশক) অনুগ্রহে প্রকাশিত হয় রবার্টসনের শতাধিক পৃষ্ঠার অনতিদীর্ঘ পরিসরের এই উপন্যাস। প্রকাশের পর অল্প জনপ্রিয়তার মুখ দেখা এই বই দীর্ঘদিন প্রায় অনাবিষ্কৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। তবু স্বল্পসংখ্যায় মুদ্রিত এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণ ফুরতেই প্রকাশক ঠিক করেন, ছাপা হবে দ্বিতীয় সংস্করণ। সেইমতো ১৯১২-র ফেব্রুয়ারিতে বেরয় সেই সংস্করণ। অর্থাৎ টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঠিক দু’-মাস আগে। অদ্ভুতভাবে রবার্টসনের এবার ইচ্ছা হল উপন্যাসের নাম পাল্টে রাখবেন ‘দ্য রেক্ অফ দ্য টাইটান’। যার অর্থ ‘টাইটানের সলিলসমাধি’ বা ‘টাইটানের বিনাশ’। ‘ফিউটিলিটি’ রাতারাতি নাম পাল্টে হয়ে উঠল ‘দ্য রেক্ অফ দ্য টাইটান’! কী ভেবে নামে তড়িঘড়ি এই বদল আনলেন লেখক? বাড়ে বিস্ময়, ঘনীভূত হয় রহস্যময়তা। তবে কি সত্যিই তিনি আগে থাকতে টের পেয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতম জাহাজডুবির? সত্যিই কি তাঁর স্বজ্ঞায় ধরা দিয়েছিল অপার রহস্যময় অতলান্তের প্রহেলিকা?

পরিমার্জনার পর প্রকাশিত উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ ‘দ্য রেক্ অফ দ্য টাইটান’-এর কথা কোনও দিন হয়তো আমরা জানতেই পারতাম না, যদি না টাইটানিক ট্র্যাজেডিতে মৃত যাত্রীদের স্মৃতির উদ্দেশে টমাস হার্ডি তাঁর ‘দ্য কনভারজেন্স অফ দ্য টোয়েন’ নামের কবিতাটি পাঠের আসরে রবার্টসনের নাম উল্লেখ করতেন। টাইটানিকের দুর্ঘটনায় নিহত, আহত এবং তাঁদের পরিজনদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। সেই ক্ষতিপূরণের লক্ষ্য নিয়েই হার্ডির তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে ‘টাইটানিক ডিজাস্টার ফান্ড’। এই ফান্ডের অনুষ্ঠানে এসে টমাস হার্ডি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘রবার্টসনের বইটা আমরা সবাই আগে থাকতেই ভাল করে পড়লে বোধহয় এই দুর্দিনের সম্মুখীন হতে হত না।’ ভাবতে অবাক লাগে, চরম নিয়তিবাদী হার্ডি-ও অনুমানবাদী সাহিত্যের কাছে নতজানু হতে বলছেন!

১৯১২-র এপ্রিলে জাহাজডুবির পর বাস্তব আর সাহিত্যের মধ্যে হার্ডির এই সংযোগসুতো টানার প্রয়াস মোটেই ভাল হয়নি রবার্টসনের পক্ষে। কেননা, জাহাজডুবির অব্যবহিত পর থেকে পরবর্তী ৫০ বছর টাইটানিকের ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব মার্কিন মুলুকে গুজবের মতো ছড়াতে থাকে। অবধারিতভাবে উঠে আসতে শুরু করে রবার্টসনের নাম। এই রেওয়াজ শুরু হয় লেখকের জীবদ্দশাতেই। তাই জীবনের শেষ পর্বে অন্যদের সন্দেহের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯১৫ সালে প্রয়াত হন মর্গ্যান অ্যান্ড্রু রবার্টসন। মৃত্যুর আগে জার্নালে লিখে যান, ‘আমার অপরাধ একটাই, আমি সমুদ্রের রহস্যকে ছুঁতে পেরেছিলাম। বিশ্বাস করুন, এই অপরাধের জন্য আমি এতটুকু অনুতপ্ত নই।’

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক
dwipayan.dr1994@gmail.com

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: তিনি জননেত্রী, নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement