শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলাফল যাই হোক, মোদি নিজের ঢাক নিজেই যতই পেটান না কেন, আসলে ‘জয় শ্রীরাম’ বা হিন্দুত্ববাদী ভাবাবেগ নয়, বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতিই হয়ে উঠছে গ্রামীণ সমাজের মানুষের আচরণের অন্যতম নির্ধারক শক্তি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
অনেকেই এখনও মনে করেন, আর-এক মাস পর নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দাপট বহাল থাকতে পারে, কিন্তু দিল্লির মসনদে চা-ওয়ালা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রনেতা ফের প্রধানমন্ত্রী পদে উপবিষ্ট হবেন না– এমনটা ভাবতে এখনও বেশি সংখ্যক মানুষ নারাজ।
তবে রামমন্দিরে বালক রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হল না। ‘জয় শ্রীরাম’-এর উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নয়, ভোট প্রচারে আমজনতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে– বেকারত্ব, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক বৈষম্য এসব ইস্যু, যা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
৭৩ বছরের নরেন্দ্র মোদি শেষ পর্যন্ত পুনরায় ক্ষমতায় আসবেন কি আসবেন না, এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা আমার কাজ নয়। নির্বাচনী গণৎকার নই। জে্যাতিষী নই, পোলস্টারও নই। গত ১০ বছরে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত নাকি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি রূপে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে। প্রচারের এই ঢক্কানিনাদ প্রবল হলেও বাস্তবের ভারত কর্মহীনতা, দারিদ্র, বৈষম্য-সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাই প্রচারিত বিষয়টা কতটা সত্য সে-প্রশ্ন ২০২৪-এ ভোটের সময় নতুন করে উত্থাপিত হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: শ্লীলতাহানির অভিযোগের তদন্তে রাজভবনের ওসির কাছে সিসিটিভি ফুটেজ চাইল লালবাজার]
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ আর যা-ই হোক ‘মোদি-ভক্ত’ বলে অাদৌ পরিচিত নয়। কিন্তু এই পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যায় (২৭ এপ্রিল-৩ মে) সাপ্তাহিক প্রচ্ছদ নিবন্ধ– “হাউ স্ট্রং ইজ ইন্ডিয়া’স ইকোনমি”-তে বলা হয়েছে– ভারতে বৃদ্ধির হার শতকরা ৬ থেকে ৭। ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নের হারও প্রশংসনীয়। এ-দেশে ১৪৯টি বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে।
তারপর বলা হয়েছে, ভারতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। বলা হয়েছে, মোদির দল বিজেপি উগ্র-অসহিষ্ণুতার স্টিমরোলার চালাচ্ছে দেশে। তার জন্য বৃদ্ধিনির্ভর সাফল্য ব্যাহত। দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না বহুত্ববাদী সহিষ্ণু সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার কারণেই। সোজাকথায়,
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলতে চেয়েছে, ১৯৯০-এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতিতে যে-সংস্কার শুরু হয়, তা ব্যাহত হচ্ছে বিজেপির ‘শভিনিস্টিক’ রাজনীতির জন্য। পত্রিকাটি, এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে– তিনি কি সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তথা সে-দেশের ‘জাতির জনক’ লি কুয়ান ইউয়ের সমতুল্য, না কি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের মতো?
এই প্রশ্নে জডি়য়ে আছে তীব্র শ্লেষ। লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরকে প্রকৃত সংস্কারের পথে নিয়ে গিয়ে উদার এক আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেন। মোদি সেরকম নন। অন্যদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভোটে জেতেন, দেশে কঠোর অনুশাসন এনে আর্থিক উন্নয়নে সচেষ্ট হন, কিন্তু কোনও প্রকার রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিতে আগ্রহী নন। তিনি এতটাই অসহিষ্ণু যে, কেউ রাজনৈতিক বিরোধিতা করলে তাকে সন্ত্রাসবাদী অথবা জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার পর্যন্ত করতে পারেন। মোদি কি তবে অনেকটা এরদোগানের মতোই?
আমেরিকায় ভোটের সময় একদা বিল ক্লিনটনের সাফ মন্তব্য ছিল– ‘ইট ইস দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’। ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ গোষ্ঠীর সাম্প্রতিক ‘মুড অফ দ্য নেশন’ রিপোর্টে বলা হয়েছে– বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি জনগণের সাধারণ ‘মুড’ তৈরিতেও কারণ হয়ে দঁাড়ায়। মোদি একদিকে যেমন ‘বিকশিত ভারত’-এর ছবি তুলে ধরতে চাইছেন, ২০৪৭ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির পথ নির্দেশিকা তুলে ধরছেন, ‘মোদির গ্যারান্টি’ বলে মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন– অন্যদিকে, দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যের ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। গ্রামে-গ্রামে শ্রমিকদের মজুরি কমছে।
[আরও পড়ুন: ‘দুঃখ’ মিটল কি? ডেরেকের বাড়িতে বৈঠক শেষে কী বললেন কুণাল?]
কমছে আর্থিক বিনিয়োগ। মোদি তথা বিজেপির আর্থিক শ্বেতপত্রকে চ্যালেঞ্জ করে কংগ্রেস অর্থনীতির কৃষ্ণপত্র প্রকাশ করেছে। বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা আর্থিক সংকটের কথা কেউ অস্বীকার করছে না। বিশেষত কোভিডের পর সর্বত্র আর্থিক ‘শক’ বা ধাক্কা লেগেছে। ভারতেও কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব কম নয়। মোদি বিদেশি লগ্নি বিনিয়োগ বাড়াতে তাই আন্তরিকভাবে সচেষ্ট। কিন্তু বাস্তব চিত্র বদলায়নি। উৎপাদন শিল্পও তেজি হয়নি।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম একটি যুক্তির অবতারণা করছে। তাদের বক্তব্য, ভারতের শাসক দল যদি সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউয়ের মতো উদার অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থপতি না হয়ে তুরস্কের এরদোগানের মতো অসহিষ্ণু একনায়কতন্ত্রী হয়, তাহলে ভারতে আর্থিক বিনিয়োগ ও বৃদ্ধির পথ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে। সেক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক উদার সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। আর, এই আবহে যখন ভোটের প্রক্রিয়ায় সুবিস্তীর্ণ গ্রামীণ ক্ষেত্রে শতকরা ভোটের পরিমাণ কমে যায়, তখন শাসক দলের অন্দরমহলেও আশঙ্কা তৈরি হয় বইকি– কেন কমে যাচ্ছে ভোটের হার? প্রদত্ত ভোটের শতকরা হার কমলে তো সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এটা অ্যান্টি-ইনকামব্যান্সি ভোট। অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট ভোট।
সন্দেহ কি হিন্দি বলয়ে? যেখানে বিজেপির সবচেয়ে শক্তিশালী ভোট ব্যাঙ্ক, সেখানে কোনও ‘রাম লহের’ (রাম ওয়েভ) নেই!
[আরও পড়ুন: ৭০০ গাড়ি নিয়ে ব্রিজভূষণের পেশি প্রদর্শন! ভোটের বেসাতিতে চাপা পড়ল অ্যাথলিটদের কান্না?]
নেই মোদি গ্যারান্টির ঝড়? আবারও বলছি, ভোটারদের আচরণে এবার রামমন্দির বা মোদিকে আপাতভাবে কোনও বড় নির্ধারক ফ্যাক্টর মনে করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কি তবে গরিব ও মধ্যবিত্ত সমাজের আর্থিক পরিস্থিতির প্রভাব বাড়ছে? রাম নয়, বড় হয়ে উঠছে বেকারত্ব ও চাকরির বিষয়?
শেষাবধি ভোটের ফলাফল যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী নিজের ঢাক নিজেই যতই পেটান না কেন, আসলে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি যে গ্রামীণ সমাজের মানুষের আচরণের অন্যতম নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।