বেকারত্ব বড় জ্বালা৷ দিন আনি দিন খাইয়েদের আজ বড়ই বিপদ৷ কেউ সাহায্য করবে না৷ মেয়েলি স্বভাবের জন্য সমাজের কাছে অচ্ছুত অনেক পুরুষই আজ স্বেচ্ছায় বেছে নিচ্ছে বৃহন্নলার জীবনযাপন৷ যদি কেউ সামান্য আশীর্বাদের বিনিময়ে দু’পয়সা দিয়ে সাহায্য করে৷ তাই মেয়ের বেশে৷ লিখেছেন শুভময় মণ্ডল
ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা৷ ক্যালেন্ডারে সেপ্টেম্বর মাস৷ ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং৷ অফিস ফেরত ভিড়ে থিকথিক কে সি দাসের সামনেটা৷ সবার তখন বাসে উঠে শিয়ালদহ স্টেশন যাওয়ার তাড়া৷
দু’দিক থেকে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে নানান গাড়ি৷ সিগন্যাল লাল হলেই থেমে যাওয়া গাড়ির ভিড়ের মধ্যে কিছু বাচ্চা, মাঝবয়সি লোক হাতে-কাঁধে গুটখা, সিগারেট, খেলনা বিক্রি করছে৷ বিকিকিনির মধ্যে দেখা যায় ওঁদেরও৷ গাড়ির জানলায় টোকা মেরে হাত পেতে টাকা চাইছে৷ কেউ দিল তো তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দেওয়া৷ টাকা না দিলে শাপ-শাপান্ত করে ফের অন্য গাড়ির দিকে হাঁটা মারা৷ এমনই মজার জিনিস দেখছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে৷ হঠাৎই এমন একজন হাত পাতল আমার সামনে৷
মুখজুড়ে সস্তার মেক আপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে বাজারি লিপস্টিক, পরনে শাড়ি তাও আবার মাথায় ঘোমটা দেওয়া৷ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট পরচুলা বোঝা যাচ্ছে৷ দেখলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে৷
“এই বাবু, দে না!”
রোজকার মতোই সটান না বলে দিলাম৷ সেও চলে গেল মুখ ঘুরিয়ে৷ যন্ত্রণার একশেষ৷ শান্তিতে একটু দাঁড়াতেও দেয় না৷
পরক্ষণেই হুশ হল, আরে এই চোখদু’টো বেশ চেনা লাগল৷ কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি ঠাহর করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল৷ আরে, এতো সেই শ্যামল হকার৷ শিয়ালদহ থেকে রাত ১০.২২ মিনিটের আপ নৈহাটি লোকাল৷ কাটা গেট কম্পার্টমেণ্ট৷ গানের বই বিক্রি করেন শ্যামলদা৷ মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রফি, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের বই৷ অবিকল সন্ধ্যার গলায় গান গেয়ে গেয়ে বই কিনতে বলতেন ডেলি প্যাসেঞ্জারদের৷ হরেক বই পাঁচ টাকা৷ গান গাওয়ার জন্য সবাই খুব জোরাজুরি করতেন৷ না চাইলেও বই বিক্রির আশায় গেয়েও দিতেন দু’-এক কলি৷ মেয়েলি স্বভাবের জন্য অনেকে পিছনেও লাগত৷ বই উল্টেপাল্টে দেখে কিনত না কেউই৷ কখনও কখনও সারা দিনে বিক্রি মোটে একটা বই৷ কী করে চলে এভাবে? কিন্তু বেশ ক’দিন ট্রেনে দেখতে পাইনি৷ কে জানে, হয়তো অন্য ট্রেন ধরেন বা বই বিক্রি ছেড়ে অন্য কিছু৷
আশঙ্কাটা বিশ্বাস করতে মন চাইল না৷ তবে কী সেই শ্যামলদাই? না না, চোখের ভুল হবে হয়তো৷ ভুল ভাঙতে জোরে হাঁটা দিলাম সামনের দিকে৷ সে আবার অন্য একজনের কাছে হাত বাড়িয়ে টাকা চাইছিল৷ এবার ভাল করে দেখে শিউরে উঠলাম৷ মন ঠিকই বলছিল৷
অভাব৷ রোজগার বড় বালাই৷ আজ, পয়সার জন্য মেয়েলি স্বভাবের শ্যামলদা মুখে রং, মাথায় পরচুল পরে মেয়ে সেজেছেন৷ মেয়ে বললে ভুল হবে৷ সমাজ বলে বৃহন্নলা৷ চলতি ভাষায় অনেকে হিজড়ে বলে৷ খেপায়৷ গাল দেয়৷ মারতে যায়৷ কিন্তু৷ হয়তো এটাই ছিল একমাত্র পথ৷ অনেকে আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য টাকা দেয় তাদের৷ পরিশ্রম কম৷ বই বিক্রির মতো আশায় চাষা মরার জো নয়৷ তাই অভাবের তাড়নায় এই কাজে নেমেছেন শ্যামলদা৷ তবুও খারাপ লাগল দেখে৷ হয়তো এমন অনেক শ্যামলই পেটের জ্বালায় আজ এই কাজ করছে৷ পথচলতি মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা চাইছে৷ অভাবে কেউই দু’পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে আসবে না৷ কেউ করেও না৷ তাই হয়তো এই রাস্তা৷ দোষ আমাদেরও আছে৷ এমন হাজারো শ্যামলের দুরবস্থার জন্য আমরাই দায়ী৷ আমাদের সমাজ দায়ী৷
সাতপাঁচ ভাবছি, হঠাৎ রাস্তার উল্টোদিক থেকে তখন কাদের যেন চিৎকার৷ “ধর, ধর, আমাদের রাস্তায় ‘কাজ’ করছে! মার মার!” চিৎকার শুনেই এক দৌড়ে পালিয়ে গেলেন শ্যামলদা৷ বুঝলাম, ওঁদেরও এলাকা ভাগ রয়েছে৷ লাইনে নতুন তাই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন শ্যামলদা৷
The post পেটের জ্বালা, তাই ওঁরা আজ এই লাইনে appeared first on Sangbad Pratidin.