shono
Advertisement

Breaking News

যুদ্ধের হাতে-গরম ছবি যেন তুলে ধরছে নির্মমতার উৎকট নিদর্শন

এই কুৎসিত উল্লাসের নিদর্শন প্রকাশে কোথাও কোনও বাধা নেই, কোনও বিবেকতাড়না নেই।
Posted: 04:32 PM Mar 11, 2022Updated: 04:32 PM Mar 11, 2022

যুদ্ধের প্রচুর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়। মানুষের প্রতি মানুষের চরম নিষ্ঠুরতার হাতে-গরম চিত্রমালা, লোভ ও নির্মমতার উৎকট নিদর্শন। এই কুৎসিত উল্লাসের নিদর্শন প্রকাশে কোথাও কোনও বাধা নেই, কোনও বিবেকতাড়না নেই, যা আছে, তা আত্মতৃপ্তি, বাকি বিশ্বকে বোঝানোর প্রয়াস, দেখো, আমরা কত শক্তিমান ও বেপরোয়া। লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার

Advertisement

 

লোকচিত্রের নিজস্ব ভাষা আছে। ক্ষণকালে ধরা পড়া অপ্রস্তুত ফোটোগ্রাফি বহু আশ্চর্য সত্য উদ্‌ঘাটন করে। নিঃশব্দ ও স্থির আলোকচিত্র হলেও সেসব ছবির উপাদান ও ভাষ্য বলে দেয় মানবের চরম নিষ্ঠুরতা অথবা মনোসুষমার ইতিকথা। যেটুকু ধরা আছে, তার মধ্যে প্রবেশ করে সত্য আবিষ্কারের যে প্রয়াস, তা কল্পনাশক্তিঋদ্ধ ও অনুভবনিবিড়। ছবি থেকে বাস্তবের নির্মমতা পর্যন্ত এই যাত্রা দর্শকের চিন্তনে অভিঘাত সৃষ্টি করে। তাকে ভাবতে বাধ্য করে, ধ্বংস ও মৃত্যুর অভিশাপদীর্ণতা।

চিত্র যখন চলমান, তখন কি ঠিক এমনটাই ঘটে, দর্শন ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে? অথবা আরও বেশি কিছু? কিংবা অন্যতর কিছু, যা ঘটনায় নিহিত সত্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবে কাম্য, তার চেয়ে একেবারেই আলাদা?
এই বিচারের প্রয়োজন আছে। চলমান ছবির বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় সমাজে অনেক নতুন দিক সংযোজিত হয়েছে। বাস্তবের ঘটমানতা আরও অনেক বেশি দৈর্ঘ্যে প্রদর্শন করা যায়। চিত্রের সঙ্গে শব্দ যুক্ত হয়ে আরও বাস্তবনিষ্ঠ উপস্থাপন করা যায়। এখন বৈদ্যুতিন যুগে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যা কিছুই ঘটুক, মুহূর্তে তার চিত্র ও সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যেমন, কয়েক দিন যাবৎ টিভিতে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের অনবরত ছবি, অবিরল গোলাবারুদের ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগর, গাড়ি, মানুষ।

[আরও পড়ুন: কেন এত ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ইউক্রেনে পড়তে যায়?]

টিভির চেয়েও আরও অনেক বেশি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায়। মানুষের প্রতি মানুষের চরম নিষ্ঠুরতার হাতে-গরম চিত্রমালা, লোভ ও নির্মমতার উৎকট নিদর্শন। বিশ্বজুড়ে সেসব ছবির উপভোক্তা। একজনের থেকে আর-একজন, জগৎ জুড়ে প্রবহমান। কোনও ছবিতে গোলার আঘাতে উড়ন্ত ও জ্বলন্ত সৈনিক মৃত নক্ষত্রের মতো পতনশীল। কোথাও আগুনে পোশাক পুড়ে যাওয়া নগ্ন মৃত সৈনিকের জ্বলন্ত দেহ থেকে অন্য সৈনিকেরা খুঁচিয়ে বের করে নিচ্ছে মৃতের বহন করা ব্যাগ। সেইটি খুলে সংগ্রহ করছে ভিতরে যা কিছু ব্যবহারযোগ্য উপাদান। ঠিক যেভাবে শব ভক্ষণকারী প্রাণী শবদেহ থেকে মাংস খুবলে নেয়- সেইরকম।

কারা এই ছবি তুলেছে? নিশ্চয়ই মৃত সৈনিকের পক্ষে কেউ নয় যে, শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার অবকাশ পাচ্ছে। তাহলে, ওই ভিডিওয় যারা মৃতের বস্তু অপহরণে ব্যস্ত, তারাই ভিডিওয় ধরে রাখছে নিজেদের সেই মুহূর্তের জয় ও ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার ছবি। তারপর সেসব ছবি ধরে, বেছে, মানুষের হীন প্রকৃতির চূড়ান্ত সব প্রমাণ আপলোড করছে সামাজিক মাধ্যমে। কোনও পক্ষ সৈনিকদের সঙ্গে চিত্র সাংবাদিক প্রেরণ করলেও কিছু বলার থাকে না। সেই সাংবাদিকের কাছে নিরপেক্ষ তথ্য আশা করা বৃথা।

সাধারণভাবে একজন সাংবাদিক সংগৃহীত দৃশ্যাবলির প্রকাশ বিষয়ে ন্যায়নীতিবোধের কাছে বাধ্য থাকে, সংবাদমাধ্যমগুলির দায়িত্ববোধ থাকে ছবির ব্যবহার এমন না হয়, যা ক্ষতিকারক বা মর্যাদাহানিকর। কিন্তু যে জ্বলন্ত মরদেহ খুঁচিয়ে বস্তু সংগ্রহ করছে ও সেই ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে দিচ্ছে, তার কি কোনও সীমাজ্ঞান বা মানবিক দায়িত্ববোধ থাকে? একটাই উত্তর: থাকে না। মানবিক দায় এতটুকুও থাকলে যুদ্ধ করা যায় না। যুদ্ধের ভিতর মানুষ যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। হয় জয়, নয় মৃত্যু, এই মন্ত্রের দীক্ষা আবহমানকালের সৈনিকের। লোভ, ঘৃণা, জিঘাংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা ইত্যাদি জাগিয়ে দিতে না পারলে, শুভাশুভ মঙ্গলামঙ্গলের চিন্তা আমার নয়, আমার কাজ শুধু কাজ করে যাওয়া, এই বোধের মগজধোলাই যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিতে না পারলে যুদ্ধ করানো যায় না বলেই কৃষ্ণ দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে আবেগবিহ্বল, শোকাতুর, যুদ্ধে বিমুখ হয়ে পড়া অর্জুনকে যুদ্ধমুখিন করেছিলেন।

যে নির্মমতার ছবিগুলি এখন সামাজিক মাধ্যমে ক্রমাগত আসছে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেইসব ভিডিওগ্রহীতাগণের কুৎসিত উল্লাসের নিদর্শন প্রকাশে কোথাও কোনও বাধা নেই, কোনও বিবেকতাড়না নেই, যা আছে, তা আত্মতৃপ্তি, বাকি বিশ্বকে বোঝানোর প্রয়াস, দেখো, আমরা কত শক্তিমান ও বেপরোয়া। মৃত, সে শত্রু হোক বা বন্ধু, তার যে নগ্নদেহ অপ্রকাশ রাখার অধিকার আছে, এই লোকগুলির কাছে সেই সম্মানের ধারণা আশা করা চলে না। কিন্তু যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে, যারা যুদ্ধরত দেশের নাগরিক নয়, সেই দেশের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেইসব জনতা, যারা এই ছবিগুলিতে লাইক দেয়? যারা দেখে, নিরিখ করে, ছবিগুলি পছন্দের লোকজনকে পাঠায়? তাদের কাছে সমাজ এই ভরসা রাখে যে, তারা অকারণ বীভৎস রসকামী হবে না, তারা মৃতদেহের সম্মান রক্ষা করবে, তারা জঘন্য ভ্রষ্টমানবিক ক্রিয়াকাণ্ড দেখে, দেখিয়ে ধর্ষকামী আমোদ সন্ধান করবে না। কিন্তু ‘সমাজ’ কারা? কারা নৈতিকতার প্রত্যাশী? কারা প্রত্যাশাভঙ্গকারী? কঠিন প্রশ্ন। সমাজ তো একরকম মিশ্রণ। মানবসমষ্টির এক বিমূর্ত প্রতিষ্ঠান। সেখানে কারও শুভবোধ সক্রিয়, কেউ ব্যক্তিগত আমোদে লীন। কেউ কারও আশা রক্ষায় বাধ্য থাকে না। বরং শুভচেতনা আরও সর্বজনীন হয়ে উঠতে থাকলে যাকে ‘সভ্যতা’ বলে গণ্য করা হয়, সমাজে সেই লক্ষণ বাড়তে পারে।

যা কিছু সভ্যতার চিহ্ন নয়, নিপীড়ন, অত্যাচার, সন্ত্রাস, হত্যা ও ধ্বংস তার মধ্যে পড়ে। এগুলি মানুষকে দুঃখ দেয়, যন্ত্রণা দেয়, এগুলি কষ্ট ও অসুখের কারক। কিন্তু বহুল ব্যবহারে মানুষ এই দুঃখদীর্ণ অনুভূতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনকী, বীভৎস দর্শনের অতিরোমাঞ্চ হয়ে ওঠে বিনোদনমূলক। একসময় বিনোদনের মোহ নিষ্ঠুরতাকেই স্বাভাবিক ধরে নেয়।

অবাধ আদানপ্রদান, নিখরচায় যা খুশি দিয়ে দেওয়া ও জমিয়ে তোলার খোলা জঞ্জালপাত্রর মতো আজকের সামাজিক মাধ্যমে যুদ্ধের ছবিও একরকম বিনোদন। যুদ্ধের দৃশ্য ধ্বংসাত্মক ঘটনাময়, রক্তাক্ত ও নির্মম। কৃত্রিম হোক বা অকৃত্রিম। মানুষ যে সেসব দৃশ্যদর্শনে বিনোদন লাভ করে, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক হয় না। বিনোদনমূলক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ জুড়ে আছে মারদাঙ্গা, খুন, ধ্বংস, হিংসা, প্রতিহিংসার কল্পগল্প। সহজলভ্য সোশ্যাল মিডিয়ার এই মুহূর্তের চলতি উপকরণ রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধদৃশ্যে একেবারে সত্যি খুন, সত্যি রক্ত, সত্যি নিষ্ঠুরতার রোমাঞ্চকর দর্শনাভিলাষ তৃপ্ত করছে।

তার সঙ্গে আরও এক বিভ্রান্তিকর বিষয়, ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে দেওয়া। সোশ্যাল মিডিয়ার সত্যনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কোনও দায় নেই। সহজলভ্যতা, অতিব্যবহার, বিজ্ঞাপন, বাণিজ্য; এসবের বাইরে এই মিডিয়াচক্রের কোথাও কোনও সামাজিক ন্যায় কাজ করে না। কোনও ফিল্ম থেকে দৃশ্য চুরি করে সত্যি বলে চালানো, দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার ছবি আজকের বলে প্রচার করা, এমনকী, অত্যাচারের কপট দৃশ্য তৈরি করে সত্যি হিসাবে তুলে ধরা, এই সবই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচলিত ক্রিয়াকাণ্ড, যা অপরাধ, কিন্তু অপরাধ বলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে গ্রাহ্য নয়।

চলচ্ছবি ও বৈদ্যুতিন দ্রুততার যৌথ অবদানে জগৎ বহু হত্যা, ধ্বংস, রক্তপাতের সত্যি দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। যুদ্ধকালীন যুদ্ধক্ষেত্রের ছবির ব্যবহার একরকম প্রকরণ, একরকম কূটকৌশল। কারণ নির্মমতার ছবি ধর্ষকামীর রোমাঞ্চ তৃপ্ত করে শুধু, তা নয়, বাস্তবনিষ্ঠ বহু ছবি মানবিক চেতনা জাগ্রত করে, বিশ্বজুড়ে ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তৈরি হয়। ভিয়েতনামের যুদ্ধে এই দেশ তাদের প্রতি আক্রমণ ও অত্যাচারের ছবি বহুল প্রচার করে আমেরিকাবিরোধী জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। চলচ্ছবির মাধ্যমেই বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ইসলামিক মৌলবাদীর রিরংসার প্রতীক, শত্রুর ধড় থেকে মুণ্ড ছিন্ন করা, দেখেছে জ্বলন্ত গাজায় মৃত্যুমিছিল, দেখেছে বর্তমান যুদ্ধে রুশ মিথ্যাচার এই বিবৃতি মাধ্যমে, সাধারণ নাগরিক আমাদের লক্ষ্য নয়, এবং ক্যামেরায় ধরা পড়ছে রাশিয়ান মিসাইল ধ্বংস করছে সাধারণ নাগরিকের বাসস্থান। এ পর্যন্ত দশ লক্ষের বেশি ইউক্রেনীয় নাগরিক দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

[আরও পড়ুন: রাশিয়াকে শত্রু করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না ভারতের]

এই সচিত্র সংবাদ ও তথ্যপ্রয়োগে সমর্থনকামী দেশ বা দল চায় স্বপক্ষে সমর্থন বৃদ্ধি করতে যে প্রয়াস, ভিয়েতনামের মতো ইউক্রেনের, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্যবহার করে ভয় দেখাতে যা করেছে ও করে চলেছে তালিবান, করছে রুশ সেনা, ধর্ষকামী মানুষ ব্যবহার করে বিনোদনে, অর্থাৎ স্বার্থসাধনে, কিন্তু সংবাদমাধ্যম পরিবেশিত তথ্য সমাজের অতিনির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব বহন করে। সেই দায়িত্ব সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের, সেই দায়িত্ব গণমত তৈরিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের। যুদ্ধের খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিককে যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠতে হয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে সত্যনিষ্ঠার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে। সৈনিকের মতো তারাও মৃতদেহ, রক্ত ও ধ্বংসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাদের অর্জিত ও পরিবেশিত সংবাদের অপব্যবহার, সহজলভ্য ক্যামেরায় তুলে নেওয়া দায়হীন, নীতিহীন, অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচার সম্পর্কে তারাও হতাশ ও শঙ্কিত।

অনেক বছর আগে সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী সুজান সনটাগ তাঁর ‘অন ফোটোগ্রাফি’ বইয়ে লিখেছিলেন, ফোটোগ্রাফি এখন নৃত্য ও যৌনতার মতোই এক বিনোদন। এই বৈদ্যুতিন যুগে পৌঁছেও তাঁর এই কথা অনেকখানি সত্য বলে মনে হয়। ‘লাইক’ ও ‘স্মাইলি’ সংবলিত বীভৎস ছবির শেয়ারভ্রমণ তারই ইশারা।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক ঔপন্যাসিক
tilottamamajumder2021@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement