যোদ্ধা মারি রিড-কে পৃথিবী চেনে কুখ্যাত নারী জলদস্যু হিসাবে। শৈশব আর কৈশোর কেটেছে তঁার পুরুষের ছদ্মবেশে। ইতিহাস তঁাকে মনে রেখেছে ‘সেক্সুয়ালি ভার্চুয়াস’ বলেই। ভাগ্যের ফেরে জলদস্যু র্যাকামের জাহাজে এসে পড়েছিলেন। সেখানেই পরিচয় অ্যান বনি-র সঙ্গে। র্যাকামের প্রেমিকা, আর এক মেয়ে দস্যু। তঁাদের নিয়ে গল্প, কিংবদন্তি, চলচ্চিত্র, উপন্যাস, ইতিহাস আর কথকতার শেষ নেই! লিখলেন ঋত্বিক মল্লিক।
ইউরোপে শিল্পবিপ্লব তখনও মাথাচাড়া দেয়নি। প্রবল যুদ্ধ চলছিল ফ্ল্যান্ডার্স দল বনাম ফরাসি সেনার। অশ্বারোহী বাহিনীর দুই সেনা সেদিন লড়ছে মরণপণ। খুব বন্ধু দু’জনেই, একে-অন্যের গায়ে অঁাচ পর্যন্ত আসতে দিচ্ছে না একটুও। তার মধ্যে অল্পবয়সি যে ছোকরাটি, মুখ দেখে প্রায় কিশোরই মনে হয়। মাত্র কিছু দিন হল পদাতিক দল থেকে এসেছে, ঘোড়া ছোটাচ্ছে দঁাতে লাগাম ধরে, একহাতে পিস্তল, অন্য হাতে কাটলাস নিয়ে তার যুদ্ধ দেখার মতো। অল্প দিনের মধ্যেই সাহস আর মুনশিয়ানার জোরে নজর কেড়েছে বাহিনীর সবার।
কিন্তু হঠাৎ কী যে হল! তার সঙ্গীকে আক্রমণ করে বসল ফরাসি সেনা। নিজের লড়াইয়ের চেয়েও সেদিকেই যেন তার মনটা বেশি ঝুঁকে পড়েছিল খানিকক্ষণের জন্য, আচমকা একটা গুলি বেরিয়ে গেল কঁাধ ফুঁড়ে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে, বেসামাল মুহূর্ত সময় দেয় না যুদ্ধে। টাল খেয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যেতে যেতেও ততক্ষণে দেখে ফেলেছে সে সঙ্গীর তরোয়ালের কোপে নিকেশ হচ্ছে শত্রুর মাথা। কালব্যয় না-করে তার সঙ্গী ছুটে এল তারই দিকে। দুই ঘোড়ার রেকাব একসঙ্গে বেঁধে সঙ্গী যখন নিচু হয়ে হাতের ভারে তুলে নিচ্ছে বন্ধুর দেহ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তেও শেষবার ফিসফিস করে একটাই কথা বলেছিল সে, ‘ডাক্তারের ছাউনিতে নয়, আমাকে তঁাবুতে নিয়ে চলো।’
[আরও পড়ুন: দিলীপের পর হিরণ! পুলিশকে ‘হুমকি’ দেওয়ায় বিজেপি প্রার্থীকে কমিশনের ‘শোকজ’]
সে-কথায় কোন আদেশের সুর মিশে ছিল কে জানে, নিজেদের তঁাবুতে এনেই বন্ধুকে তুলল তার সঙ্গী। এমনিতে এই তঁাবুতে তাদের দু’জনেরই আস্তানা, আর কেউ থাকে না এখানে। সেনাবাহিনীর বাকি গোঁয়ার আর রগচটা ছেলেদের সঙ্গে তাদের খুব একটা বনেও না সচরাচর। প্রাথমিক শুশ্রূষার পর জ্ঞান ফিরল যখন, বন্ধুর দিকে শ্রান্ত দু’-চোখ তুলে তাকাল কিশোরটি। বলল, ‘আমার জামাটা খুলতে হবে এবার। ব্যান্ডেজ করার দরকার। কিন্তু আমি চাই না আর কেউ এখানে থাকুক। কয়েকটা কথা আমার তোমাকে বলার আছে।’ বলার দরকার অবশ্য হল না কিছুই। কারণ ততক্ষণে জ্যাকেট ছাড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলে ফেলেছে সেই কিশোর, খুলে ফেলছে অঁাটসঁাট করে বঁাধা বুকের কাপড়। আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার বন্ধু দেখছে, তার চোখের সামনে অনাবৃত সুকুমারী এক নারীশরীর, ফলভারে অবনত। তার অবস্থা দেখে ব্যথার দমক সামলেও হেসে উঠল সেই নারী– “আমি তোমারই হতে চেয়েছি বারবার, কিন্তু জোর করে আমায় তুমি পাবে না। কথা দাও, ভালবেসে চাইবে। নইলে থাকবে পড়ে এই চাকরি, চলে যাব যেদিকে দু’-চোখ যায়। বলো, বিয়ে করবে আমাকে?”
সে বিয়ে অবশ্য হয়েছিল। প্রথমটায় গোটা সেনাবারাকে কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি, এতগুলো দিন সমরক্ষেত্রে কিংবা ফায়ারগ্রাউন্ডে তারা দিন কাটিয়েছে এক উদ্ভিন্নযৌবনা মেয়ের সঙ্গে, যার নাম মারি রিড। সবাই ভাবছিল, এ নিশ্চয়ই সমকামী প্রেমিক-যুগলের একসঙ্গে থাকার ছুতো, পুরুষালি সেনাছাউনিতে যা আকছার ঘটত সেই ১৭ শতকে। পরে অবশ্য সেই অবাক বিস্ময় হজম করে দু’জনের বিয়ের নেমন্তন্নও খেতে গেল সবাই মিলে। বিয়ের পর লড়াইখ্যাপামি ছেড়ে মারি তঁার স্বামীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে খুলে ফেললেন সরাইখানা, নাম দিয়েছিলেন ‘থ্রি হর্সেস শ্যুজ’।
[আরও পড়ুন: মিরজাফরের পাশে ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র! পূর্বপুরুষের ‘গদ্দারি’ নিয়ে বিপাকে পদ্মপ্রার্থী রাজমাতা]
কিন্তু নিশ্চিন্তির জীবন তঁার ভাগ্যে লেখা ছিল না। কয়েক বছরের মধ্যেই দুরারোগ্য সংক্রামক অসুখে মারা গেলেন তঁার স্বামী, একঘেয়ে খদ্দের সামলানো থেকে রেহাই চেয়ে আরও একবার ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়লেন মারি রিড, পৃথিবী এবার তঁাকে চিনে নেবে কুখ্যাততম নারী জলদস্যু হিসাবে। মারি-র এই পুরুষ-বেশের সূত্রপাত কিন্তু একেবারে ছোট্ট বয়সে, ‘ছেলেবেলা’-ই বটে! বিধবা মায়ের অবৈধ সন্তান মারি। বড়লোক ঠাকুমার দাক্ষিণ্যের আশায় মা কোনও দিন প্রকাশ করেননি সন্তানের লিঙ্গপরিচয়। মেয়ে হলে তো আর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে না সে, ফলে মৃত ছেলের ঘরে জন্মানো মেয়ের খাতিরদারি করতে রাজি হবেন না শাশুড়ি– এই ভয়ে মারির গোটা শৈশব আর কৈশোর কেটে গেল ছেলে হয়ে ওঠার চেষ্টায়, মাসান্তের বরাদ্দ ঠাকুমার দেওয়া মাসোহারাটুকু নিশ্চিত করতে। প্রথমবার স্বামী মারা যাওয়ার পর ফের পুরুষ ছদ্মবেশ রপ্ত করে নিতে তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তঁাকে। ভাগ্যের ফেরে জলদস্যু র্যাকামের জাহাজে যখন এসে পড়েছিলেন, সেই পুরনো যুদ্ধ আর তরোয়ালবাজির রক্তক্ষয়ী জীবনের মধ্যে রোমাঞ্চও ছিল ঢের বেশি।
কিন্তু মুশকিলটা করে দিল অ্যান বনি, র্যাকামের প্রেমিকা, আর-এক মেয়ে দস্যু। বনির ধরনটা কিন্তু মোটেই রিডের মতো ছিল না। ভালবাসার মানুষ ছাড়া আর কারও কাছে কোনও দিন লিঙ্গপরিচয় প্রকাশ করতেন না রিড, ইতিহাস তঁাকে মনে রেখেছে ‘সেক্সুয়ালি ভার্চুয়াস’ বলেই। অন্যদিকে, পছন্দের পুরুষকে শয্যাশায়ী করার মধ্যে জয়ের আস্বাদ খুঁজে নিত বনি। অচিরেই বনি প্রেমে পড়ল মারি রিডের। জোরাজুরি আর প্রেম আদায় করার তুমুল ধস্তাধস্তির মধ্যে রিড স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, তিনি মেয়ে। অবিশ্বাসী বনির কাছে অবশ্য রীতিমতো শারীরিক পরীক্ষা দিতে হল তঁাকে। জাহাজসুদ্ধ সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেল যখন, রিড পালাতে চাইলেন প্রবলভাবে। এই লালসা আর রিপুতাড়িত পুরুষ-দুনিয়ায় নারীর শরীর তঁার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, জানতেন তিনি। তবু পালাতে পারছিলেন না, কারণ ভালবাসা আরও একবার সাড়া তুলেছিল দরজায়।
সেই প্রেমিক শিল্পীটির সঙ্গে জাহাজেই আলাপ রিডের। তঁার সঙ্গে ঘর বঁাধার আশায় সান্তিয়াগোয় চলে এলেন রিড, বিতর্ক অবশ্য পিছু ছাড়ল না তঁার। প্রেমিকের হয়ে ‘ডুয়েল’ লড়ার অপরাধে গ্রেফতার হতে হয় তঁাকে, ইউরোপে ডুয়েল তখন নিষিদ্ধ! বুদ্ধিমতী রিড কিন্তু স্বীকার করলেন সবটাই। সেই সঙ্গে চোখা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন শেরিফের দিকে, পুরুষরা ডুয়েল লড়লে কী শাস্তি হতে পারে, আপনার আইন সে-কথা লিখে রেখেছে, আমি জানি। কিন্তু কোনও নারীর ডুয়েল লড়া নিয়ে কোনও নিষেধবাক্য তো সেখানে লেখা নেই, ধর্মাবতার? যুক্তির ফঁাস আর সত্যকথনের জোর– এ দুয়ে মিলে সে যাত্রা ছাড় পেয়ে যান মারি রিড। কিন্তু র্যাকামের দলের সঙ্গে যোগাযোগটা তঁার ছিলই। বহু বছর পরে, র্যাকামের দলের সঙ্গে ধরা পড়ে যান মারি রিড আর তঁার সঙ্গিনী, সেই অ্যান বনি। বন্দিদশায় এবং খুব সম্ভবত গর্ভবতী অবস্থায় মারা যান মারি রিড। তঁাদের নিয়ে গল্প, কিংবদন্তি, চলচ্চিত্র, উপন্যাস, ইতিহাস আর কথকতার শেষ নেই!
ব্রিটিশ লাইব্রেরি বোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘আ জেনারেল হিস্ট্রি অফ পাইরেটস’-এর ১৭২৪ সালের সংস্করণে এই দুই নারীকে ছবিতে দেখতে পাওয়া যায়, ছড়ানো পা, হাতে কুঠার আর তরবারি, ঢিলেঢালা প্যান্ট আর লম্বা জ্যাকেট পরনে। ছেলে-মেয়ে দড়ি টানাটানির কোনও ছাপ নেই নিরীহ পোশাকে। অথচ, এই একই বইয়ের ডাচ এডিশনে দুই নারীকে অঁাকা হল এমনভাবে, যেখানে বক্ষদেশ উন্মুক্তপ্রায়, কাটা জ্যাকেট ঠেলে বেরিয়ে আসছে স্তনের আভাস, বিভাজিকা স্পষ্ট। যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ ছিলেন রিড আর বনি, অথচ কাটলাস ধরেছেন একই দলের হয়ে। তবুও, দিনের শেষে তঁাদের বীরত্বের ওপর বিঘতখানেক কেরামতির প্রলেপ ফেলার জন্য তঁাদের নারী-পরিচয়টাকেই টেনে আনার দরকার পড়ে সস্তা হাততালি কুড়োতে। একজনের পীনোন্নত বক্ষনাচন তুলত সঙ্গী দস্যুদের রক্তে, অন্যজনের শরীরে স্ফুটনোন্মুখ যাবতীয় নারীলক্ষণ আষ্ঠেপৃষ্ঠে বঁাধা থাকত পরতখানেক কাপড়ের নিচে। সারা জীবন এই দেহলক্ষণ চেপে রাখার সব প্রয়োজন আর প্রচেষ্টাকেই ব্যঙ্গ করে চলে মারি রিডের ওই অর্ধ-উন্মুক্ত দেহের ছবি। তঁার উড়ন্ত কেশপাশ কিংবা বঁাহাতে মাথার টুপি ধরে রাখার ভঙ্গিতে তঁাকে মেয়েলি করে তোলার যে আপ্রাণ চেষ্টা রয়ে গিয়েছে ছবিতে, তার পাশে তঁার ট্রাউজার, বুট কিংবা হাতের তরোয়াল এতটাই বেমানান যে, রিড নয়, বরং ছবিটি যেন মারি রিডের ব্যঙ্গচিত্র বলেই মনে হয়।
মেয়ে দস্যুদের পরিচয়, আর আত্মগোপনের দ্বন্দ্বের ইতিহাসটা যেন ছোট্ট করে পুরে দেওয়া হয় স্তন ঢেকে রাখা আর না-রাখার লড়াইয়ের মধ্যে। মেয়ে জলদস্যু আর তঁার শরীরী টানাপোড়েনের চেপে-যাওয়া বৃত্তান্ত ছিঁড়েখুঁড়ে তুলে এনেছিলেন জো স্ট্যানলি, তঁার বইয়ের নাম ‘বোল্ড ইন হার ব্রিচেস’। এই বইয়ের ওপরে দঁাড়িয়ে অবমাননা আর অবজ্ঞার সে-ইতিবৃত্তকে গবেষণার পরিসরে টেনে এনেছেন অনেকেই, ফেয়ারফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষিকা স্যালি ওড্রিসকোল তঁাদের অন্যতম, লিখেছেন “দ্য পাইরেট’স ব্রেস্টস”-এর মতো প্রবন্ধ। সেসব মিথ্যে ডাকাতের গল্প নয়, দস্যি মেয়েদের সত্যিকাহিনি।