অনির্বাণ চৌধুরী: ‘বেফিকরে’ ছবির শুটিং শুরু করার আগে আদিত্য চোপড়া একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছিল, একটা ছবিতে তিনি আর তাঁর প্রয়াত বাবা যশ চোপড়া বসে আছেন মুখোমুখি। সাদা কালো ছবি। সঙ্গে লেখা- “বাবার আশীর্বাদ নিয়ে ফের ৭ বছর পরে ছবি পরিচালনায় হাত দিলাম।“ এই বিজ্ঞপ্তিতে শেষ পর্যন্ত কী বলতে চেয়েছিলেন পরিচালক? তিনি বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন? না কি তাঁর সময়কে সঙ্গে করেই তিনি বাবার তৈরি করে যাওয়া রোমান্টিক ফিল্মের ঘরানায় হাঁটবেন?
Advertisement
উত্তরটা পাওয়া গেল ছবি মুক্তির দিন দুয়েক আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচালকের একটা পোস্ট থেকে। সেখানে তিনি ‘বেফিকরে’কে বলছেন নিজের ‘দ্বিতীয় প্রথম’ ছবি। নিজেই সেই নাতিদীর্ঘ চিঠিতে প্রথম ছবি ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র সঙ্গে ‘বেফিকরে’র তুলনা টেনেছেন পরিচালক। বলেছেন, ওই ছবিটা লোকের ভাল লেগে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি ততটাও মন দিয়ে ছবিটা বানাননি। পরিচালক হিসেবে তিনি ঝুঁকি নিলেন এই প্রথম। এই প্রথম বেরিয়ে এলেন নিজের কমফর্ট জোন থেকে।
পাশাপাশি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন আদিত্য- আজ যদি রাজ, সিমরনের গল্প নতুন করে বলতে হত, তবে ওই পুরনো ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কি পথ চলা যেত? উত্তরটাও নিজেই দিয়েছেন তিনি। বলেছেন- তা হত না! কেন না, সময়টা বদলে গিয়েছে। এই সময়ের সিমরন বাপুজির সম্মতির প্রত্যাশায় থাকত না। রাজও বাড়ির সবার মন জয় করে তার পর তাকে পাওয়ার চেষ্টা করত না। বেশ কথা! কিন্তু এই তুলনা কেন? তাহলে কি ‘বেফিকরে’র মধ্যে দিয়ে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’র গল্পই আরও একবার আমাদের বলতে চাইলেন পরিচালক? আলাপ করিয়ে দিতে চাইলেন এই সময়ের রাজ, সিমরনের সঙ্গে?
একেবারেই তাই! ‘বেফিকরে’ এই সময়ের ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’। খুব স্মার্ট আর ছিপছিপে- অনেকটা ‘ডিডিএলজে’ আদ্যক্ষরের মতো। তা, ‘ডিডিএলজে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৫ সালে। মাঝে এই এগারোটা বছরে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। সেই বদলে যাওয়াটাই এই ছবিতে ধরলেন আদিত্য চোপড়া। ফলে রাজ, সিমরনের সেই পুরনো রোমান্টিক প্রেম এখানে হয়ে উঠল অনেকটাই শরীরসর্বস্ব। তাতে দোষের কিছু নেইও। কেন না, খুব সহজে শরীর বিনিময় করে ফেলা এই সময়ের দস্তুর। তাই সহজ হিসেবে এই ছবি চুমুসর্বস্বও। চুমু আর যৌনতার মধ্যে খুব একটা তফাত এখানে করতে চাননি পরিচালক! তফাত কিছু আছে বলে মনেও হয় না। যাকে আমরা ভালবাসি, তাকে কি সারাক্ষণ চুমু খেতে ইচ্ছে করে না? সেই চুমুটা তো কাম বাদ দিয়ে নয়। তাছাড়া এখানে প্রেমের পটভূমি প্যারিস। ফ্রেঞ্চ কিসের রাজধানী, তাই “কিস কেয়ারফ্রি-লাভ কেয়ারফ্রি-লিভ কেয়ারফ্রি”- এই বার্তা তো থাকবেই!
ফলে ছবির শুরুতে দীর্ঘ, দীর্ঘ চুমু পেরিয়ে টাইটেল কার্ড দেখানো। সেই যশ চোপড়ার ঘরানাতেই ফিরে যাওয়া। একটু আধুনিকতার দোহাই দিয়ে, এই যা! ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-এর শুরুটা মনে আছে? সেখানে যেমন ‘এক দুজে কে ওয়াস্তে’ গানের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছিল অজস্র জুটির প্রেমকাহিনি, ‘বেফিকরে’তেও তাই! তফাতের মধ্যে পুরোটাই ওই ‘লাবোঁ কা কারবার’! কিন্তু, দেখা গেল, চাইলেও ছক ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারলেন না পরিচালক। ছবির শুরুতে, প্রেমের শহরে এতগুলো চুমুর মধ্যে কোথাও একবারের জন্যও কোনও সমকামী জুটির চুমু চোখে পড়ল না! চোখে পড়ল না বর্ণসঙ্কর জুটির চুমুও! এই ফ্রেমে সাদারা কেবল সাদাদের চুমু খায়, কালোরা কালোকে। এবং সবার শেষে ফিরে যেতে হয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চুমুতে। আর, দুই খুদের আলতো চুমুতে। মানে কি সেই চিরন্তন ভালবাসা? যুগ বদলালেও যার ধাঁচ বদলায় না?
বলা মুশকিল! কেন না, পরিচালক নিজেই তো পুরনো সময়ের পুরুষ! তার উপর ভালবাসা জিনিসটাও পুরনো। যৌনতার মতো এও তো মানুষের আদিম প্রবৃত্তি! ফলে, ‘ডিডিএলজে’ নিয়ম মেনে শিভালরাস এবং মসৃণ, কিন্তু লাগামছাড়া শরীরী প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে ‘বেফিকরে’ হোঁচট খায়। মাঝে মাঝেই মনে হয়, নায়ক ধরম আর নায়িকা শায়রা যেভাবে উদ্দাম যৌনতাযাপন করে, তা আদতে প্রত্যেকের সম্পর্কের ফ্যান্টাসির জায়গাটা ধরতে চায়। মেকিও হয়ে পড়ে সেইজন্যই! সম্পর্কের মধ্যে আমরা অনেকেই ‘বেফিকরে’ হতে পারি না বলে! তার উপরে ধরম-শায়রার প্রেমে লাগাম টানে সেন্সর বোর্ডও। রণবীর সিংয়ের ফ্রন্টাল ন্যুডিটির দৃশ্য ছেঁটে দেয়! শুধু অনুমতি দেয় নায়কের অনাবৃত নিতম্বটুকু মাত্র এক সেকেন্ডের জন্য দেখার! এখানেও হোঁচট খায় নতুন আর পুরনো প্রজন্মের মিলে যাওয়ার চেষ্টাটুকু!
আবার ধাক্কা খেতে হয় বিয়েতে গিয়ে। নতুন প্রজন্মের রাজ, সিমরনও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গিয়েই পৌঁছয়? বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানটা কাছের মানুষকে হাতছাড়া করে দিচ্ছে, এই টানাপোড়েনেই ফিরতে হয়? না কি এটাই সময় নির্বিশেষে নিয়ম? এভাবেই কি ঈর্ষা ভালবাসার কথাটা জানিয়ে দিয়ে যায়? তাই যদি হয়, তবে আর নতুন-পুরনো প্রজন্মের প্রেমে তফাত কোথায়? তফাত সম্ভবত ভয়ে। ওই ১৯৯৫-এর সময়েও আমরা একটা স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী ছিলাম। তা সে স্বতস্ফূর্ত হোক বা না হোক! সমাজিক কারণেও অনেক সময় তুমুল ঝগড়া সত্ত্বেও টিকে যেত সম্পর্ক। এখন সেই স্থিতিশীলতার সমীকরণ বদলিয়েছে। ফলে, একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পড়তে আমাদের মনে দানা বাঁধছে ভয়। পরের সম্পর্কটা যদি না টেকে? আবার যদি ব্যথা পেতে হয়? অতএব, অনুভূতিকে কবর দিয়ে স্রেফ সুখের মুহূর্ত খোঁজা! এই সময়ের প্রেমের এই ধরনকেই ‘বেফিকরে’তে তুলে এনেছেন আদিত্য। শুধু এইটুকুতেই তিনি সার্থক! অন্য কোনও খানে নয়। এমনকী, ছবির কাহিনি বলার ধরনেও নয়। বর্তমান মুহূর্ত দিয়ে শুরু হয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে পৌঁছনো এবং ক্রমান্বয়ে বর্তমান-অতীত ছুঁয়ে এগিয়ে চলা- এ কাঠামো কি আমরা অনেক ছবিতেই পর পর দেখছি না? তার উপর আবার ছবির পরতে পরতে রয়েছে এই সময়ের ‘ডিডিএলজে’ হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা। ফলে, নতুন কিছু ‘বেফিকরে’ থেকে পাওয়া যাবে না।
তাহলে এই ছবির একমাত্র প্রাপ্তি কী? একান্ত ভাবেই রণবীর সিং! হাই অকটেন পারফরম্যান্সের কথা যদি ধরতে হয়, আমরা জানি, তা এখন বলিউডে নায়কদের মধ্যে রণবীর সিং ছাড়া আর কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না। তবে ‘বেফিকরে’র ধরম তো আদতে ‘ডিডিএলজে’র রাজের ছায়া। রাজ যেমন উদ্দাম, খোলামেলা অথচ ভিতর থেকে ভারতীয়, ধরমও তাই! এই আপাত বৈপরীত্য রণবীর নিজের অভিনয়ে খুব সুন্দর ভাবে ধরেছেন। এবং টেক্কা দিয়েছেন শাহরুখ খানকে। এর আগে তিনি বলিউডে সঞ্জয় লীলা বনশালির সলমন খান নির্ভরশীলতার জায়গাটা ভেঙেছেন। এবার ভাঙলেন যশ রাজ শিবিরের শাহরুখ খান নির্ভরশীলতার ঘরানা! পাশাপাশি, খুব বেশি করে তিনি ইয়ুথ আইকন। যা রণবীর কাপুর হয়ে উঠতে পারেননি! কিন্তু, রণবীর পেরেছেন। এমন করেই পেরেছেন, যেখানে শুধু তাঁকে দেখার জন্যই প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া যায়! যা যা প্রত্যাশা থাকবে দর্শকের তাঁর কাছ থেকে, সব তিনি পূরণ করবেন কড়ায় গণ্ডায়। ঠকতে হবে না। এই অন্য রাজ, নামে ধরম হলেও মন জয় করে নেবে।
কিন্তু, শায়রার পক্ষে সিমরনের বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব হল না। বাণী কাপুর কোনও দিক থেকেই কাজলের মতো নন! অথচ দুই চরিত্রকে একই আদলে তৈরি করেছেন পরিচালক। সিমরনের মতো শায়রাও জন্মসূত্রে ভারতীয় নয়, অথচ দুজনেরই বাড়ির আবহাওয়ায় ভারতীয় আচার-বিচার মুছে যায়নি। শায়রা মুখে ‘পরোয়া করি না’ গোছের হলেও ভিতরে ভিতরে সিমরনের মতোই প্রেমের প্রত্যাশী। কিন্তু, হিসেব মিলল না। বাণী কাপুর স্রেফ প্লাস্টিক বিউটি হয়েই থেকে গেলেন ছবিতে। তাঁর কাঠ-কাঠ সৌন্দর্য নিরপেক্ষ থাকার জায়গাগুলোয় অভিনয়ে কিছু সাহায্য করল বটে, তবে তার চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়া গেল না। তবে হ্যাঁ, নাচে তিনি অত্যন্ত সাবলীল। ছবির শেষে গিয়ে তাঁর আর রণবীরের সালসার পারফরম্যান্স চোখ কপালে তুলে দেবে! বিশেষ করে মুগ্ধ করবে বাণীর বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্র শরীরের মোচড়! ওইটুকুই, আর কিছুই নয়! ধরম ভালবাসে বলেই দর্শকও শায়রাকে ভালবাসবেন!
এছাড়া এই ছবির আরও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র খোদ প্যারিস। এই ছবির সমস্ত ক্রু মেম্বারদের আদিত্য জড়ো করেছিলেন প্যারিস থেকেই। ফলে, ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফিতে একটা ঝকঝকে বিদেশি ছবি দেখার মসৃণতা এল। কিন্তু, প্যারিস রইল সেই পিকচার পোস্টকার্ড হয়েই। রোমান্টিক প্যারিস বলতে যা যা ছবি চোখের সামনে আসে, শুধু সেটুকুই দেখানো হল। ফলে ‘ডিডিএলজে’র ইউরোপের মতো প্যারিস এই ছবিতে ততটাও মনে দাগ কাটতে পারল না। যশ চোপড়া যেভাবে তাঁর ছবিতে সুইজারল্যান্ড তুলে আনতেন, তার চেয়ে সামান্য বেশি কিছু হল! এই যা!
সব মিলিয়ে খুব মসৃণ হলেও কোথাও একটা গিয়ে ধাক্কাও দিল ‘বেফিকরে’। মনে হল, এই সময়ের তৈরি আরও অনেকগুলো ছবির ভিড়ে তা হয়তো বা হোঁচট খেতে খেতে হারিয়ে যাবে। আলাদা জায়গা তৈরি করতে পারবে না। কিছু বছর আগে হলেও হয়তো পারত! যখন সময় ছিল স্থিতিশীলতার! সেই সময়ে মুক্তি পেলে হয়তো মনে দাগ কাটত ‘বেফিকরে’। কিন্তু, এখন সেটা মুশকিল! এখন চাহিদা যে স্রেফ নতুন কিছুর! আর, সেটাই দর্শককে দিতে পারল না আদিত্য চোপড়ার এই ছবি।
তবে পারত! সম্ভাবনা ছিল! যদি না ছবিটা বানাবার ক্ষেত্রে পুরনো কাজের রেফারেন্স বার বার টেনে আনতেন পরিচালক! কেন যে এবার যশ রাজ শিবিরের লোকজন ‘বেফিকরে’ হতে পারলেন না, কে জানে!
ছবি: বেফিকরে
কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, প্রযোজনা: আদিত্য চোপড়া
অভিনয়: বাণী কাপুর, রণবীর সিং
২.৫/৫
The post চুমুর চমক নিয়ে ‘ডিডিএলজে’র গল্পই বলছে ‘বেফিকরে’ appeared first on Sangbad Pratidin.