সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দোকানের পাশে পতপত করে উড়ছে ঘাস ফুলের পতাকা। কুড়মালি গান বাজিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে একের পর এক কংগ্রেসের প্রচার গাড়ি। মাইক ফুঁকে পাকাকলা ছাপে ভোট দিতে চলছে আজসুর প্রচার। কিন্তু শিল্পীরা সেই মুখ নিচু করে কাগজ–কাপড়–মাটির তৈরি মুখোশে রং–তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন দুর্গা, মহিষাসুর, কার্তিক। গ্রামজুড়ে ভোটের রং লাগলেও তা নিয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যথা নেই। বরং দোল–হোলিতে আসা পর্যটকদের হাতে চাহিদামত রঙবাহারি মুখোশ তুলে দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই চিন্তার শেষ নেই চড়িদার মুখোশ শিল্পীদের।
পুরুলিয়ার (Purulia) মুখোশ গ্রাম চড়িদা। অযোধ্যা পাহাড় ছুঁয়ে বাঘমুণ্ডির এই শিল্পী গ্রামের পরিচয় এখন প্রায় সারা বিশ্বেই। এই গাঁয়ে যে জন্ম ছৌ সম্রাট প্রয়াত পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার। তাঁর হাত ধরেই পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির বীররসের ছৌ নৃত্যকে জেনেছে বিশ্ব। আর সেই ছৌ নাচেই মুখোশ যাচ্ছে লন্ডন, নরওয়ে, আমেরিকা। বছরভর মুখোশ বাণিজ্য জমজমাট। কিন্তু করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কা এখনও সেভাবে সামলে উঠতে পারেনি চড়িদা। ফলে এখনও মহাজনের কাছে সব ঋণ শোধ হয়নি। তাই কানফাটা আওয়াজে ‘খেলা হবে’ গান বা মিটিং–মিছিল চললেও শিল্পীমন কিন্তু ভোট থেকে অনেক দূরে।
[আরও পড়ুন: ‘মা-বোনেদের দু’পায়ের ভরসাতেই লড়ব’, অসুস্থতা সত্ত্বেও হার মানতে নারাজ মমতা]
কীভাবে পর্যটকদের হাতে মুখোশ তুলে দিয়ে অর্থ আসবে? যে অর্থে মিটবে পেটের খিদে। সুদের টাকা মহাজনকে দিতে পারবেন। সেই চিন্তাতেই দিন–কাটছে জগদীশ সূত্রধর, অমর সূত্রধর, পরিমল দত্তদের। তাদের কথায়, “ভোট তো জানি ২৭ মার্চ। কিন্তু মুখোশ তৈরি না করলে তো আর পেট চলবে না। সামনেই দীর্ঘ লকডাউন (Lockdown) গিয়েছে। লোকসানের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মহাজনের সুদ গুনতে হচ্ছে এখনও।” কথাগুলো শেষ হতে না হতেই আবার কাজে ডুবে তাঁরা। কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করছেন কাগজ। মাটির দণ্ডকে নিয়ে ওই কাগজের সাহায্যেই হবে মুখোশ।
এবার দোলের মুখে ভোট হলেও মুখোশ গ্রামে কিন্তু পর্যটক পা রাখছেনই। কেনাকাটায় ভোটের কোনও প্রভাবই পড়েনি। সেই পর্যটকদের হাতে চাহিদা মতো গণেশ, দুর্গা, মহিষাসুর, কথাকলি ধাঁচের মুখোশ তুলে দিতে না পারলে আফশোসের শেষ থাকবে না। তাই ফাল্গুনী সূত্রধর বলেন, “পুজোর আগে থেকে দোল–হোলি পর্যন্ত পর্যটকদের ব্যাপক ভিড় থাকে গ্রামে। এবার দোলের মুখে ভোট হলেও পর্যটক কিন্তু আসছেনই। ফলে এখন সবাই দিনরাত মুখোশ তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।” আসলে ভোট যায় ভোট আসে। কিন্তু হাতের লক্ষ্মী কোনওভাবেই পায়ে ঠেলে দিতে চায় না মুখোশ গ্রাম চড়িদা। মুখোশ তৈরিই যে জীবন–জীবিকা।