সুমন ভট্টাচার্য: শঙ্খ ঘোষ বেঁচে থাকলে দেখে যেতেন- বাঙালি ভদ্রমহিলার কাছে হেরে গেল ‘রেস্ট অফ ইন্ডিয়া’-র সেনাবাহিনী। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭৮-এর ১৬ ডিসেম্বর যদি একটা উল্লেখযোগ্য দিন হয়, তাহলে ২০২১-এর ২ মে-ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমেরিকার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ থেকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে লেখা হবে, সাদা শাড়ি পরা ষাটোর্ধ্ব মহিলা হারিয়ে দিয়েছেন বাকিদের। এমনকী, ক্রমাগত ‘দিদি, ও দিদি’ বলে ডেকে যাওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও।
[আরও পড়ুন: কোভিড সুনামি সামাল দিতে নাজেহাল সরকার! লকডাউন জারি আরও এক রাজ্যে]
বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জয়কে- ভবানীপুরের শিখদের মিছিল দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল- দিল্লির উপকণ্ঠে বসে থাকা শিখ-কৃষকরাও সোমবার থেকে ঠিক কী-কী বলবেন। একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিলেন, ভারতীয় মুসলিমদের প্রান্তের বাইরে ঠেলে দিয়ে গেরুয়া শিবির রাজনৈতিক হারাকিরি করছে। এই চমকপ্রদ জয়ের নেপথ্যে যদি মুসলিম ভোট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়, তাহলে মাথায় রাখতে হবে, বাঙালি মহিলারাও মন উজাড় করে ঘাসফুল চিহ্নে ছাপ দিয়েছেন। তা নাহলে উত্তরবঙ্গে কিংবা জঙ্গলমহলে তৃণমূল নিজেদের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে পারত না। যে তিনটে ‘ভোট ব্যাংক’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে ‘অমর-আকবর-অ্যান্টনি’-র মতো পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বিজেপিকে ত্রিশূলের ফলায় বিদ্ধ করেছে, তার মধ্যে মহিলা এবং মুসলিম ভোটের পাশাপাশি আত্মাভিমানী বাঙালির ভোটও রয়েছে। যে-বাঙালি ডিরোজিওকে শ্রদ্ধা করে, বেগম রোকেয়াকে প্রাতঃস্মরণীয় মনে করে, এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা রাজা রামমোহন রায়কে বিধবা বিবাহ প্রচলন বা সতীদাহ রোধ করার জন্য দোষে না।
মুম্বই থেকে শিবসেনার সাংসদ সঞ্জয় রাউতের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বাল ঠাকরের দলের বর্তমান উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, যে ‘মারাঠি অস্মিতা’-র কথা বলে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার উত্থান- এবার পশ্চিমবঙ্গেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল- সেদিকেই হাঁটছে। সেজন্যই লেখার প্রথমেই বলেছিলাম, পাক হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির ইতিহাসে লেখা রয়েছে, তেমনই এই রবিবারটাও ‘গোল্ডেন সানডে’ হিসাবে বাঙালির ইতিহাসে ঢুকে পড়বে।
নির্বাচনের এই অবিস্মরণীয় সাফল্যকে পুঁজি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির মুখ হয়ে উঠবেন কি না, সেটা হয়তো নিকট ভবিষ্যৎ-ই বলে দেবে। কিন্তু ‘এনসিপি’ সুপ্রিমো শরদ পাওয়ার, ‘সমাজবাদী পার্টি’-র নেতা অখিলেশ যাদব এবং সুদূর গুজরাত থেকে আসা হার্দিক প্যাটেলের টুইট বলে দিচ্ছে, মোদি-শাহ জুটির জন্য চ্যালেঞ্জার হিসাবে একজন হাওয়াই চটি পরেই আসমুদ্রহিমাচল চষে বেড়াবেন। বাঙালির রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এই যে আত্মপ্রকাশ এবং একজন বাঙালি নেত্রী হিসাবে সর্বোচ্চ পদের জন্য দাবিদার হয়ে ওঠা, সেটাই বোধহয় ২০২১-এর নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝুলিতে নিশ্চিতভাবে কিছু তাস রয়েছে। তার মধ্যে একটা বড় তাস: তিনি ‘স্ট্রিট ফাইটার’। এই উপমহাদেশের অন্যতম তাত্ত্বিক, বিল ক্লিনটন এবং হিলারি ক্লিনটনের গুরু তারিক আলি-র ‘স্ট্রিট ফাইটিং ইয়ার্স’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, সেই ছয়ের দশক থেকে যে কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিস্পর্ধী আন্দোলনকে স্ট্রিট ফাইটাররা কতটা সমৃদ্ধ করেন। এবং গোলিয়াথের সামনে ডেভিডের মতো স্ট্রিট ফাইটার সবসময় চমকে দিতে পারেন। ২০২১-এর নির্বাচনী প্রচারের সময় যেটা তিনি বারবার স্মরণও করে দিয়েছেন। মহিলা ভোট, মুসলিম ভোট, দলিত ভোট এবং শহুরে শিক্ষিতদের সমর্থনও যেহেতু তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়েছে, সেহেতু ভারতের বড় শহরগুলোয়- অর্থাৎ দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু বা চেন্নাইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা আগামীতে নিশ্চিতভাবে বাড়বে। সেটার উপর ভিত্তি করে তৃণমূল নেত্রী তাঁর সর্বভারতীয় রাজনীতির ‘ক্যাম্পেন’ কীভাবে সাজাবেন, তা অবশ্যই লক্ষণীয় বিষয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে কবিতা পড়তে ভালবাসেন। এবং তাঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যত-ই খিল্লি করা হোক, ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে নিশ্চিন্তে বলে দিতে পারি, তাঁর যত রবীন্দ্রসংগীত মুখস্থ রয়েছে, বাবুল সুপ্রিয়কে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের সব বিজেপি নেতা মিলেও রবীন্দ্রনাথের অত লেখা পড়েননি। এই যে নিজেকে শেষ পর্যন্ত বাঙালি মনে করা, কালীপুজোয় উপোস এবং ইদের সিমুইতে অভ্যস্ত সাদা খোলের শাড়ি পরা মহিলা প্রকৃতপ্রস্তাবেই বিপদজ্জনক! এটা গেরুয়া শিবিরের থিঙ্ক ট্যাংক, স্বপন দাশগুপ্ত বা তাঁর সঙ্গীরা নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহকে ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। বোঝাতে পারেননি বলেই হুগলির গঙ্গাতীরের ভদ্র বাঙালিরা যেমন একচেটিয়াভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে ভোট দিয়েছেন এবং বিজেপির জেতা খেলাকে কাঁচিয়ে দিয়েছেন, তেমনই উত্তর দিনাজপুরে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির খাসতালুকে তাঁর সহধর্মিণী দীপা দাশমুন্সিকে ছেড়ে দলে দলে মুসলিম ঘাসফুল প্রতীকে ছাপ মেরেছে। এই যে সমস্ত সমীকরণকে বদলে দিয়ে আপামর বাঙালির নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ- যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বইয়ের নাম মনে রেখে বাংলা সাহিত্যে তাঁর তাৎপর্যকে স্মরণ করিয়ে দিই– তাহলে বাঙালি নেত্রী হিসাবে তৃণমূল সুপ্রিমোর ‘আত্মপ্রকাশ’ গত ৫০ বছরে পশ্চিম বাংলার রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এবং সুভাষচন্দ্র বসুর পরে আর কোনও বাঙালি রাজনীতিক বোধহয় এইভাবে সদর্পে উত্তর ভারতীয় প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করেননি।
মমতা আসলে জানেন, ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে রাজনীতিটা শুরু হয়। তিনি জানতেন, শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চার সংখ্যালঘুর মৃত্যু আসলে ভারতীয় রাজনীতির ‘জর্জ ফ্লয়েড মুহূর্ত’। শীতলকুচিতে গুলি চালিয়ে আসলে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির যে-রূপ বিজেপি প্রকাশ করে দিয়েছিল, সেটা যে কোনও সমাজ বা রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক মানুষদের ভোট দিতে ভয় দেখানোর নামান্তর। তাঁদের মতামতকে সামনেই আসতে না-দেওয়া। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় হয়েছিল। এবার, পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি হারল।