দিলীপ ঘোষ: পরাধীনতার গ্লানি মুছতে এই বাংলা থেকেই প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তাঁদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন ভারত হবে জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শক্তিশালী, উন্নত দেশ। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের এই বাংলা শুধুই পিছিয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার ৭৩ বছরে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূলের শাসনে এই বাংলা সমস্ত কিছুতেই তার গরিমা হারিয়েছে। অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি- সবকিছুতে বাংলা ‘পরনির্ভরশীল’ হয়েছে। ঋণভারে জর্জরিত এই বাংলার অর্থনীতি আজ তলানিতে। বাংলার কোনায় কোনায় অপসংস্কৃতি বিরাজমান। আইনশৃঙ্খলার রাজনীতিকরণ ঘটেছে। শিল্পায়নে এসেছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। রাজনৈতিক হিংসা আর বেকারত্বে পশ্চিমবঙ্গ বরং এগিয়েছে। সরকারি দপ্তরে বন্ধ স্থায়ী নিয়োগ। স্বাস্থ্য পরিষেবার মান খুব খারাপ। শিক্ষায় রাজনীতিকরণ এই বাংলার মেধাকে পরিযায়ী করেছে। দুর্নীতি আর স্বজনপোষণে রাজ্য সরকার শীর্ষে। তাই বিজেপি ডাক দিয়েছে ‘আর নয় অন্যায়’। পরনির্ভরশীলতার গ্লানি মুছে ‘আত্মনির্ভর বাংলা’ গড়ার শপথ নেওয়ার সময় এসেছে। যে-শপথ একমাত্র পূরণ করতে পারে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: মাস্টারমশাই, আপনিও?]
বাংলার অর্থনীতির করুণ দশা সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় চলে যাওয়ার সময় প্রায় ১,৯৩,০০০ কোটির ঋণ বাংলার মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে গিয়েছিল। চলতি বছরের মে মাসে বাংলার সেই ঋণের বোঝা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫,০০,০০০ কোটি টাকায়। একজন শিশু পশ্চিমবঙ্গে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই তার মাথায় ঋণের বোঝা চাপবে ৫০,০০০ টাকা! বিজেপি এই ভঙ্গুর অর্থনীতিকে ফের নতুন দিশা দেখানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রের কাছে ‘বিশেষ’ আর্থিক প্যাকেজের দাবি জানাবে। গত দশ বছরে ক্ষমতায় টিকে থাকা-ই একমাত্র পাখির চোখ ছিল তৃণমূলের। তাই রাজ্যের উন্নয়নের জন্য যখন কেন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের বিরোধিতা করে গিয়েছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কেন্দ্রের নানা প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ নিয়ে নতুন নাম দিয়ে রাজ্যের প্রকল্প বলে চালিয়েছেন। আর জনসমক্ষে বলেছেন, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। বামফ্রন্টের আমলেও এই কথা শোনা যেত। দিনের পর দিন নানা প্রকল্পের কেন্দ্রীয় বরাদ্দের টাকার হিসাব সময়মতো পাঠানো হয়নি। তৃণমূল সরকার ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক প্রকল্প চালু করেছে। বাংলার সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রতারণা করেছে। নানা প্রকল্প চালু করে দান-খয়রাতি করেছে। এই অপরিকল্পিত দিশাহীন অর্থনীতিকে সঠিক পথ দেখাবে ভারতীয় জনতা পার্টি।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও গত দশ বছরে তৃণমূল সরকার কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। তাই এই রাজ্যে মেধাসমৃদ্ধ তরুণ-তরুণীরা বাইরের রাজ্যে কাজের খেঁাজে গিয়েছেন। করোনার সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা সেই কথার সাক্ষ্য দেয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ চাকরির জন্য বিজেপিশাসিত রাজ্যে পাড়ি দেয়। কারণ, ওসব রাজ্যে বিজেপি পরিচালিত সরকার শিল্পে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাতেও সঠিক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে। যুবসমাজকে যাতে এই রাজ্য থেকে বাইরের রাজ্যে চাকরি করতে যেতে না-হয়, তেমন ব্যবস্থা করা হবে। সরকারি দফতরে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। শিক্ষকদের ‘অস্থায়ী’ চাকরিকে স্থায়ীকরণ করা হবে। পুলিশে কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে। তৃণমূলের ১০ বছরে সরকারি শূন্যপদে চুক্তিভিত্তিক চাকরি দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী চাকরির ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ করে সিভিক পুলিশকে দিয়ে কাজ চালানো হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। টেট, প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক, মাদ্রাসা, পার্শ্বশিক্ষক— প্রতিটি ক্ষেত্রেই গত দশ বছরে দুর্নীতি চলেছে। কোর্টে একের পর মামলা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা রাতের পর রাত জেগে আন্দোলন করেছেন ন্যায্য দাবিতে। এই বিষয়গুলিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে সমস্যার সমাধান করা হবে। মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়, যিনি নিজেকে ‘সততার প্রতীক’ বলে দাবি করতেন, আজ সেটা অভিযোগের মতো শোনায়!
কর্মসংস্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত শিল্প। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ, অস্বচ্ছ প্রশাসন গত ৪৪ বছরে দেশের শিল্প-মহলের কাছে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে কোনও শিল্প গড়তে চান না শিল্পপতিরা। বিশেষ করে টাটাদের সিঙ্গুর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের শিল্প নির্মাণের কাজে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরে গিয়ে গুজরাতে তৈরি হয়েছিল টাটাদের ন্যানো গাড়ির কারখানা। আজ সেই গুজরাত শিল্পে দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। ‘গুজরাত মডেল’ অনুসরণ করে শিল্পপতিদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে বাংলায় ফের শিল্পের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাই হবে বিজেপি সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বছরের পর বছর ঘটা করে শিল্প-বাণিজ্য সম্মেলন হয়েছে। কিন্তু অন্ধকার দূর হয়নি। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার শিল্পতালুকগুলি আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। জমি অধিগ্রহণ ও শিল্পনীতি তৈরি করে শিল্পের এই কালো ছায়াকে দূর করতে হবে।
শিক্ষায় রাজনীতিকরণ বাম আমলে শুরু হয়েছিল। যা ‘অনিলায়ন’ নামে অভিহিত ছিল। কেননা, তৎকালীন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক প্রয়াত অনিল বিশ্বাস সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় অনুগতদের উচ্চপদে বসিয়েছিলেন। সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট দ্বারা পরিচালিত হত। তৃণমূল জমানায় শিক্ষাব্যবস্থার ‘মমতায়ন’ হয়েছে। পাঠ্যবই ভুলে ভরা। ইতিহাস বিকৃত। টাকার বিনিময়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে নেই ভাল শিক্ষক। নেই ভাল ছাত্র। এই শিক্ষা পরিকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনবে বিজেপি।
রাজ্যের করুণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা এখন সকলেই জানেন। গত দশ বছরে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রের অনুদানে ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং হয়েছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোয় উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক নেই, স্বাস্থ্যকর্মী নেই। করোনা অতিমারী সেই অচলাবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চলতে থাকা রাজনীতির হস্তক্ষেপ দূর করে গরিব মানুষের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা গড়ে তুলবে বিজেপি। বাংলার সংস্কৃতিও আজ ভূলুণ্ঠিত। চলচ্চিত্র থেকে সাহিত্য সর্বত্র রাজনীতিকরণের প্রভাব। প্রতিবাদের ভাষা অন্তর্হিত। চালু হয়েছে আনুগত্য ধরে রাখার সংস্কৃতি। তাই বাংলায় কোনও অন্যায় হলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা পথে নামতে ভয় পান। এই ব্যবস্থা থেকেও বাংলাকে মুক্ত করতে হবে। ভারতীয় জনতা পার্টি শাসন ক্ষমতায় এসে ‘সোনার বাংলা’ গড়তে এই সমস্ত বিদগ্ধ মানুষের মতামতকে সহমর্মিতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে সরকার পরিচালিত করবে। আসুন, পরিবর্তনের মহাযজ্ঞে আমরা অংশ নিই। সবাই মিলে বঙ্গের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করি।
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)