দীর্ঘ ইনিংসের পরেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ক্ষেত্রে কংগ্রেসে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং একা নন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সত্তরোর্ধ্বর সংখ্যা কম নয়, এমনকী বিভিন্ন পদে আসীন হয়ে রয়েছেন অশীতিপররাও। রাজনীতিতে ‘অভিজ্ঞতা’ এবং ‘মর্যাদা’-য় সুদ চড়ালে নাটকীয় ও তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনা আরওই সমস্যাজনক হয়ে পড়ে। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
‘অবসর তখনই গ্রহণ করুন যখন সকলে প্রশ্ন করবে, কেন অবসর নিচ্ছেন। তখন নয় যখন সকলে প্রশ্ন করবে, কেন অবসর নিচ্ছেন না?’- এই স্মরণীয় মন্তব্যটি মহান ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্টের, যিনি ১৯৫১ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি দুর্দান্ত শতরান করে ইতিহাস গড়েছিলেন।ঠিক সময়ে অবসর নেওয়াটা কখনওই সোজা নয়। ক্রিকেটে তাও একটা সিলেকশন কমিটি আছে, যা আপনাকে জানিয়ে দেবে, কখন মাঠ ছাড়তে হবে। কর্পোরেটদের আছে বোর্ডরুম, আপনাকে কখন দায়িত্ব ছাড়তে হবে, সে বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমলাতন্ত্রে সরকারিভাবে নির্ধারিত অবসরের বয়স আছে।
অন্যদিকে, রাজনীতিতে না আছে অবসরের নির্দিষ্ট বয়স, না আছে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া- যা মসৃণভাবে পুরনোর থেকে নতুনের হাতে দায়ভার অর্পণ করতে পারে। ফলে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ক্ষমতার হস্তান্তর সাম্প্রতিকের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিকূলতাগুলোর একটা।
[আরও পড়ুন: রোমাঞ্চে ঠাসা পাঞ্জাব চিত্রনাট্য, ক্যাপ্টেনের বিতারণ কংগ্রেসের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ না ‘হারাকিরি’?]
পাঞ্জাবের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাই ধরুন। একজন ৭৯ বছর বয়সি মুখ্যমন্ত্রী, যিনি জন্মেছিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়, তাঁকে এক রকম বাধ্য করা হল পদ ছাড়তে- যা আদর্শ পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। দু’দফা জুড়ে, ন’বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৬ সালে, পাঞ্জাবের শেষ বিধানসভা নির্বাচনের আগে, অমরিন্দর সিং প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, সেটিই তাঁর শেষ নির্বাচন। তারপর, এই বছরের গোড়ার দিকে, হঠাৎই সিদ্ধান্ত পালটালেন অমরিন্দর। তিনি জানালেন, তিনি ‘মানুষের সেবা’ করে যাবেন। একজন সংযত, রুচিশীল মানুষ তিনি- মিলিটারি ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ, রন্ধনপটু, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, বাগ্মী ও আড্ডাবাজ লোক- এমন ব্যক্তিত্বের ক্যাপ্টেন ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে বিধায়কদের সঙ্গে, রাজ্যবাসীর সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলছিলেন। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ময়দান ছাড়তে চাইছিলেন না। কংগ্রেসের পক্ষে পরিস্থিতি ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাঁকে শেষত বহিষ্কার করার আগে কয়েক মাস ধরে রীতিমতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে দল।
দীর্ঘ ইনিংসের পরেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ক্ষেত্রে কংগ্রেসে অমরিন্দর সিং একা নন। রাজস্থানে যেমন, ৭০ বছর বয়সি অশোক গেহলট তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ, তাঁর চেয়ে অনেক কমবয়সি প্রতিদ্বন্দ্বী শচীন পাইলটকে তিনি এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে নারাজ। উত্তরাখণ্ডে ৭৩ বছর বয়সি হরিশ রাওয়াত এখনও আশা করে বসে আছেন, পরের বছরের নির্বাচনে তিনিই হবেন পার্টির মুখ। হরিয়ানায় দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী, ৭৪ বছরের ভূপিন্দর সিং হুডা এখনও ভেবে চলেছেন, তিনি হ্যাটট্রিক করবেন। মধ্যপ্রদেশে সাতের কোঠায় থাকা কমল নাথ আর দিগ্বিজয় সিংয়ের জুটি তরুণ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ক্ষমতার সমীকরণ থেকে ছেঁটেই ফেলেছিলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সত্তরোর্ধ্বর সংখ্যা কম নয়, এমনকী, বিভিন্ন পদে আসীন হয়ে রয়েছেন অশীতিপররাও।
বিজেপির অন্দরে বয়সের কাঠামো কংগ্রেসের থেকে বিশেষ আলাদা ছিল না। অন্তত, সাত বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাটকীয় আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কয়েকটি পদক্ষেপের মধ্যে একটি ছিল ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’ তৈরি করা। পার্টি নেতৃত্বকে পথ দেখানোর জন্য পোড়খাওয়া নেতাদের একটি গোষ্ঠী এই ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হল, বিজেপির বাজপেয়ী-আডবানি প্রজন্মের নেতারা যাতে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গোষ্ঠী থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের পদোন্নত করা হল বটে, কিন্তু এমন এক অসংজ্ঞায়িত পদ দেওয়া হল, যাতে বুঝিয়েই দেওয়া হল, সক্রিয় রাজনীতি থেকে এইসব নেতার অবসর নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। সেই সময় এই ‘বৃদ্ধাশ্রম’-এর মতো বন্দোবস্তটাকে নিকৃষ্ট এবং অসম্মানজনক হিসাবে দেখা হয়েছিল। যাঁরা সারাজীবন পার্টির জন্য নিজেদের নিবেদন করে গেলেন, মোদির গুরু লালকৃষ্ণ আডবানিও যাঁদের মধ্যে একজন, তাঁদের সঙ্গে এই ব্যবহারটাকে ভাল চোখে দেখা হয়নি।
সাত বছর কেটে যাওয়ার পর কিন্তু ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’-এর ধারণাটার তাৎপর্য ধীরে ধীরে বোঝা যাচ্ছে। বরিষ্ঠ নেতাদের বয়সসীমা ৭৫ বছরে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে, বিজেপি সহজেই পার্টির উপরমহলে একটা প্রজন্মগত পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। খুব একটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন, সেই প্রতিটি রাজে্যর মুখ্যমন্ত্রীর বয়স সত্তরের নিচে। অনেকেরই বয়স পাঁচের কোঠায়। আবার দেবেন্দ্র ফড়নবিশ এবং যোগী আদিত্যনাথ চারের কোঠায় থাকতে থাকতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। একজনই ব্যতিক্রম ছিলেন, কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং কর্নাটক বিজেপির শীর্ষ নেতা বি এস ইয়েদুরাপ্পা। অবশেষে, গত মাসে ৭৮ বছর বয়সে তাঁকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এতদিন যে তিনি টিকে ছিলেন, তার একমাত্র কারণ, তাঁর উচ্চতার কোনও লিঙ্গায়েত নেতা বিজেপিতে আর ছিল না।
মোদি যে প্রায় বলপূর্বক এই প্রজন্মগত বদলটা ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন, তার মূল কারণ, বিজেপির অন্দরে তাঁর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত। এই উত্তুঙ্গ অবস্থান তাঁকে লাগামহীন ক্ষমতা দেয়। যা তাঁর খুশি, তাই তিনি করতে পারেন। বিগত সপ্তাহে গুজরাতের মন্ত্রিসভায় প্রায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ঘটানো থেকেই যা প্রতীয়মান হল। একজন অপেক্ষাকৃত কম অবদমনকারী নেতা পার্টির অন্তর্লীন বিভাজনের টানাপোড়েন সামলাতেই নাজেহাল হয়ে যেতেন। কংগ্রেসের দুর্বল হয়ে পড়া নেতৃত্ব যা ইদানীন্তনে উপলব্ধি করতে পারছে। একমাত্র একটি স্বৈরাচারী ‘হাই কমান্ড’, যাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং একনায়কোচিত ব্যবহারের ভেদরেখা ধূসর, তাদেরই ক্ষমতা আছে বৃদ্ধ প্রহরীদের সবিনয়ে সরিয়ে দেওয়ার।
মজার বিষয়, আঞ্চলিক দলগুলি- যাদের হাবভাব দিনে দিনে নিগড়ে বাঁধা পারিবারিক ব্যবসার মতো হয়ে উঠছে, তারা কিন্তু এমন নেতাদের দ্বারাই চালিত হতে স্বচ্ছন্দ, যাঁরা কোনও দিন অবসর নেবেন না, বা নিদেনপক্ষে সন্তানদেরও সহজে ক্ষমতা অর্পণ করবেন না। অক্লান্ত শরদ পাওয়ার ৮০ বছর বয়সেও ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়ে বসে রয়েছেন। প্রায় অর্ধশতক ধরে এম করুণানিধি ছিলেন ডিএমকে-র মুখ। কেবলমাত্র অসুস্থতার দরুন প্রায় বাধ্য হয়েই মুলায়ম সিং যাদব ও লালুপ্রসাদ যাদব পরবর্তী প্রজন্মের যাদব নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী, ৭৫ বছর বয়সের দৃশ্যত ক্লান্ত নবীন পট্টনায়েক এখনও বিজু জনতা দলের একমাত্র নেতা। কে যে তাঁর পরবর্তীতে দায়িত্ব নেবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব থাকলে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে বয়স্ক নেতৃত্বের সামঞ্জস্যবিধান হওয়া কঠিন। রাজনীতিতে ‘অভিজ্ঞতা’ এবং ‘মর্যাদা’-য় সুদ চড়ালে নাটকীয় ও তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনা আরও সমস্যাজনক হয়ে পড়ে। এই বার্ধক্যজনিত অচলায়তন ভাঙার জন্য কয়েকটা বাস্তবসম্মত পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
১. একটি সংশোধিত সংসদীয় আইন, যেখানে একজন বিধায়ক বা সাংসদের জন্য দফা বেঁধে দেওয়া হবে, বয়স নয়। ধরা যাক, একজন বিধায়ক বা সাংসদ চার থেকে পাঁচ দফার বেশি থাকতে পারবেন না।
২. পার্টির যে কোনও সংগঠনের নেতৃত্ব সময়বিশেষে বদলে যাবে। যেমন ধরা যাক, কোনও একজন দু’দফার বেশি পার্টি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। এক এক দফায় বড়জোর চার বছর সময় থাকবে।
৩. পার্টি কমিটি-সহ সব স্তরে এক ব্যক্তি এক পদ নীতি থাকবে।
৪. যে-কোনও নির্বাচনের সময় অন্তত অর্ধেক প্রার্থীপদ দেওয়া হবে ৫০ বছরের কমবয়সি ব্যক্তিদের।
৫. রাজনৈতিক সদস্যপদ দেওয়া হোক আনুষ্ঠানিকভাবে ও বিধিবদ্ধভাবে, যাতে বিভিন্ন প্রজন্মের মধে্য একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থাকে এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব কম হয়।
এখন প্রশ্ন হল, কোন পার্টি নেতৃত্ব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাণ্ডজ্ঞান দেখাবেন? না কি চিরন্তন ক্ষমতার অমৃত আস্বাদন চলতেই থাকবে?
পুনশ্চ যেহেতু ‘মার্গদর্শক মণ্ডল’-এর ধারণা প্রজন্মান্তরে যাওয়ার একটা সম্ভাব্য রাস্তা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে, সেহেতু একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছেই। ২০২৫ সালে মোদির ৭৫ বছর বয়স হবে। এই একই অবসর গ্রহণের নীতি তাঁর ক্ষেত্রেও খাটবে তো? না কি তিনি অমরিন্দর সিং-সহ আরও অনেকের মতো ‘মানুষের সেবা’ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বসবেন?