সকাল থেকেই আজ সব হুল্লোড়ে লেগে গিয়েছে কীসের যেন একটা পিছুটান! রাত ফুরালেই যে বিদায় দিতে হবে দেবী দুর্গাকে! অতএব, উত্তেজনা তুঙ্গে! সারা বছরের আনন্দ সঞ্চয় করে নিতে হবে আজই! শাস্ত্র বলছে, এই উত্তেজনাই না কি নবমী তিথির মূল লক্ষণ! কেন, তার উত্তর খুঁজলেন অনির্বাণ চৌধুরী
আজ সকাল থেকেই কীরকম একটা লাগছে না?
লাগলে অস্বাভাবিক কিছু নেই! মুহূর্তটাই তো এইরকম! সকাল থেকেই সবাই মনে মনে তৈরি সেই চূড়ান্ত ক্ষণটির জন্য। ‘ওরে নবমী নিশি না হৈওরে অবসান’ বলে যত কান্নাকাটি, যত আকুলি-বিকুলি- সব বৃথা! যার যাওয়ার, সে চলে যাবেই! অতএব, এই বেলাশেষের পর্বে যতটা পারা যায় আনন্দের পাত্রখানি পূর্ণ করে নেওয়া! সকাল থেকেই পথেঘাটে ভিড়, মণ্ডপেও! নতুন জামার পাট তছনছ, চুল এলোমেলো, শুকনো মুখেও ধরে রাখা পুষিয়ে নেওয়ার হাসি, নতুন জুতোয় ফোসকা- অতএব একটু খুঁড়িয়ে হাঁটা! তৃষ্ণায় ‘ছাতি যাওত ফাটিয়া’! কিন্তু, সব উপেক্ষা করতেই হবে! এমনই তীব্র উত্তেজনা এই নবমীবেলায়!
শাস্ত্র বলছে, এই অ্যাগ্রেসনটাই না কি নবমী তিথির মূল লক্ষণ। ইংরেজি শব্দের এই এক সুবিধা- একটা শব্দেই অনেকগুলো ভাবকে জুড়ে দেওয়া যায়। এবার সেই ভাব ভাঙতে ভাঙতে কী পাব আমরা?
সে কথায় আসার আগে একটু তিথি শব্দটাকে ভেঙে নিতে হবে। ওই যে বলছি নবমী তিথি! হিন্দুদের যে কোনও শুভ কাজের দিনক্ষণই ধার্য করা হয় চান্দ্র পঞ্জিকা মতে। সেই মতে তিথি হচ্ছে একটি চান্দ্র দিন বা রাত। এবার আরও একটু উপবিভাগে প্রবেশ না করলেই নয়। কেন না, চাঁদ কখনই একরকম ভাবে আকাশে বিরাজ করে না। আজ সে আছে, কাল আবার নেইও! ঠিক এই উমার মতোই! তিনিও আজ মণ্ডপে রয়েছেন, কাল যাবেনই চলে! তো, চাঁদের এই মুখ দেখানো আর মুখ লুকানো ধরে আমরা পেলাম শুক্ল আর কৃষ্ণ- এই দুই পক্ষ বা সাকুল্যে পনেরোটি করে দিন! আমরা এই শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখব। দুর্গা পূজা শুক্লপক্ষেরই উৎসব, অতএব এখনই কৃষ্ণা নবমী নিয়ে আলোচনা প্রয়োজনহীন।
শাস্ত্র বলছে, শুক্লা নবমী তিথি ‘উগ্রপ্রদা’! অর্থাৎ এই তিথিতে অ্যাগ্রেসন বা উত্তেজনা বাড়ে। তো, বেড়েই চলা উত্তেজনা নিয়ে কী করা যায়? কীই বা করতে হয়?
তারও নিদান রয়েছে শাস্ত্রে। তা বলছে, এই উত্তেজনাপূর্ণ শুক্লা নবমী তিথি না কি শিকার, বিষক্রিয়া করে কাউকে হত্যা, শস্ত্রনির্মাণ, অগ্নিসংযোগ মানে কোথাও আগুন লাগানো, জুয়াখেলা, মদ্যপান, মদ তৈরি করা এবং ঝগড়া করার জন্য একেবারে আদর্শ! বুঝতে অসুবিধা হয় না, উত্তেজনা দমন করতে না পারলে মানুষ যা যা খারাপ কাজ করে থাকে, তারই একটা তালিকা তৈরি করেছে শাস্ত্র। শুধু জলেই তো নয়, চাঁদের ওঠা-নামা মানুষের শরীরে-মনেও যে প্রভাব ফেলে! মনোস্তাত্ত্বিকরাও তো বলে থাকেন, ভরা চাঁদে মানুষের হত্যা-প্রবণতা বৃদ্ধি পায়!
তাহলে কী কর্তব্য? এই উত্তেজনা প্রশমন করতে না পারলে তো উৎসবই বৃথা! সেক্ষেত্রে আর অশুভ শক্তিকে পরাজয় করে শুভ শক্তির জয় হবে কই!
আশ্চর্যের ব্যাপার, শাস্ত্র এই উন্মত্ততা থেকে রক্ষার জন্যও দেবী দুর্গারই শরণ নিতে বলছে। মুহূর্ত চূড়ামণি শাস্ত্রমতে, তিনিই এই নবমী তিথির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁকে স্মরণ করলেই নবমী তিথি জাত সকল ক্ষতিকর উত্তেজনা প্রশমিত হয়। পাশাপাশি, শাস্ত্র এই শুক্লা নবমী তিথিকে নাগদ্বারা অধিশাসিত বলছে। অর্থাৎ, এই শুক্লা নবমী তিথিকে রক্ষা করে সাপেরা। তাই এই নবমী তিথিতে সাপেদের জন্য বিশেষ পূজার বিধি রয়েছে। বলা হয়, মহাবলশালী নাগ অষ্টবসু স্বয়ং এই তিথিকে এবং এই তিথিতে উত্তেজনাগ্রস্তজনকে রক্ষা করেন! সেই জন্যই কি দেবী দুর্গার হাতে নাগপাশ দেখা যায়?
এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে! তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই যে, সারা বছরব্যাপী শুক্লা নবমী তিথির মধ্যে একমাত্র শুভ হল আশ্বিনের শুক্লা নবমী। শাস্ত্র তাকে দক্ষ সাবর্ণি মন্বাদি তিথিও বলছে। যা কি না এই এই দুর্গা নবমী। এই দুর্গা শুক্লা নবমী তাই সকল শুভ কাজের জন্য উপযুক্ত। অবশ্য শুভ কাজ বলতে এখানে জপ, তপ, উপাসনা, যজ্ঞ- এসবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এবং বারণ করা হয়েছে কিছু বৈষয়িক কাজে হাত দিতে। সম্ভবত শুক্লা নবমীর মূল চরিত্রটির দিকে খেয়াল রেখেই! সেগুলো কী? না, শিক্ষারম্ভ-উপনয়ন-বিবাহ-উপবাসভঙ্গ-গৃহনির্মাণ এবং কোথাও যাওয়া! সে যতই এই আশ্বিন শুক্লা নবমী দেবী দুর্গার অধীন হোক না কেন!
এত শুভ তিথি বলেই হয়তো আশ্বিনের এই দুর্গানবমীর রাতকে আটকে রাখার আকুতি বারে বারে শোনা গিয়েছে। সে যেমন কবিদের গলায়, তেমনই সাধারণ মানুষের গলাতেও! কেন না, এই নবমী তিথি সব দিক থেকেই উৎসবের উপযোগী। উৎসবের এমন চূড়ান্ত শুভ দিনক্ষণ আর মেলে না বললেই চলে! সারা বছরে এই তিথি একবারই আসে! কিছু ক্ষতিকর উত্তেজনা নিয়ে আসে বটে, তবে সে তেমন ধর্তব্যও নয়!
সত্যি বলতে কী, ওই উত্তেজনাকে সঙ্গে করেই তো আজকের রাতটা আনন্দে-বিষাদে পার করে দেব আমরা। উত্তেজনা নিয়ে এই ক’দিন যতটা না আনন্দ করেছি, তার চারগুণ বেশি আনন্দ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করব এই তিথিতে। যা আমাদের সারা বছরের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।
তার পর বছরের বাকি শুক্লা নবমীগুলো হোক না ‘উগ্রপ্রদা’! ভয় কী! আনন্দের আলোকশিখা আর দেবী দুর্গা তো সঙ্গে থাকবেনই! তিনি যাবেন শুধু মণ্ডপটি ছেড়ে! মন ছেড়ে কোথাও যাওয়ার তাঁরই বা জো কই!
The post ওরে নবমী নিশি! appeared first on Sangbad Pratidin.