মহারাষ্ট্রে মহাভারত! এই অন্তর্দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ কেবলই শিব সেনার মধ্যের আদর্শগত সংঘাত বা জেনারেশন গ্যাপের সমস্যা নয়। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
‘মুখ্যমন্ত্রী যে-ই হোক না কেন, রিমোট কন্ট্রোলটা সবসময় আমারই হাতে থাকবে!’ সিংহাসন-সম রুপোর আরামকেদারায় বসে, হোয়াইট ওয়াইনে চুমুক দিতে-দিতে, এমন কথা বাল ঠাকরেকেই মানায়। তিনি এই জবাবটি দিয়েছিলেন, যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ২০০৪ সালে মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-শিব সেনা জোট জিতলে উদ্ধব ঠাকরেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য বিবেচনা করবেন কি না।
প্রায় ২০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে তারপর। দলে অভূতপূর্ব এক অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফলে উদ্ধব ঠাকরের সরকারকে কেবল খাদের ধারেই ঠেলে দেওয়া হয়নি, সেই ‘রিমোট কন্ট্রোল’-ও উবে যাচ্ছে ‘মাতশ্রী’ থেকে, অর্থাৎ, ঠাকরেদের আবাস থেকে। বোঝা যাচ্ছে, ‘মহারাষ্ট্রিয়ানাস্মিতা’-র (মহারাষ্ট্রীয় আত্মসম্মান) জন্য ‘মাটির সন্তান’ আন্দোলনের পতাকাবাহী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি আগে প্রতিষ্ঠিত শিব সেনা দল একটি গুরুতর অস্তিত্ব-সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
[আরও পড়ুন: দেশের ‘আমব্রেলা’ শতচ্ছিন্ন, তার বেলা?]
শিব সেনা দলটির অবস্থা আংশিকভাবে যে কোনও পরিবার-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক দলের দুর্দশার মতোই। এই আঞ্চলিক দলগুলির পরিচয় আবর্তিত হয় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ কোনও ব্যক্তিকে ঘিরে: দলটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে গেলে, তাঁর উত্তরসূরিরা কীভাবে সেই অব্যাহত আধিপত্য নিশ্চিত করবেন? তা সে উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদব-ই হোন কি বিহারের তেজস্বী যাদব, কিংবা পাঞ্জাবের সুখবীর বাদল, অথবা কর্ণাটকের কুমারাস্বামী, এমনকী কংগ্রেসের গান্ধীরাও এই তালিকাতেই পড়বেন। তাঁদের রাজতিলকের বিশেষাধিকার তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেখান থেকে বংশতিলকের মর্যাদা উদ্ধার করতে সকলে মরিয়া। এমনকী, নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল, যে-দলকে প্রায়শই সফল রাজবংশীয় হস্তান্তরের উদাহরণ হিসাবে দেখা হয়, সেই দলও ভবিষ্যতের প্রশ্নের সামনে: নবীন পট্টনায়েকের পর কে? এম. করুণানিধির মৃত্যুর পরে তামিলনাড়ুতে ডিএমকে শুধুমাত্র আপেক্ষিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে, কারণ তাদের ক্যাডারদের অধিকাংশজনই সংঘবদ্ধ ছিল।
এদিকে শিবসেনাও তাদের শক্ত ঘাঁটির ক্যাডার-ভিত্তিক ‘শাখা’ নেটওয়ার্ক দ্বারা চালিত বলে দাবি করে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাল ঠাকরের মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা এই ব্যক্তি হট্টগোল-প্রিয়, নিজ-স্বার্থে তাঁর সমর্থকদের খেপিয়ে তুলতে ভালবাসেন, কিন্তু তিনি কখনও নিজে নির্বাচন লড়েননি। তিনি প্রশ্নাতীত ‘সুপ্রিমো’। তিনি মাফিয়া-রাজের মতো একটি কাঠামোর নেতৃত্ব করেছিলেন, যা সম-পরিমাণ ভয় ও আনুগত্য তৈরি করেছিল দলের মধ্যে। তিনি এমন একজন জননেতা, যিনি প্রকাশ্যে ‘ঠোকশাহি’-র (হিংসাত্মক ভীতি প্রদর্শন) রাজনীতিকে সমর্থন করেছিলেন আঞ্চলিক এবং জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে।
বাল ঠাকরের ক্যারিশ্মাকে অনুকরণ করা মোটেই সহজ কাজ নয়, আর তাই উদ্ধব ঠাকরেও সে-পথে হাঁটেননি। বাবার সফল প্রতিরূপ হয়ে ওঠার বাসনায় মজেননি। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সেনা-নেতৃত্বাধীন সরকারের মধ্যেও মধ্যপন্থী, সহনশীল মুখ হিসাবে নিজের পরিচয় অঙ্কিত করেছেন, কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে বাঘ তার ডোরা কখনও বদলায় না।
বছরের পর বছর এই সৈনিকরা মুম্বইয়ের ‘রাস্তার যোদ্ধা’ ও ‘লুম্পেন’ হিসাবে নিজেদের খ্যাতি তৈরি করেছে। তারা ক্রিকেটের পিচ খুঁড়ে ফেলেছে, পাকিস্তানি শিল্পীদের পারফর্ম করার অনুমতি দেয়নি, বিরোধীদের উদ্দেশে রুক্ষ এক প্রতিরোধ ছুড়ে দিয়েছে- কখনও বিরোধী বানিয়েছে দক্ষিণ ভারতীয়দের, তো কখনও মুসলিমদের। বিরোধী বদলে গেলেও দলের স্বতন্ত্র সংগ্রামপ্রবণ চরিত্রের বদল ঘটেনি। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, প্রথমে বিদ্রোহী ও সদ্য মুখ্যমন্ত্রী পদাসীন একনাথ শিণ্ডের জীবনেতিহাসেও জনতাকে ক্রোধিত করে নেতৃত্ব দেওয়ার অতীত রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে থানের এক হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর সমর্থকরা, কারণ সেই হাসপাতালেই রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অপারেশন টেবিলে মারা যান শিণ্ডের শিক্ষক-সম আনন্দ দীঘে।
স্বল্পভাষী উদ্ধব এবং তাঁর জেসুইট কলেজ পাস করা পুত্র আদিত্য ঠাকরে শিবসেনা-রাজনীতির ইতিহাসের নিরিখে অনেক শহুরে মুখ। ফলে, এই আগুনে দলের ‘আসল’ চেহারা আর সেই দলের কট্টর রাস্তার যোদ্ধাদের শৈলী এবং কার্যকারিতার সঙ্গে মিলমিশ খায় না। মহারাষ্ট্রের সাংসদ যখন হনুমান চালিশা পাঠের জন্য সেনা-সরকারের দ্বারা রাজদ্রোহিতার দোষে দোষী হন, তখন দলের ক্যাডাররা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে দলের হঠাৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভাবধারায়। আর, এই বিভ্রান্তি তৈরি হয় পরিবারেরই তেজি বিদ্রোহী রাজ ঠাকরের দ্বারা। আদিত্য ঠাকরের পরিবেশ সংকট নিয়ে অঙ্গীকার প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু তা শিব সেনার পদমর্যাদার সঙ্গে অনুরণিত হয় না। তারা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে স্পষ্টভাবেই অজ্ঞ, বরং পরিচয়ের রাজনীতির মতো আবেগপূর্ণ বিষয়গুলোকে গ্রহণ করতে সক্ষম রাজনীতির অংশ হিসাবে।
কিন্তু এই অন্তর্দ্বন্দ্বের বিস্ফোরণ কেবলই শিব সেনার মধ্যেকার আদর্শগত সংঘাত কিংবা জেনারেশন গ্যাপের সমস্যা নয়। পার্টির মধ্যে এই ভাঙন লাগতই না, যদি না বিজেপি এরকম সচেতনভাবে শিব সেনার রাজনৈতিক পরিসরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করত, যদি না দল ভাঙিয়ে নিজেদের দলে লোক টানার চেষ্টা করত। ১৯৮৮ সালে শিব সেনা এবং বিজেপি যখন প্রথমবার জোট তৈরি করল, প্রশাসনিক অংশীদারির সীমারেখা ছিল একদম স্পষ্ট: শিব সেনা মহারাষ্ট্র দাপাবে, আর বিজেপি দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাট ঘোরাবে। ‘মারাঠি মানুষ’ পার্টি এবং হিন্দি আধিপত্যবাদী গেরুয়া দলের মধ্যে এই ফেভিকল-জোড় হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের তরঙ্গ তোলে দেশ জুড়ে তো বটেই, মহারাষ্ট্রতেও। যার ফলে, মারাঠা-আধিপত্যময় কংগ্রেসের একচেটিয়াপনাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে মহারাষ্ট্রে। প্রয়াত বিজেপি নেতা প্রমোদ মহাজন ঠিক যেমন বলেছিলেন সে-সময়, এই জোটের নির্মাণ, এই গঠবন্ধন ছিল আসলে ‘প্র্যাকটিকাল নেসেসিটি’। প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তা! এই জোটের আগে অবধি, দুই দল পৃথক-পৃথকভাবে ভোট পেত। কিন্তু জোট তৈরি হওয়া মাত্র তারা ১৯৯৫ সালে মহারাষ্ট্র সরকার গঠন করল।
অথচ রাজনীতিগত এই সমান-সমান অংশীদারিত্ব ধুয়েমুছে গেল ২০১২-য় বাল ঠাকরের মৃত্যুর পর। আর, ঠিক এক বছর পরেই, জাতীয় রাজনীতিতে দণ্ডমুণ্ডসুলভ অভ্যুদয় ঘটল নরেন্দ্র মোদির। আর, ২০১৪-র মধ্যেই, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার পাল তুলল সাফল্যের সঙ্গে এবং মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে একক দল হিসাবেই লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিল। সন্দেহ নেই, এই সিদ্ধান্তে একপ্রকার ঝুঁকিই নিয়েছিলেন তৎকালীন বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ। কিন্তু মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি যখন একক বৃহত্তম পার্টি হয়ে উঠল, এবং তাদের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেবেন্দ্র ফড়নবিস শপথ রাখলেন, এই ঝুঁকি পুরস্কারসম হয়ে উঠল। নির্বাচনের পর, বিজেপি-শাসিত সরকারে যখন আস্তে আস্তে থাবা বসাল শিব সেনা, বোঝাই যাচ্ছিল, একটা আহত বাঘ যেন থাবা বসাচ্ছে।
২০১৯-এ শিবসেনা বিজেপি থেকে বেরিয়ে এসে যখন এনসিপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি’ জোট গড়ে তুলল, বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে, এটা ২০১৪-র পরাজয়ের প্রতিশোধ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। আর ২০২২-এর এই কোন্দল, সন্দেহাতীতভাবে ২০১৯-এর বেইমানির প্রতিস্পৃহা ব্যতীত কিছু নয়। দুই দলের নেতৃত্বের মধ্যে হিংসার মাত্রা এতটাই তীব্র যে, কেবল বদলা নেওয়ার উদ্দেশ্যে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে ভয়ংকরভাবে অপব্যবহার করা হল। উদ্ধব ঠাকরের পাশে যাঁরা দাঁড়ালেন, তাঁদের রীতিমতো কেন্দ্রীয় এজেন্সির খপ্পরে পড়তে হল, আর উলটোদিকে যাঁরা বিরোধী শিবিরে যোগ দিলেন, কিংবা দল ভেঙে বেরিয়ে এলেন, তাঁদের সুরক্ষা কবচ দিল বিজেপি, সেই ‘ওয়াশিং মেশিন’ সুলভ শুদ্ধিকরণের রেকর্ড রেখেই।
বিজেপির নির্বিকল্প রাজনৈতিক আগ্রাসনের সম্মুখে ঠাকরে-দের মোকাবিলা করার উপায় সীমিত। হয়, ছোট দল হিসাবে নিজেদের মেনে নেওয়া, নয়তো জাতীয় শালপ্রাংশু দণ্ডমুণ্ড দলের কাছে মাৎস্যন্যায়-পূর্বক নিজেদের অস্তিত্বের বিনাশ। আবার ওদিকে ‘মহা বিকাশ আগাড়ি’ জোট তৈরি করা মানে শিবসেনার হিন্দুত্ব মন্ত্রে ক্ষয়। আর, একা একা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত মানে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি। সামনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিএমসি নির্বাচন। দেশের সবচেয়ে বিত্তশালী পুরসভা-ই এখন শিব সেনার শেষ ঘাঁটি। এই অবস্থায় ঠাকরে পরিবার আর-একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো জায়গাতেই নেই। তার চেয়েও বড় কথা, এই মুহূর্তে পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষাটা বড় কথা নয়, বরং মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রতিনিধি বা মুখ্য বিরোধী হিসাবে টিকে থাকা।
পুনশ্চ, গত শতকের নয়ের দশকের কথা। মহারাষ্ট্রে, শিব সেনা আর বিজেপির মধ্যে কে কোথায় ক’টা প্রার্থী রাখবে, সেসব নিয়ে সরাসরি আলোচনা হত। এই যেমন বাল ঠাকরে এবং প্রমোদ মহাজনে মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, ঠাকরের মাতশ্রী রেসিডেন্সে। সেই আলোচনায় কোনওভাবে বাল ঠাকরে একবার বিরক্ত হয়ে গেলে প্রমোদ মহাজনের মোটামুটি কালঘাম ছুটে যেত তাঁর রাগ ভাঙাতে। তা, শেষমেশ কীভাবে শিব সেনার প্রধান নরম হতেন? এই প্রশ্ন করার পর বিজেপি নেতা প্রমোদ মহাজন হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাঁর প্রিয় ইমপোর্টেড এক বাক্স কিউবান সিগার ধরিয়ে দিতাম আর কী!’ মানতেই হচ্ছে, সময় বিপুল বদলে গিয়েছে!