‘রোজ একটু কথা বলবেন, না হলে বাংলা ভুলে যাব’, শেষবার হাসপাতালে ভরতির দুদিন আগে সুরকার বীরেশ্বর সরকারের স্ত্রীকে ফোনে এই কথা বললেন সুরসম্রাজ্ঞী। একসময় বউবাজারে তাঁদের বাড়িই ছিল লতা ও আশার ঠিকানা। কলম ধরলেন সুরকারের স্ত্রী সতী সরকার।
ফোনটা বেজেছিল এক আলসে দুপুরে। তখন তো ল্যান্ডলাইনের জমানা। কে? জিজ্ঞেস করায় ফোনের ওপ্রান্ত থেকে একটা শব্দ ভেসে এল, “লতা।” কে লতা? কোন লতা? তখন সদ্য আমার এক পরিচিতার বিয়ে হয়েছে। সেও তো লতা। আমি বললাম, “ও, তা তুই বাপের বাড়ি কবে এলি?” ও প্রান্তে তখন হাসির ফোয়ারা। “বউদি, আমি লতা। কলকাতায় এসেছি। এয়ারপোর্টে রয়েছি। দাদার আসার কথা। দেখছি না। দাদা না এলে আমি তো প্রোগ্রামে যাব না।” ১৯৬০ সাল। সেবার টানা তিনদিন লতা মঙ্গেশকর কলকাতায়। অনেক প্রোগ্রাম। তিনি সেবার বাড়িতে এলেন, কত আড্ডা। গল্প। এবং দেখলাম শ্রদ্ধা ও সংযম কাকে বলে। বউবাজারে সোনাপট্টি। এখানকার অভিজাত জহুরি পরিবারের বধূ আমি। আমার স্বামী, বীরেশ্বর সরকার ততদিনে সিনেমা জগতের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন। গীতিকার এবং সুরকারও বটে। তিনি সেদিন বেরিয়ে গিয়েছেন বিমানবন্দর থেকে তাঁর ‘দিদির’ ডাকে। ‘দিদি’ ততদিনে আমার স্বামীর লেখা, সুর দেওয়া একাধিক গান গেয়ে ফেলেছেন। প্রোগ্রামের মাঝপথে খবর পাঠিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে রাতে আসবেন তিনি। থাকবেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রস্তুত তো থাকতে হবে। নির্দেশ এল, ঘরে যেন বিবেকানন্দ—রামকৃষ্ণর ছবি থাকে। রাখলাম। তিনি ঘরে ঢুকেই আমায় জড়িয়ে ধরলেন আর মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন দুই মনীষীকে। বললেন, তাঁর জীবনে এই দু’জনের কতখানি প্রভাব। মুম্বইয়ের বাড়িতেও বিবেকানন্দর ছবি রয়েছে যে!
সেই রাতে গল্প জুড়লেন। তখন অনেক রাত। তা হলে খাওয়া? দুধ ছাড়া চা। তাও পুরো কাপটা শেষ করলেন না। করতেনও না কখনও। সংযম। ভীম নাগের মিষ্টি দই, রসগোল্লা বা ছানার পায়েস রাখা ছিল। তবে অনেকটা নয়, ভীষণ ভালবাসতেন বলেই একটুখানি মুখে দেওয়া। দই খেতেন চামচে মেখে। ঠান্ডা নয়। গলার যাতে ক্ষতি না হয়। মিষ্টির রসও নয়। সংযম। পরে যখনই মুম্বই গিয়েছি, নিয়ে যেতে হয়েছে দই, রসগোল্লা, ছানার পায়েস। দেখেছি ঘরোয়া আড্ডা বা গল্পগাছা করতে করতেও গুনগুন করে যেতে। সুরের সঙ্গত্যাগ কখনও নয়। মুম্বইয়ে প্রভুকুঞ্জের বাড়িতে বেডরুমে একটা সুরমণ্ডল। সেখানে তানপুরার তান ঢিমে মেজাজে রেকর্ডারে বেজে চলেছে অবিরত। সুরের সঙ্গে সহবাস। আমরা অবাক হতাম। যাঁকে একটু ছোঁয়ার জন্য, যাঁর স্টেজ শো দেখার জন্য বাঁধনছাড়া পাগলামো দেখে আসমুদ্র হিমাচল কেন, বিশ্বের বহু দেশ, তিনি কত সহজে একেবারে মাটির মানুষ হয়ে যান। শিশুর মতো হাসেন। আমাদের বউবাজারের শো রুমে ঢুকেছেন। বাঙালির গয়নার স্টাইল খুব পছন্দের ছিল। বিশেষ করে বালা। ভাসবাসতেন শাড়ি। মাঝে মাঝে যখন ফোন করতেন, তখনও কথা বলতেন এই নিয়ে।
[আরও পড়ুন: শেষ ক’টা দিন কেমন কেটেছিল লতা মঙ্গেশকরের? স্মৃতিচারণায় হাসপাতালের চিকিৎসক ]
আমার স্বামী তাঁকে দিয়ে পুজোর গান রেকর্ডিং করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার দুই প্রথিতযশা বাঙালি শিল্পী তাঁকে বারণ করেন। নবাগতার গান যদি হিট না হয়! তাই সেই প্রস্তাব শুনে তিনি বলেছিলেন, যদি সিনেমা হয়, তবে তার গান তিনি গাইতে পারেন। পুজোর রেকর্ডিং নয়। সেই কথা শোনার পরই গোঁ চাপে আমার স্বামীর। পরপর তিনটে সিনেমা হল, সোনার খাঁচা, রাজনর্তকী এবং মাদার। তিনি গাইলেন। এবং আমাদের পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। যেদিন শেষ হাসপাতালে গেলেন, তার ঠিক দিন দুই আগে বোধহয় কথা হচ্ছিল। বললেন, “বউদি, রোজ একটু কথা বলবেন। না হলে বাংলা ভুলে যাব।”
আসলে উনি কিছুই ভুলতেন না। কাউকে ভুলতেন না। প্রভুকুঞ্জের বাড়িটা অদ্ভুত। সেখানে একটা করিডর মতো আছে। ইয়া বড় দুটো ঘর পাশাপাশি। একটাতে লতাজি আর একটাতে আশা দিদি থাকতেন। করিডরের মধ্যে একটা দরজা আছে। খুলে দিলে সহজে এঘর—ওঘর করা যায়। আশাজি আমার বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়েছেন। তিনি খুব ফুডি তো। খেতে ভালবাসেন। আর আমরা গেলে ওখানে উঠতাম। দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং ওদের বাবাকে নিয়েই। ওঁরা হোটেলে উঠতে দিতেন না। ১৯৭১ সালে প্রথম সোনার খাঁচা সিনেমার গান রেকর্ডিং হয়েছিল। তখন থেকে সম্পর্ক তো। দেখতাম বাড়িতে কত সংযমী জীবন যাপন করেন। বাইরের খাবার দেখিনি কখনও। বেশি রাত করা বা হুটহাট খাবার নয়। অদ্ভুত পরিমিতি বোধে ছেয়ে থাকা জীবনবোধ। জোরে কথা বলতেন না। ওই মাপের মানুষ। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দিত দেখুন। বীরেশ্বরবাবু মারা গেলেন ২০০৪ সালে। তারপর আমি একবার মেয়ে শ্রীকে নিয়ে গিয়েছি। দিদি বললেন, বউদি, দাদার জন্য কিছু করতে চাই। ওঁর চারটে অপ্রকাশিত গান ছিল। সেগুলি চেয়ে পাঠালেন। দিলাম। সেই নতুন চারটের সঙ্গে পুরনো কিছু গান মিলিয়ে এইচএমভি থেকে ক্যাসেট বের করলেন। একটাও পয়সা নিলেন না। আমরা ভাবতেও পারিনি। ওঁরা বোধহয় অমনই হয়। ওঁর বেডরুমেও আমাদের বেশ কিছু ছবি রয়েছে। স্মৃতি হিসাবে। কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আমি ওঁর হাতে উপহার দিলাম। সে কী হাসি। অমলিন। সেই অমলিন স্মৃতি নিয়েই থাকব আমি। আমরা। এই ৭৬ বছর বয়সেও।
[আরও পড়ুন: ‘আল্লাহ তেরো নাম, ঈশ্বর তেরো নাম’, লতার শেষযাত্রায় শাহরুখের প্রার্থনায় ফুটে উঠল আসল ভারত ]