সুতীর্থ চক্রবর্তী: সোনার বাংলা গড়ার স্লোগান রাজ্যে নতুন নয়। ১৯৮৭ সালে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় রাজীব গান্ধী যে সোনার বাংলা গড়ার স্লোগান দিয়েছিলেন, সেটা বিলক্ষণ মনে রয়েছে। জবাবে সিপিএম বলেছিল, ‘দিল্লি আগে সামলা, পড়ে গড়বি বাংলা।’ ৩৪ বছর পর রাজ্যে একই ধরনের রাজনৈতিক তরজা দেখা যাচ্ছে। ব্রিগেডে তাঁর দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই তরজাকে আরও কিছুটা এগিয়ে দিয়েছেন। মোদি বলেছেন, “স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরে বাংলা থেকে যা যা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা ফেরত দেওয়া হবে।”
[আরও পড়ুন: তারকার সন্তান বলেই পদবির বোঝা কেন বইতে হবে অর্জুন তেণ্ডুলকরকে?]
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মোদির মন্তব্য আগামিদিনে বহু বিতর্ক উসকে দেবে। মোদির মন্তব্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মনে সাংবাদিক রণজিৎ রায়ের ‘দ্য অ্যাগনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ গ্রন্থটির কথা উদয় হয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি গোটা দেশে তোলপাড় ফেলেছিল। স্বাধীনতার পর ২৫ বছরে কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ দেশের একটি এগিয়ে থাকা রাজ্য থেকে পিছিয়ে পড়া রাজ্যে চলে গিয়েছিল, সেই যন্ত্রণা লিপিবদ্ধ হয়েছিল ওই গ্রন্থে। ‘দ্য অ্যাগনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ লিপিবদ্ধ করেছিল কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্পদ, মূলধন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল আড়াই দশক ধরে। মোদি যখন ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে বলেন, “স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে যা যা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা ফেরত দেওয়া হবে।”– তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘দ্য অ্যাগনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর স্মৃতি ফেরত আসে।
পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনার যন্ত্রণা আজও শেষ হয়নি। ‘দ্য অ্যাগনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ প্রকাশিত হওয়ার পর ৫০ বছর কেটে গিয়েছে, কিন্তু এখনও এই রাজ্যে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তার যন্ত্রণার আখ্যান একই রয়ে গিয়েছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে চলেছেন, কীভাবে রাজ্য বঞ্চিত তার প্রাপ্য করের ভাগ থেকে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা কীভাবে দিনের পর দিন বকেয়া থেকে যায়, তা নিয়েও বহুবার সরব হয়েছেন তিনি, ঠিক তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই।
মোদি যখন বলছেন, ৭৫ বছরে রাজ্য থেকে যা যা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা ফিরিয়ে দেবেন, তখন তিনি কী কী ফেরাবেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। বস্তুত, এ রাজ্য থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। ব্রিটিশ বণিকদের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হওয়ার আগে থেকেই তো বাংলায় শুরু হয়েছিল লুটতরাজ। সিল্কের পোশাক, অলংকার শিল্প ও বিভিন্নরকম কুটিরশিল্প, মশলা– একদিন যে বাংলার অর্থনীতিকে এশিয়ার এই অঞ্চলে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী করেছিল, ব্রিটিশরা আসার পর সেই বাংলার দ্রুত পিছিয়ে পড়া শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ভারত থেকে যে কাঁচামাল লুট করেছিল একসময়, তার মূল উৎস তো ছিল এই বাংলাই। ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের পর যে বি-শিল্পকরণ শুরু হয়েছিল, তারও মূল ক্ষেত্র ছিল এই বাংলা।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, স্বাধীনতার পরেও বাংলার এই বঞ্চনার পরিসমাপ্তি ঘটেনি। ১৯৪৭ সালে দেশের মোট আয়ে বাংলার অবদান ছিল দ্বিতীয়। স্বাধীনতার পর যত সময় এগিয়েছে, তত অবনমন ঘটেছে বাংলার। পূর্ব ভারতের বাংলার সবচেয়ে বড় বঞ্চনার জায়গা ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের মাশুল সমীকরণ নীতি। বাংলায় কাঁচামালের যে বাড়তি সুবিধা ছিল, মাশুল সমীকরণ নীতি তা ছিনিয়ে নিয়েছিল। কেন্দ্রের এটা ছিল এক অদ্ভুত নীতি। গোটা দেশে শিল্পায়নের জন্য বলা হল, সব রাজ্যে সমান দামে মিলবে পূর্ব ভারতের খনিজ সম্পদ। দূরবর্তী রাজ্যগুলিতে এই খনিজ পদার্থ পরিবহণের খরচ বাবদ ভরতুকি দেবে কেন্দ্র। মাশুল সমীকরণ নীতির পরিণতি হল, পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্প উঠে গিয়ে স্থাপিত হল পশ্চিম ভারতের উপকূল অঞ্চলে। যেখানে বন্দরের সুবিধা আছে, উৎপাদিত শিল্পপণ্য যে অঞ্চল থেকে সহজে বাজারে নিয়ে যাওয়া যায়।
এই মাশুল সমীকরণ নীতির বিরুদ্ধে একসময় দীর্ঘ আন্দোলন দেখেছে রাজ্য। ১৯৯৩ সালে যখন কেন্দ্র এই মাশুল সমীকরণ নীতি প্রত্যাহার করল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ততদিনে বহু শিল্প চলে গিয়েছে রাজ্যের বাইরে। সহজলভ্য কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের জন্য যে শিল্প রাজ্যে আসতে পারত, তা আসেনি। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে মোদি কীভাবে সেই শিল্পকে রাজ্যে ফিরিয়ে দেবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। শিল্পস্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলার যে সুবিধা ছিল, তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই ছিনিয়ে নেওয়া সুবিধা কি এতদিন বাদে ফিরিয়ে দেওয়া যায়?
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে ছিল লাইসেন্স-পারমিট রাজ। শিল্পপতিদের লাইসেন্স দিলে তবেই তারা শিল্প করতে পারতেন। হলদিয়া পেট্রোকেম স্থাপনের স্মৃতি হয়তো অনেকের খেয়াল রয়েছে। জ্যোতি বসুর আমলে কিছুতেই এই পেট্রোকেম শিল্পের লাইসেন্স মিলছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বসু ’৮৭ সালের ভোটের আগে রাজীব গান্ধীর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করেছিলেন। স্বাধীনতার পর কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, বাংলা তো শিল্পে অনেক এগিয়ে। ফলে বাংলায় কেন শিল্পের লাইসেন্স প্রয়োজন? লাইসেন্স-পারমিট না পেতে পেতে বাংলা অনেক পিছিয়ে গিয়েছে। ’৯১ সালে নরসিমা রাও-মনমোহন সিং দেশের অর্থনীতিকে বিশ্বের দরবারে খুলে দিলেন। অবসান ঘটল লাইসেন্স-পারমিট রাজের। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বাংলার গায়ে ততদিনে তকমা লেগে গিয়েছে, এই রাজ্য শিল্পে অনুন্নত। বিনিয়োগ বিনিয়োগকে আকর্ষণ করে। এটাই অর্থনীতির নিয়ম। বাংলায় যেহেতু কেন্দ্রের নীতির ফলে দীর্ঘদিন বেসরকারি লগ্নি আসেনি, তাই দেশের অর্থনীতি উদার হওয়ার পরও বাংলা লগ্নি আকর্ষণ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর দেশে যে অঞ্চলে সরকারি নীতির সুবাদে বেশি লগ্নি গিয়েছে, তারাই উদারীকরণের পরও বেশি লগ্নি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। উপরন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও বাংলা থেকে যে আমানত সংগ্রহ করেছে, তা লগ্নি করেনি। বাংলা থেকে সংগৃহীত আমানতের ৫০-৬০ শতাংশ ব্যাংক বাংলায় লগ্নি করেছে। বাকিটা অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়েছে। অথচ তামিলনাড়ুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সংগৃহীত আমানতের চেয়ে বেশি টাকা লগ্নি করে থাকে। প্রশ্ন হল, এতদিন বাদে মোদি কীভাবে বাংলার সেই ছিনিয়ে নেওয়া লগ্নিকে ফেরাবেন?
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লাগাতার আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ রাজ্যের। দেশভাগের যন্ত্রণা পাঞ্জাবের সঙ্গে সমানভাবে ভোগ করেছিল বাংলা। কিন্তু, দিল্লির কাছ থেকে পাঞ্জাব যা আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছিল, বাংলার ভাগ্যে তার সিকিভাগও জোটেনি। এই ইতিহাস সবার জানা। পাঞ্জাব পেয়েছিল ভাকরা-নাঙ্গালের মতো প্রকল্প। বাংলা পেয়েছিল দণ্ডকারণ্য। আর্থিক বঞ্চনার এই ইতিহাস ক্রমশই দীর্ঘ হয়েছে। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কাছে আরজি জানিয়েছিলেন, বাম আমলে তৈরি হওয়া পাহাড়প্রমাণ ঋণের সুদ থেকে তাঁর সরকারকে কয়েক বছরের মুক্তি দিতে। যাতে তিনি রাজ্যের নিজস্ব আয়ের টাকায় পরিকাঠামো ক্ষেত্রে দ্রুত অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার কাজ সেরে ফেলতে পারেন। বেশ কয়েক বছর ধরে আরজি জানানোর পরেও কেন্দ্রের তরফে কোনও সাড়া পাননি মমতাও। কেন্দ্রের এই দীর্ঘ বঞ্চনা বা ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণ তো বাংলার কাছ থেকে ৭৫ বছরে অনেক কিছুই ছিনিয়ে নিয়েছে। মোদি সেগুলি কীভাবে ফেরাবেন?
ব্রিগেডে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই এই বিতর্কগুলোকে আগামিদিনে আরও প্রবলভাবে সামনে নিয়ে আসবে। রাজ্যের ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদের যদি হিসাব কষতে হয়, তাহলে সেটা যে অঙ্কে গিয়ে দাঁড়াবে, তা তো ফিরিয়ে দেওয়া কেন্দ্রের পক্ষে সবসময়ই অসম্ভব। তাহলে ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া বলতে কী বোঝাতে চাইলেন মোদি। কেন্দ্রের কিছু দপ্তর ৭৫ বছরে স্থানান্তর হয়ে গিয়েছে দিল্লিতে বা অন্যত্র। সেগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা কি বোঝাতে চাইলেন মোদি? না কি রাজ্যে যে বিপুল লগ্নি এই ৭৫ বছরে হতে পারত, তা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন তিনি? আশা করি এইসব প্রশ্নের উত্তর আগামিদিনে মিলবে।