‘বাল্য বিবাহ’ রুখতে, অসমে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দু’হাজার কিশোরকে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের সবার বয়স ২১-এর নিচে। কিন্তু, কেবল কিশোরদের গ্রেপ্তার করেই কি বাল্য বিবাহ রোধ সম্ভব? লিখেছেন সুমন সেনগুপ্ত
অসমের (Assam) সরকারি হাসপাতালে আতঙ্কের পরিস্থিতি। কিশোরী, যারা সন্তানসম্ভবা, তাদের নাম নথিভুক্ত করা হচ্ছে। তারপরে তাদের স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার (Himanta Biswa Sharma) নির্দেশে সেই রাজ্যে গত কিছুদিনে ‘বাল্য বিবাহ’ রুখতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দু’হাজার কিশোরকে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের সবার বয়স ২১-এর নিচে। অর্থাৎ আইনত, তারা ‘অপরাধী’। আইনের হাত থেকে অপরাধীর নিস্তার পাওয়া উচিত নয়। তবু কিছু প্রশ্ন উঠবে। কেননা, এই গ্রেপ্তারি এড়ানোর জন্য, কমবয়সি কিশোরীরা হয় নাম নথিভুক্ত করাচ্ছে না, নয়তো বাড়িতেই গর্ভপাত করে ফেলার বন্দোবস্ত করছে। এই গ্রেপ্তারি নিয়ে ইতিমধ্যেই অসম জুড়ে চর্চা শুরু হয়েছে। অলক্ষ্যে না-ঘটলেও, দেশের বহু রাজ্যেই এই ‘বাল্য বিবাহ’ দেখতে পাওয়া যাবে। একুশ শতকে, দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও বাল্য বিবাহের তরজা! তাহলে কি আমরা যে-তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি?
‘বাল্য বিবাহ’ নিয়ে কথা বলতে গেলে, রাজা রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়বে। সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ এবং বাল্য বিবাহ রোধে এই দুই মনীষীর লড়াই এখনও আমরা স্মরণ করি। একদিকে হিন্দু সমাজের মধ্যে যখন এই লড়াই চালাচ্ছিলেন বেঙ্গল রেনেসাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ব্যক্তিরা, তখন মুসলিম সমাজে এই লড়াই শুরু করেন বেগম রোকেয়া। মুসলিম নারীদের মধ্যে কীভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটানো যায়, সেদিকে যেমন উদ্যোগী হয়েছিলেন, কীভাবে মুসলিম নারীদের বেশ কিছু প্রচলিত ধর্মীয় নিয়মকানুন থেকে বের করে আনা যায়, সেসব নিয়েও কাজ করেছিলেন। সেই সময়ের এই সমস্ত মনীষীর অদম্য প্রচেষ্টার ফলে বন্ধ হয়েছিল বেশ কিছু মধ্যযুগীয় কুপ্রথা।
[আরও পড়ুন: ‘যে কোনও অধিনায়কই ওকে দলে নিতে মরিয়া’, ভারতীয় ক্রিকেটারের প্রশংসায় পাক তারকা]
কথা হল, কেন দেশের একটি অঙ্গরাজ্যেই এই সমস্যা নিয়ে সেই রাজ্যের সরকার এত চিন্তিত হয়ে গ্রেপ্তার করছে কিশোরদের? তথ্য বলছে, দেশের মধ্যে ‘মেটারনাল মর্টালিটি রেট’, অর্থাৎ মায়েদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি অসমে। যদিও গত পাঁচ বছরে, শিশুমৃত্যু কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-এ শিশুমৃত্যুর হার দেখাচ্ছে, ১০০০-এর মধ্যে ৩১টি শিশু মারা যায় শুধুমাত্র অসমেই। এই রিপোর্টেও উল্লিখিত, দেশজুড়ে যেখানে প্রায় ২৫ শতাংশ মহিলার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কেবলমাত্র অসমে এই হার ৩২ শতাংশ। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সমস্যা অনেক গভীরে।
কোভিডের সময় ও তারপরও দেশের বিপুল অংশের মানুষ কাজ হারিয়েছে। অসমে এই সংখ্যা অনেক বেশি। তার সঙ্গে, মাথার উপর বেনাগরিক হওয়ার খঁাড়া, তথা ‘এনআরসি’। ইতিমধ্যেই ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। যাদের নাম বাদ পড়েছে, তারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, আইন-কানুনের মারপ্যঁাচ সামলাতে সামলাতে। এমন পরিস্থিতিতে, অভাবে আরওই মধ্যযুগীয় মানসিকতা বেরিয়ে আসছে দঁাত-নখ নিয়ে। বেশিরভাগ পীড়িত পরিবারের মানুষ কন্যাসন্তানকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াতে আগ্রহী হচ্ছে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব, কন্যাসন্তানের দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে তারা তৎপর। ফলে, অসমে ‘বাল্য বিবাহ’ বিষয়টি আর সামাজিক নয়, একইসঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা হয়েও দঁাড়িয়েছে। কিন্তু অসমের মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে নাবালিকা বিয়ে করার জন্য, কিশোরদের বিরুদ্ধে ‘পক্সো’-সহ অন্যান্য ধারা প্রয়োগ করছেন, যেভাবে ‘প্রহিবিশন অফ চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট’ দিয়ে ওই কিশোরদের হেনস্তা করছেন, তাতে কি এই সমস্যার সমাধান হবে?
[আরও পড়ুন: মুদ্রাস্ফীতির ছোবল! পাকিস্তানে অবিশ্বাস্য দরে বিকোচ্ছে দুধ, মুরগি, নাজেহাল আমজনতা]
যেখানে এখনও দারিদ্র প্রলয়ংকরী রূপ নিয়ে বিদ্যমান, যেখানে মহিলাদের সচেতনতা এবং শিক্ষার হার কম, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাই এখনও বহু মানুষের কাছে পৌঁছয়নি, সেখানে এই ধরনের অপরাধে যদি কিছু কিশোরকে গ্রেপ্তার করে, তাদের ‘ক্রিমিনাল’ বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান হতে পারে না বলেই তো মনে হয়। অসমের ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের পরিচালক দলের কাছে কোনও কিছু উৎপাটন করার প্রক্রিয়াই যে ‘বুলডোজার’ সংস্কৃতি, তা এতদিনে জানা গিয়েছে। কিন্তু, অপরাধীকে দুরমুশ করে অপরাধ কি কমে? তথ্য বলছে, প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যের মাপকাঠিতেও অসমের স্থান, জাতীয় গড়ের পিছনে। নারীর উন্নয়নেও তথৈবচ। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের এক-পঞ্চমাংশ আজ অবধি স্কুলে যায়নি। অসমে ৩০ শতাংশেরও কম এই বয়সি মহিলারা দশম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেছে। যেখানে কিনা জাতীয় গড় এক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ। ফলে রাজ্যের কর্মক্ষম মানুষের মধ্যেও মহিলাদের সংখ্যা তুমুল কম। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যের রিপোর্ট বলছে, অ-কৃষি ক্ষেত্রে, যেখানে কর্মী হিসাবে পুরুষদের পরিসংখ্যান ৫৩ শতাংশ, সেখানে মহিলাদের মাত্র ১৭। দেখা গিয়েছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি ২০ শতাংশ মহিলা স্কুলের মুখ না দেখেও সন্তানের জননী হয়ে গিয়েছে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, হিন্দুদের মধ্যে ‘বাল্য বিবাহ’-র হার মুসলিমদের থেকে বেশি! তাহলে কেন শুধু সংখ্যালঘুদের দিকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অনাধুনিকতার অভিযোগ তুলে ধরে দেশ-শাসনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল?
অথচ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তঁার ‘বেটি পড়াও বেটি বঁাচাও’ স্লোগান সামনে রেখে নিজের প্রচার করে চলেছেন। অসমে কি এই সংক্রান্ত প্রচার করা হয়নি? হয়েছে, কিন্তু তা জনগণের মর্মে প্রবেশ করানোর মতো তৎপরতা বা দায়িত্ববোধ আদৌ ছিল তো! ‘তিন তালাক আইন’ প্রথা বন্ধর জন্য আগে প্রয়োজন ছিল সামাজিক স্তরে সেই সমস্যা নিয়ে আলোচনা চালানো। তা না করে, পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবহার করে যদি ‘তিন তালাক’ বলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাওয়া কোনও মুসলিম পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাতে সমস্যার সমাধান হয় না।
অপরাধের খঁাড়া ঝুলিয়ে মনোবৃত্তির বদল ঘটানো যায় কি? কমবয়সি কিশোরদের গ্রেপ্তার করা ছাড়া বাল্য বিবাহর ধারণাকে উৎপাটিত করার বা মানুষের মধে্য বিজ্ঞানচেতনা তৈরি করার কোনও উদ্দেশ্য বা উদে্যাগ অসম সরকারের আদৌ আছে কি? এই গ্রেপ্তারি বরং সমস্যা আরও বাড়াবে হয়তো। যে-কিশোরদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেই পরিবারে সে-ই হয়তো একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি। কিশোরদের কেন রোজগারে লেগে পড়তে হচ্ছে, কেন শিক্ষার প্রসার ঘটছে না– সেটাও কি ভাবা উচিত নয়? বিয়ে তো পারিবারিকভাবে সংঘটিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে অপরাধে জড়িত তো আরও অনেকেই। এবং সেই কিশোরদের গ্রেপ্তার করার ফলে সংসারের হঁাড়ি যেহেতু উনুনে চাপছে না, অনেকের স্ত্রী স্থানীয় থানায় গিয়ে বিক্ষোভও দেখাচ্ছে তাদের স্বামীদের মুক্তির দাবিতে। যদিও অসমের মুখ্যমন্ত্রী অনড় তঁার সিদ্ধান্তে। রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে কি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা যেত না?