shono
Advertisement

শীতঘুমে কংগ্রেস, বিরোধী পরিসর দখলের দ্বৈরথে কি কেজরি-নীতীশ?

ঐকতান সৃষ্টির কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি বিরোধীদের মধ্যে।
Posted: 02:12 PM Aug 25, 2022Updated: 02:12 PM Aug 25, 2022

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলোর স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়া উচিত ছিল সমস্বরে একজোট হওয়া। অথচ, এতদিন ধরে প্রতিবাদের সেই ঐকতান সৃষ্টির কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না। একে-অন্যের পাশে দাঁড়ানো, সহমর্মিতা প্রকাশ, তা-ও অদৃশ্য। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, শিব সেনা, সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি বা বামপন্থীরা প্রত্যেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে দোসরহীন। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

ভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানটুকু পর্যন্ত লোপ পেল বলে মনে হচ্ছে। নইলে দিল্লি সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া-সহ অন্যদের বিরুদ্ধে সিবিআই তল্লাশি নিয়ে এমন আত্মঘাতী গোল তারা করত না। সিবিআই আগ্রাসনের প্রতি কংগ্রেসের এই অপ্রত্যাশিত সিলমোহরে বিজেপি উৎফুল্ল। কারণ, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলায় সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে ইডি-র ম্যারাথন জেরাও যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা ‘যথার্থ’ প্রতিপন্ন করছে। ভোট যত এগবে, ইডি-সিবিআইকে খ্যাপা কুকুরের মতো লেলিয়ে বিজেপির ‘দুর্নীতি-দমন অভিযান’ লাগামছাড়া হয়ে উঠবে।

স্রেফ দলীয় রাজনীতির জন্যই যে দুর্নীতি রোধে বিজেপির এইসব ‘অভিযান’, এখন আর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দল হিসাবে তারা গঙ্গার পবিত্রতার সঙ্গে তুলনীয়! বলা হচ্ছে, বিজেপি নামক ‘পুণ্য প্রবাহ’-এ অবগাহন করলেই পাপী-তাপী সবাই শুদ্ধ। অনেকে ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর তুলনা টানছে। একবার ঢুকলেই ময়লা সাফ।

এসব রাজনৈতিক প্রচার যে অস্বাভাবিক নয়, দিন দিন তা প্রকটতর হচ্ছে। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে কাউকে পরোয়া না করে এই দল বিরোধীদের সিঁটিয়ে রেখেছে তদন্ত-তল্লাশির জুজু দেখিয়ে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রবণতা হওয়া উচিত ছিল একই জ্বালায় জ্বলা সবার একজোট হওয়া। সমস্বরে মুখর হওয়া। একে-অন্যের পাশে দাঁড়ানো। অথচ, এতদিন ধরে প্রতিবাদের সেই ঐক‌তান সৃষ্টির কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না। একে-অন্যের পাশে দাঁড়ানো, সহমর্মিতা প্রকাশ, তা-ও অদৃশ্য। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, শিব সেনা, সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি বা বামপন্থীরা প্রত্যেকেই যেন এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বিনয় মজুমদারে আশ্রয় নিয়ে ভাবি, এরা সবাই ‘যে যার ভূমিতে দূরে দূরে চিরকাল থেকে’ কোনও একদিন ‘মিলনের শ্বাসরোধী কথা’ ভাবার অবস্থাতে আদৌ পৌঁছবে কি না। সময় কিন্তু বয়ে চলেছে।

[আরও পড়ুন: জয় ইউনেস্কোর জয়, বাংলায় যা পুজো হয়, দেশের কোথাও হয় না]

‘আম আদমি পার্টি’ (আপ)-র নেতাদের উপর বিজেপির রোষ নিয়ে কংগ্রেস চুপ থাকলেও অন্যরকম হত। কিন্তু তা না করে তারা এই তল্লাশি অভিযান ও তদন্তের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে বসল। পরে, বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে দেখে কিছুটা মেরামতের চেষ্টা করেছে কোর্টের তদারকিতে তদন্তের দাবি তুলে। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। মেরামতের সুযোগও অন্তর্হিত। নিতান্ত ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া এই আচরণের অন্য কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে না।

আপ-এর উপর কংগ্রেসের রাগের প্রধান কারণ পাঞ্জাবে তাদের বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ায়। নিজের অগোছালো চরিত্র ও অদূরদর্শিতার দিকে আলো না ফেলে আপ-কে তারা ‘নন্দ ঘোষ’ করতে চেয়েছে। গোয়াতেও তাই। ওদের ধারণা, কংগ্রেসের বিরোধিতা করে বিজেপিকে (BJP) ফের ক্ষমতাসীন হতে আপ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। একই লক্ষ্যে আপ কোমর কষেছে গুজরাটে, হিমাচল প্রদেশে। কংগ্রেসের আলগা পরিসর দখল করতে তারা মরিয়া। কংগ্রেস তাই মনে করছে, আপ কোণঠাসা হলে তাদের সুবিধে। তালপুকুরে ঘটি না ডোবা হাল আড়াল করার এ এক বৃথা চেষ্টা।

একই কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিও কংগ্রেস ক্ষুব্ধ। উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও গোয়ায় তারা যেটুকু ভোট কেটেছে, তা কংগ্রেসেরই। বিরোধী ঐক্য স্থাপনে কংগ্রেসের কোনও উদ্যোগও তারা মানছে না। নেতৃত্ব তো নয়ই। মুখে না বললেও, কংগ্রেসের একাংশের দৃঢ় বিশ্বাস, আপ ও তৃণমূল কংগ্রেস দুই দলই বিজেপির হয়ে ‘প্রক্সি’ দিচ্ছে।

কংগ্রেসের অভিমানের কোনও কারণ একেবারেই নেই, সে-কথা বলাও হবে সত্যের অপলাপ। রাহুল ও সোনিয়াকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরার বিরুদ্ধে আপ একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। তৃণমূল কংগ্রেস-সহ অন্য বিরোধীদের আচরণও তথৈবচ। এই ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’ অবস্থা থেকে বিরোধীদের বের করতে যে-উদ্যোগ নেওয়া দরকার, দুঃখের বিষয়, কারও মধ্যে এখনও সেই গরজ দেখা যাচ্ছে না। এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি- অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা চন্দ্রশেখর রাও কংগ্রেসকে বাইরে রেখে বিরোধী ঐক্যের গণ্ডি কেটে নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক। ফলে, লড়াই সবাইকে একা-একাই করতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, মহারাষ্ট্রে শিব সেনা-এনসিপি, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, ঝাড়খণ্ডে জেএমএম, রাজস্থানে কংগ্রেস অথবা দিল্লিতে আপ- ইডি-সিবিআইয়ের মোকাবিলায় সবাই দোসরহীন। বিজেপির নবতম টার্গেট বিহারের তেজস্বী। তাঁকে লেজে-গোবরে করতে ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে। আপ-পর্ব শেষে ওটাই পরবর্তী আকর্ষণ।

তিক্ততা যেভাবে বেড়েছে, তাতে আপ-বিজেপি ‘শ্যাডো বক্সিং’ তত্ত্ব একটু বাড়াবাড়ি রকমের সরলীকরণ মনে হওয়া অসংগত নয়। বরং এমন মনে হওয়াই সংগত যে, পাঞ্জাব দখলের পর আপ-কে বিজেপি যথেষ্ট সমীহ করছে। করছে বলেই দিল্লি পুরসভার ভোট শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়েছে। তিন পুরসভা ভেঙে ফের এক পুরসভায় ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গুজরাট পুরভোটে বিজেপির গড় সুরাতে আপ সাড়া ফেলায় বিজেপির চিন্তা বেড়েছে। গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের কাছে গ্রামীণ গুজরাট হারিয়েও শহুরে ভোটে বিজেপি কিস্তি মাত করেছিল। এখন সেসব শহরে আপ-এর প্রভাব বিস্তারে তারা শঙ্কায়। যে-যুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী বেসরকারিকরণের দিকে দ্রুত ধাবমান, সেই যুক্তিতেই দিল্লির আবগারি নীতি থেকে সরকার হাত তুলে নিয়েছিল।

মদ ব্যবসায় এক ফুরফুরে ভাব এনে দিতে পেরেছিল তারা। বাজারের নিয়ম মেনে শুরু হয়েছিল প্রতিযোগিতা। মদ ব্যবসার চিরকালীন বিবর্ণ ক্যানভাস বদলে তারা তাকে ঝলমলে করেছিল। এখন দুর্নীতির অভিযোগের মোকাবিলা কীভাবে করে, সেটা দেখার। ৩১টি জায়গায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে সিবিআই এখনও এমন কিছু উদ্ধারের দাবি করেনি, যা পশ্চিমবঙ্গের অপা বা কেষ্ট কাণ্ডের মতো তাক লাগানো। বরং, গ্রেপ্তারের তোয়াক্কা না করে সিসোদিয়াকে সঙ্গী করে কেজরিওয়াল গুজরাট সফরে গিয়ে মোদিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর হিম্মত দেখিয়েছেন।

এইভাবে, এবং অবশ্যই কংগ্রেসের দোদুল্যমানতার সুযোগে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেকে মোদির চ্যালেঞ্জার হিসাবে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে দেশকে নেতৃত্ব-দানের প্রশ্নে নিজের অভীপ্সার কথাটিও জানিয়ে দিয়েছেন। মোদির ঢঙে শুরু করেছেন ‘মেক ইন্ডিয়া নাম্বার ওয়ান’ প্রচারাভিযান। সেই সঙ্গে জোরালো দাবি- বিজেপি ভয় পেয়েছে বলেই আবগারি নীতির তদন্ত। কেজরিওয়ালের ‘দিল্লি মডেল’ বিদেশেও বহুচর্চিত। দিল্লিবাসী হওয়ার সুবাদে বলতে পারি, প্রশংসিতও। সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল বিলকুল বদলে গিয়েছে।

‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তারই স্বীকৃতি। বিজেপির তা পছন্দ না-হওয়ারই কথা। তাই ‘পেড নিউজ’-এর হাস্যকর অভিযোগ। দিল্লি মডেলের ব্যাখ্যায় সিঙ্গাপুর যেতে কেন্দ্রীয় অনুমতি পাননি কেজরিওয়াল। এসব নার্ভাসনেসেরই লক্ষণ। জনমন জয়ে মুফ্‌তে বহু কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধের তাগিদ অর্থনীতিতে যতই যুক্তিপূর্ণ হোক, কেজরিওয়াল তাতে বৈধতার রং চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘বন্ধুবাদ’-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। হিসাব কষে দেখাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর শিল্পবন্ধুদের যত ঋণ মাপ হয়েছে, দরিদ্রর জন্য বিজলি, পানি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ভরতুকি সেই তুলনায় নস্যি। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হলে এই খয়রাতি চালু রাখবেন। স্পষ্টতই, জনপ্রিয় নরেন্দ্র মোদির পদাঙ্ক কেজরিওয়ালও অনুসরণ করছেন।

কংগ্রেস (Congress) এখনও শীতঘুমে। জড়তা আদৌ কাটবে কি না, অজানা। মমতা হোঁচট খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে। বছর ঘুরলে ভোট, তাই চন্দ্রশেখর রাওকে বিজেপি তাঁর খাসতালুক তেলেঙ্গানায় বন্দি করেছে। নীতীশ কুমার এখনও খোলস ছাড়েননি। এই সুযোগে কেজরিওয়াল নিজেকে চ্যালেঞ্জারের ভূমিকায় তুলে ধরতে সচেষ্ট। আগামী দিনে বিরোধী পরিসর দখলের দ্বৈরথে কি তবে কেজরিওয়াল ও নীতীশ কুমার?

[আরও পড়ুন: মোদির লালকেল্লার ভাষণ ও ভাগবতের ‘অখণ্ড ভারত’ ভাবনার মিল কোথায়?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement