সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা কোনও নতুন কথা নয়। ক্ষমতাবানেরা বরাবরই নিজেদের 'অপকর্ম' ঢাকতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তবু এক অমোঘ জলছবির মতো সভ্যতার বুকে জেগে থাকে হারানো ইতিবৃত্ত। তেমনই এক ইতিহাস লাওসের। গত শতকের ছয়ের দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধ আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের 'প্রতিদ্বন্দ্বী' সিনেমার সিদ্ধার্থ ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের যে সাহসী লড়াইকে মানুষের চন্দ্রাবতরণের চেয়েও এগিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের পাশাপাশি লাওসও যে প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, আজও যে সেই ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয় সেটা যেন এক নীরব ইতিহাস। কিন্তু নীরব হলেও সেই ইতিহাস মুছে যায়নি। সম্প্রতি সেদেশে গিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। আর নতুন করে উড়তে শুরু করেছে সেই ইতিহাসের পাতা।
অস্টিনের লাওস সফরকে 'ঐতিহাসিক' বলেই মনে করছেন ইতিহাসবিদরা। কেননা এই প্রথম কোনও মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব সেদেশে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য একেবারেই কূটনৈতিক। দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধতাকে মজবুত করতেই অস্টিনের এই সফর। তিনি এখান থেকে যাবেন অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স ও ফিজিতে। তবে এরই ফাঁকে 'অফিশিয়াল এজেন্ডা' না হওয়া সত্ত্বেও নাকি তাঁর মুখে উঠে এসেছে 'অপারেশন ব্যারেল রোল'-এর কথা। সূত্রের দাবি তেমনই। লাওসের আধুনিক ইতিহাসের সেই অন্ধকারে মোড়া ইতিহাসের পাতা খোদ মার্কিন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তির হাতে উলটে যাওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলাই যায়। কেননা আদপে বরাবরই আমেরিকা চেপে যেতে চেয়েছে এই 'সিক্রেট ওয়ার'কে। এখানে নিহত ১৩ মার্কিন আধিকারিকের দেহও উদ্ধার করা হয়নি এখনও। কেননা মার্কিন বিমানের বীভৎস বিধ্বংসী হামলায় কার্যতই সেই সময় চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় লাওস। এবছরের আগস্টে উদ্ধার করা হয়েছে ডেভিস এস প্রাইসের মরদেহ। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর।
কিন্তু কেন এই 'সিক্রেট ওয়ার' হয়েছিল? আমেরিকার লড়াই তো ছিল ভিয়েতনামের সঙ্গে। আর লাওস ছিল ঘোষিত ভাবেই এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ! আসলে লাওসের ভূমি ব্যবহার করেই উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা অস্ত্র সরবরাহ করছিল। সেই রুটটাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল আমেরিকা। মার্কিন বোমারু বিমানকে লাওস ও ভিয়েতনামে হামলার পথ দেখাতে লাওসে ঘাঁটিও গেড়েছিল সিআইএ। কিন্তু সেই রাডার স্টেশন দখল করে ফেলেন ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা। সংঘর্ষে মারা যাম ৪২ জন থাই ও মং উপজাতির যোদ্ধা। প্রাণ হারান ১৩ জন মার্কিন আধিকারিকরা। প্রমাদ গোনে আমেরিকা। তাদের লক্ষ্যই ছিল এখানে আমেরিকার অস্তিত্বের সব চিহ্ন মুছে দেওয়া। কেননা 'সিক্রেট ওয়ারে'র গোপন কথাটি যে গোপনই রাখতে হবে। ফলে বোমা ফেলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেই ঘাঁটিও। যার ফলে সেখানে থেকে যাওয়া স্বদেশীয় আধিকারিকদের উদ্ধারকাজও সম্ভব হয়নি এতকাল।
লাওসে আমেরিকা যে হামলা চালিয়েছিল দীর্ঘ ৯ বছর ধরে তা সত্যিই বীভৎস। সব মিলিয়ে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তারা ফেলেছিল ২৬০ মিলিয়ন বোমা! 'অপারেশন ব্যারেল রোল'-এর সময় যা বোমা ফেলা হয়েছিল তা হিসেব করলে দাঁড়ায় ২৪ ঘণ্টার হিসেবে প্রতি আট মিনিটে একটি বোমা! আর সেই বোমায় সব ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার পরও প্রায় ৩০ শতাংশ ক্লাস্টার বোমা রয়ে গিয়েছে লাওসের মাটিতে। অনেক সময় বাচ্চারা খেলনা ভেবে সেই বোমা ধরে ফেলে। আর বিস্ফোরণে মারা যায়। কেবল শিশুরাই নয়, সব মিলিয়ে ১৯৬৪ সাল থেকে ধরলে ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন ওই বোমায়। যাঁদের মধ্যে ২০ হাজারের মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৫ সালে যুদ্ধ একেবারে থেমে যাওয়ার পর! এখনও সেদেশে রয়েছে বহু পুকুর বা জলাশয়। যা আসলে 'বম্ব ক্রেটার' অর্থাৎ বোমা পড়ার ফলে সৃষ্টি হওয়া অতিকায় গর্ত। পাখির চোখে দেখলে মনে হয় লাওসের মাটির বুকে জেগে থাকা ইতিহাসের দগদগে ক্ষত যেন!
এতদিন পরে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের লাওস সফর এবং কোনওভাবে তাঁর মুখে 'অপারেশন ব্যারেল রোল'-এর প্রসঙ্গ উঠে আসার পর প্রশ্ন উঠছে, তবে কি এবার আমেরিকা স্বীকার করবে সেই সময় তারা এখানে কী কাণ্ড ঘটিয়েছিল! ইতিহাসকে মোছা যায় না। তা কেবল সাময়িক ভাবে লুকিয়ে রাখা যায়। তার পর একসময় তা ফুটে ওঠেই সভ্যতার বুকে। লয়েড অস্টিনের সাম্প্রতিক সফর সেই কথাই যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে।