জাকির নায়েককে আমি চিনতাম না৷ কস্মিনকালেও তাঁর নাম শুনেছি কিংবা কাগজে তাঁর সম্পর্কে কিছু পড়েছি বলে মনে পড়ছে না৷ পড়লেও মনে নেই৷ আমারই মতো আরও অনেকের কাছেই এই সেদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন অজানা-অচেনা অজ্ঞাতকুলশীল এক মানুষ৷ আজ আচমকাই বিশ্বজোড়া তাঁর উপস্থিতি৷ কাগজ ছয়লাপ তাঁর ছবি ও খবরে৷ কারও কাছে তিনি চলমান বিভীষিকা, কারও কাছে শান্তির প্রচারক!
ভদ্রলোকের বয়স মাত্র একান্ন৷ মুম্বইয়ে জন্ম৷ ডাক্তারি পাস করে প্র্যাকটিসও করেছেন বহুদিন৷ তারপর একদিন একটি স্কুল খোলেন৷ মুম্বইতেই৷ ইসলামিক ইণ্টারন্যাশনাল স্কুল৷ পাশাপাশি ‘ইউনাইটেড ইসলামিক এড’ নামে এক সংস্থাও৷ এই সংস্থা দরিদ্র মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ দেয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য৷ এইভাবে বাড়তে বাড়তে তিনি খোলেন আর এক সংস্থা, ‘ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন’৷ ‘এনজিও’ শব্দটি আজ অনেককাল ধরেই বাংলা হয়ে গেছে৷ ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনও ওই এনজিও৷
এখানেই থেমে থাকেননি জাকির নায়েক৷ খুলে ফেলেন আস্ত একটা টেলিভিশন চ্যানেল৷ ‘পিস টিভি’৷ সংযুক্ত আরব আমিরশাহী থেকে এই চ্যানেল ‘আপলিঙ্ক’ করা হয়৷ পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই যেখানে এর ‘ফুটপ্রিণ্ট’ পড়ে না৷ বাংলা ও উর্দু ভাষাতেও এই চ্যানেল চালু আছে৷ সম্প্রতি চিনা ভাষাতেও শুরু হয়েছে সম্প্রচার৷
জাকির নায়েক এতই জনপ্রিয় যে দেশ-বিদেশ থেকে অনবরত তাঁর ডাক পড়ে৷ তাঁর বক্তৃতা, ধর্ম নিয়ে আলোচনা লোকে নাকি হাঁ করে শোনে৷ মানুষকে তিনি নাকি নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে আসছেন৷ ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই অর্থেই৷ নেতিবাচক না-ই যদি হবে তা হলে ব্রিটেন বা কানাডায় তিনি ও তাঁর ভাষণ নিষিদ্ধ কেন? এমনকী, মহারাষ্ট্রেও ২০১৩ সালের পর প্রকাশ্যে তিনি কোনও ভাষণ দেননি৷ এখন শোনা যাচ্ছে, সরকার নাকি বারণ করে দিয়েছে৷
জাকির নায়েক সম্বন্ধে এখন এতকিছু জানা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ‘পশ’ এলাকার আপমার্কেট রেস্তোরাঁয় ইসলামি জঙ্গিহানার ঘটনাটা ঘটল বলে৷ যে-জঙ্গিরা ওই কাণ্ডটা ঘটাল, তাদের একজনের জীবন নাকি জাকির নায়েকের ভাষণ বদলে দিয়েছিল৷ সেই ছেলেটির বন্ধু, তার ফেসবুক অ্যাকাউণ্ট ও পরিবারের লোকজনেরা এই কথা জানিয়েছেন৷ বলেছেন, জাকির নায়েকের ধর্মীয় প্রবচন ও ইসলামের ব্যাখ্যা ছেলেটিকে বিলকুল বদলে দেয়৷ ওই কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকেই দেশে ও বিদেশে বহু মানুষ ‘পিস টিভি’র সম্প্রচার ও জাকির নায়েকের লেখা বই ও ভাষণের সিডি নিয়ে মারাত্মক সব প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন৷ প্রশ্ন উঠছে তাঁর ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চরিত্র নিয়েও৷ তাঁর এনজিও কোন কোন দেশ থেকে অর্থসাহায্য পায়, কীভাবে সেই টাকা খরচ হয়, এসব এখন সরকারি গোয়েন্দাদের তদন্তের বিষয়৷
বাংলাদেশ সরকার ‘পিস টিভি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে৷ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বসে নেই৷ সরকারের বড় বড় মাথা বৈঠক করেছেন৷ তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু বলেছেন, ‘পিস টিভি’ চালানোর কোনও লাইসেন্সই এ-দেশে নেই৷ ভারতে যেভাবে চলছে তা বেআইনি৷ টেলিভিশন চ্যানেলকে যাঁরা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন সেই ‘এমএসও’ এবং কেবল অপারেটরদের বলা হয়েছে তাঁরা যেন ‘পিস টিভি’ না দেখান৷ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে মোট ন’টি তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছে৷ তারা জাকির নায়েকের এক-একটি দিক খতিয়ে দেখবে৷ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর বক্তৃতার সিডি ও ক্যাসেট এবং ‘পিস টিভি’র সম্প্রচারের ছানবিন৷ শান্তির বাণী প্রচারের আড়ালে তিনি সন্ত্রাসী তৈরি করছেন কি না তা নিয়ে শুরুও হয়েছে বিতর্ক৷ দেশের নানা রাজ্য থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া যুবক-যুবতীদের খবর আসতে শুরু করেছে৷ তাদের কেউ কেউ ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ এর জেহাদি হয়ে গিয়েছে৷ কেউ নিহতও হয়েছে৷ এইসব পরিবারের লোকজন কেউ কেউ একথাও বলেছেন, তাদের ছেলেরা জাকির নায়েক দ্বারা উদ্বুদ্ধ৷ মোট কথা, এ দেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিমুখ এখন জাকির নায়েক৷
বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড যখন ঘটছে এবং জাকির নায়েক যখন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন, তখন এই ধর্মগুরু সৌদি আরবে৷ সেখান থেকে তিনি বলতে শুরু করেন, শান্তির বাণীই তিনি প্রচার করে আসছেন, সন্ত্রাসের নয়৷ তাঁর সমর্থনে মুসলিম দুনিয়ার অনেকেই এগিয়ে এসেছেন৷ আমাদের দেশেও তা দেখা গিয়েছে৷ জাকির নায়েক খুবই স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারতের তদন্তকারী দলের সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ সহযোগিতায় প্রস্তুত৷ গতকাল, মানে মঙ্গলবার, তাঁর মক্কা থেকে মুম্বই ফেরার কথা ছিল৷ মুম্বইয়ে ফিরে তিনি সংবাদ সম্মেলনও করবেন বলেছিলেন৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি তা বাতিল করলেন৷ ললিত মোদি ও বিজয় মালিয়ার মতো তিনিও জানিয়ে দিলেন, আপাতত দু’তিন সপ্তাহ তিনি দেশে ফিরছেন না৷ আফ্রিকা যাবেন৷ মিডিয়ায় তাঁর যে বিচার চলছে তা বন্ধ করার কথা বলে তিনি আবারও জানিয়েছেন, সরকারের সব তদন্তকারী দলের সঙ্গে সহযোগিতায় তিনি প্রস্তুত৷ ইসলামিক স্টেটের সমালোচনা করেও তিনি বলেছেন, ওটা ‘আন-ইসলামিক স্টেট’৷ কারণ, ওরা মানুষকে মারার কথা বলে৷
জাকির নায়েক নায়ক না খলনায়ক–সে বিষয়ে এখনও আমার কোনও মতামত নেই৷ না-থাকার একটা কারণ আমি আগেই বলেছি, ওঁকে এই ক’দিন আগেও চিনতাম না৷ কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি আরও জোরালো৷ একজন মানুষ দেশে বসে এনজিও চালাচ্ছেন, একের পর এক ভাষণ দিয়ে চলেছেন, তাঁর ভাষণের সিডি দেশে-বিদেশে দেদার বিকোচ্ছে, লাইসেন্স ছাড়া একটা টিভি চ্যানেল রমরম করে চলছে, সেই চ্যানেল খুলতে কোটি কোটি টাকার জোগান দিয়েছেন, বই লিখছেন ও বিক্রি করছেন, ঘরছাড়া ছেলে-মেয়েরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে হাসতে হাসতে ইসলামিক স্টেটের হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে, সরকার তা হলে এতদিন ধরে করছিলটা কী? দশ বছর ধরে জাকির নায়েকের যাবতীয় কাজকর্ম চলছে৷ মহারাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় সরকার কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল? সত্যপাল সিং উত্তরপ্রদেশের বাগপত কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে লোকসভায় জেতেন ২০১৪-র নির্বাচনে৷ তার আগের দু’বছর তিনি ছিলেন মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার৷ এই সেদিন তিনি বললেন, কমিশনার থাকাকালীন জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে তিনি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন৷ তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নাকি কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি৷ রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান কংগ্রেসের রহমান খানও নাকি তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মণীশ তিওয়ারিকে একটা চিঠি লিখে ‘পিস টিভি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন৷ কংগ্রেসি মণীশ নাকি কিছুই করেননি৷ প্রশ্ন হল, কংগ্রেস না হয় চুপ করে ছিল, এম.পি সত্যপাল সিং গত দু’বছর ধরে কেন চুপ ছিলেন? কিংবা মোদি সরকার? ঢাকার গুলশান-কাণ্ড না ঘটলে এগুলো হয়তো জানাও যেত না! বিভিন্ন সরকারি সূত্র থেকে এখন বলা হচ্ছে, জাকির নায়েক নাকি গত সাত বছরে তাঁর এনজিওকে দেওয়া ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান ‘পিস টিভি’তে সরিয়ে দিয়েছেন৷ অভিযোগ সত্যি হলে আমার প্রশ্ন, এতদিন সরকার কী করছিল? কোথায় ছিল আমাদের ইণ্টেলিজেন্স? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের এই যদি নমুনা হয় তা হলে ঈশ্বরের করুণার ওপর সবকিছু ছেড়ে আমাদের বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই৷
এই মুহূর্তে মহারাষ্ট্র, কেরল, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে শতাধিক যুবক ফেরার৷ জেহাদের টানে এরা ঘরছাড়া বলে এখন জানা যাচ্ছে৷ কেউ কেউ জেহাদের রকমফের দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশে ফিরে এসে ভুল বুঝতে পেরেছে, কেউ কেউ ফেরার আগ্রহ দেখিয়েছে৷ গুলশান-কাণ্ডের পর জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশেও জেহাদিদের জাল বিস্তৃত৷ জল এখনও বিপদসীমা ছাড়ায়নি ঠিকই, কিন্তু এমন গয়ংগচ্ছভাবে চললে আচমকাই একদিন দেখা যাবে জল নাকের ওপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে৷
অপরাধ প্রমাণ না-হওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে সবাই নির্দোষ৷ জাকির নায়েক শান্তির দূত না ঘোর অপরাধী তা বলার মতো সময় এখনও আসেনি৷ তদন্ত চলছে৷ তাই ইদ্রিশ আলিদের মতো রাজনীতিকদের জাকির নায়েকের হয়ে আগেভাগে ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট ইস্যু না করাই ভাল৷
মতামত লেখকের নিজস্ব
The post জাকির নায়েক ও কয়েকটি প্রশ্ন appeared first on Sangbad Pratidin.