প্রথম, দ্বিতীয় পেরিয়ে তৃতীয়বারও লোকসভা নির্বাচনে পরাজয় ঘটলে কংগ্রেসের কাছে তা বিপদের হয়ে উঠবে। গত এক দশকে, নড়ে গিয়েছে সেই বিশ্বাস যে, একমাত্র গান্ধীরাই কংগ্রেসকে একত্র করার আঠা। কংগ্রেসকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পার্টি কি এমন একটি পরিবারের উপর নির্ভর করতে পারে, যা আর ভোট টানতে পারে না? নাকি সে-সংযোগ শেষমেশ ছিন্ন করাই উচিত? লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই।
বিজেপির ‘কংগ্রেসময়’ দলে এবার নতুন কোন কংগ্রেসি মাথা গলাতে চলেছে?– এই আন্দাজ করাই দিল্লির ক্ষমতার দালানজুড়ে এখন হয়ে উঠেছে নতুন চু-কিতকিত খেলা। বিজেপির নেতৃত্ব যেখানে এই বছরের সাধারণ নির্বাচনে ৪০০ আসন পেরিয়ে যাওয়ার হুংকার ছাড়ছে, ল্যাকপ্যাকে কংগ্রেস দল সেখানে আরও বড় দ্বিধাময় প্রশ্নের মুখোমুখি– দেশের এই প্রাচীনপ্রবর পার্টি অন্তত ৫০টা সিট জিততেও পারবে তো?
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের কথা মনে পড়বেই। কংগ্রেস সেবার তাদের রেকর্ড করা কম আসনে লড়াই থামিয়েছিল– মাত্র ৪৪টি আসনে জয়! ২০১৯-এর লোকসভা তবু মন্দের ভাল বলতে হয়। ৫২টি আসন জিতেছিল, যার মধে্য ছিল কেরল ও তামিলনাড়ু (অবশ্যই ডিএমকে দলের সঙ্গে জোট না বঁাধলে তা সম্ভব হত কি না সন্দেহ)। দাক্ষিণাতে্য খানিক স্বস্তি আদায় করেছিল বইকি কংগ্রেস। ২০২৪—এও বেশিরভাগ ওপিনিয়ন পোলেরই অনুমান, কেরল আর খুব সম্ভবত তেলেঙ্গানা ছাড়া আর কোনও রাজে্যই কংগ্রেস দু’-অঙ্কে আসন জিততে পারবে না। দেশের ‘উত্তর-পশ্চিম’ জুড়ে বিজেপি যেরকম অজেয়তার ঢেউ তুলেছিল, আর তার ফলে বিগত দুই সাধারণ নির্বাচনেই কেন্দ্রের ক্ষমতা হাসিল করেছিল, এবারেও হয়তো তার চেয়েও বেশি মাত্রায় পশ্চিমের সমুদ্রোপকূল থেকে উত্তরের হিন্দু গো-বলয় অবধি ঝড় তুলবে। আর তাতে কংগ্রেস আগের তুলনায় আরওই ধরাশায়ী হবে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৯-এ যেমন, উত্তর-পশ্চিম বলয় জুড়ে ১০টি রাজে্যর ২৪৩টি আসনের মধে্য মাত্র ছ’টি আসন জিততে পেরেছিল কংগ্রেস।
[আরও পডুন: ‘ডাকলেই যাবে কেন?’, গভীর রাতে মিটিং নিয়ে মহিলাদেরই তোপ সন্দেশখালির তৃণমূল নেত্রীর]
কংগ্রেসের এই নির্বাচন-জনিত অধঃপতনের সূচনা যদিও নরেন্দ্র মোদির উত্থানে ঘটেনি। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর দেশবাসীর সহানুভূতিতে কংগ্রেস সেই তাবৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে লোকসভা জিতেছিল, তারপর থেকে একবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিগত ৪০ বছরে, কংগ্রেস ২০০টি আসন ছাপিয়ে যেতে পেরেছে মাত্র দু’বার– ১৯৯১-এ রাজীব গান্ধীর হত্যার পর নির্বাচনী প্রচারের আখ্যান বদলে গিয়েছিল, সেবারে সবচেয়ে ভাল ফল পেয়েছিল। আর দ্বিতীয়বার, ২০০৯-এ ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে। তঁার নেতৃত্ব ও বুদ্ধিমত্তার গুণমানের কথা ভেবেই সম্ভবত আশ্বাস পেয়েছিল দেশবাসী এবং এহেন জয় সম্ভব হয়েছিল।
তারপর ক্রম-অধঃপতন। কিন্তু এই আসন হ্রাসের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে একটা প্রশ্ন ঘাই মেরেই চলেছে– বিগত দশকজুড়ে নিজেদের ফিরিয়ে আনতে কিংবা জনসাধারণের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে কংগ্রেস কী প্রয়াস রেখেছে?
[আরও পড়ুন: এবার অসন্তোষ মহারাষ্ট্রে? উদ্ধব-পওয়ারকে ফোনে কী বোঝালেন রাহুল?]
এই শুনে কংগ্রেসের নেতারা হয়তো নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া এবং অবশ্যই আদালতের শাসক দলের মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা বলবেন এই মর্মে যে, মাঠে নামার মতো কোনও জায়গাই রাখা হচ্ছে না কংগ্রেসের জন্য। কোনও সন্দেহ নেই তাতে। চণ্ডীগড়ে মেয়র পদের নির্বাচনে হোক কিংবা নির্বাচিত নবগঠিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য ‘অপারেশন লোটাস’-এর মতো ছকবাজি– রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে যতরকমভাবে অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপি রীতিমতো হদ্দমুদ্দ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু, কংগ্রেসের এই ডুবে যাওয়ায় তাদের নিজেদের ভূমিকাও তো কম নেই! তারা কি আর নিজেদের কবর নিজেরা একটু হলেও খেঁাড়েনি? নিজেদেরকে আকর্ষণীয় এবং বর্তমান শাসকদলের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরতে আদৌ কোনও চেষ্টা দেখা গিয়েছে তাদের? রাহুল গান্ধীর যাত্রাসমূহর আয়োজনে দেশজুড়ে কংগ্রেসের হারিয়ে ফেলা জনসংযোগ কিছুটা হলেও হয়তো ফিরেছে। কিন্তু, কালেভদ্রে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তো আর এত বছরের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানো যাবে না। কখনও কখনও তো রাহুল গান্ধীকে দেখে ভাঙা জাহাজের নাবিক মনে হয়। তার উপর এমন ঘূর্ণি-ওঠা ঢেউ। এহেন পরিস্থিতিতে তঁাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লাগলেও, শেষমেশ দিশাহারাই ঠাহর হন বেশি। তা এমন ভাঙা জাহাজে
পাড়ি জমানোর হাবভাবে নাবিকের দুঃসাহসিকতার পরিচয় মেলে বটে, তবে সেই জাহাজ ভাসমান থাকবে মনে করে নেওয়াটা বোকামিই হবে। কারণ, তার যন্ত্রপাতি, গা রীতিমতো আলগা হয়ে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে ঢেউয়ে। অনুরূপভাবেই, কংগ্রেসের প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়গেও কম প্রয়াসী হননি। দলের একদম তৃণমূল স্তর থেকে যাতে সংযোগ তৈরি হয় এবং উপরমহল অবধি তা সম্পন্ন হয়, তার আয়োজন করেছেন। কিন্তু, এই দীর্ঘ লড়াই জারি রাখার মতো ধৈর্য বা ক্ষমতা তঁার আছে কি?
দুর্ভাগে্যর বিষয় হল, বর্তমানে আটজন এমন সক্রিয় মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন যঁারা এককালে কংগ্রেস পার্টিই করতেন। গত এক দশকে নয়-নয় করে ১৩ জন কংগ্রেসি দলত্যাগী হয়েছেন, যঁারা পরবর্তী কালে কিংবা সেই সময়েই মুখ্যমন্ত্রী পদ পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে, এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে লম্ফঝম্পময় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই, প্রতি মুহূর্তে ক্ষমতার বলয়ে থাকার এই স্পৃহা, এই ‘উগতা সুরাজ’ (উদীয়মান সূর্য) সিন্ড্রোমই তঁাদের দলত্যাগ করে নতুন ক্ষমতাশালী দলে ঢুকে পড়াকে নির্দেশ করে। কিছু ক্ষেত্রে অনেকেই, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাদের সুস্পষ্ট ভয়েও দলত্যাগ করেছেন। কিন্তু, এসব পেরিয়ে, পার্টির স্থিতিশীল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং অস্থির রাজ্য ইউনিটগুলির মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান সংযোগহীনতা তৈরি হয়ে চলেছে, যা পর্যায়ক্রমে বিদ্রোহের পরিসরকেই উত্সাহিত করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রদেশের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বা অসমের হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরে এসেছেন কংগ্রেস থেকে, এহেন কারণেই। পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ পুরনো বর্ষীয়ান নেতাদের কাছে হেরে যাওয়ার পরে তঁাদের দলত্যাগ ঘটেছিল, নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। সময়ের নিরিখে, বাস্তববাদী এবং মানানসই ‘বিগ টেন্ট’ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ, একই ছাতার তলায় সবাইকে রেখে একটা সময় এই কংগ্রেসই প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ করেছিল, পরিচালনাও করেছিল। কিন্তু, বর্তমানে সেসব বিলুপ্ত। অনমনীয় সংযোগ এবং ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’ যুদ্ধেরই খেউড় সারাক্ষণ। একটা নির্দিষ্ট ছোট গোষ্ঠীই সমস্তটা পরিচালনা করে চলেছে।
২০১৩ নাগাদ জয়পুরের এক অধিবেশনে, ক্ষমতা কীভাবে বিষ হয়ে ওঠে, তা নিয়ে রাহুল গান্ধী তঁার ভাষণ রেখেছিলেন। কিন্তু, তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, যঁাদের উদ্দেশে্য তিনি এই ভাষণ রাখছেন, সেই পার্টির অন্তরাত্মা পুরোপুরি ক্ষমতা কায়েমের আদর্শেই চালিত হয়। উল্টোদিকে, বিজেপি এমন এক রাজনৈতিক সংস্থা, যাদের আদর্শের নামই ‘সংঘ পরিবার’। গেরুয়া গড়নে ক্যাডার-নির্ভর সৌভ্রাতৃত্ব– এটাই বিজেপির খারাপ-ভাল সমস্ত সময়ের মূল আঠা, যা তাদের জুড়ে জুড়ে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, এই দল, ১৯৮৪-তে যখন মাত্র দুটো আসন জিতেছিল, সেই সময়েও দলের নেতৃত্বক্রম থেকে কাউকে বরখাস্ত বা পদাবনত করা হয়নি এবং সকলেই ছিল দৃঢ়চিত্ত। এখন, যখন নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি শালপ্রাংশু আকার নিয়ে সর্বত্রব্যাপী হয়ে উঠেছে, তাতে হয়তো বাইরে থেকে অনেকেই কেন্দ্রীভূত এই সিদ্ধান্ত-নিরূপণের নিন্দেমন্দ বিরোধিতা করেন, কিন্তু কারও আদপে সাহস নেই একাধিপতির বিরুদ্ধে হুংকার তোলার।
তার মানে কিন্তু এমনটা নয় যে, কংগ্রেসকে পুনরায় জেগে উঠতে হলে তাদের আরও একাধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে হবে এই নব্য বিজেপিকে অনুসরণ করে। বরং তাদের হয়ে উঠতে হবে প্রাচীন কংগ্রেসের মতোই আরও সহনশীল, আরও জোটবদ্ধ এবং পরিবেষ্টক। অর্থাৎ, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা আছে, এমন নতুন প্রতিভাদের তুলে আনতে হবে, তাদের সুযোগ দিতে হবে এবং একধাক্কায় সেই তরুণ নেতাদের রাজ্যস্তর থেকে কেরিয়ার গড়তে দিতে হবে। প্রাচীন, ক্লান্ত, বর্ষীয়ান নেতাদের উপর ভরসা করলে আর চলবে না। তেলেঙ্গানায় রেবন্ত রেড্ডিই একজন প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ৫৪ বছর বয়সি এই নেতা কংগ্রেসকে একদম সামনে থেকে লড়াইয়ে কী অনুপ্রাণিতই না করেছিলেন। কে বলতে পারে, রাজস্থানে শচীন পাইলট, কেরলে শশী থারুর কিংবা মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশের মতো রাজে্য পোড়-খাওয়া যুব নেতাদের সুযোগ দিলেও খেলা ঘুরবে না ভবিষ্যতে?
রাহুল গান্ধী এবং গান্ধী পরিবারের কাছে, এই ‘গান্ধী’ পদবিই যথেষ্ট সর্বনাশের এখন। প্রথাগত কংগ্রেসি বিশ্বস্তদের বাইরে এই পদবির প্রতি মানুষ আর ভরসা রাখতে পারছে না। প্রথম, দ্বিতীয় পেরিয়ে তৃতীয়বারের জন্যও লোকসভা নির্বাচনে পরাজয় ঘটলে কংগ্রেসের কাছে তা বিপর্যয়কর হয়ে উঠবে। একসময়ের প্রভাবশালী এই শক্তির স্বতন্ত্র ক্ষয়ই ত্বরান্বিত হবে পরিণতিতে। গত একদশকে, বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল নেতৃত্বের প্রস্থানের ফলে নড়ে গিয়েছে সেই বিশ্বাস যে, একমাত্র গান্ধীরাই কংগ্রেসকে একত্রিত করার আঠা। শীঘ্রই বা পরে, কংগ্রেসকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: পার্টি কি এমন একটি পরিবারের উপর নির্ভর করতে পারে, যা আর ভোট টানতে পারে না, না কি এই সংযোগ শেষমেশ ছিন্ন করাই উচিত? ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন কংগ্রেসের আশু ভবিষ্যৎ গঠনের অ্যাসিড টেস্ট হতে চলেছে।
পুনশ্চ সম্প্রতি একটি খাওনদাওন গপ্পগুজবের আয়োজনে, কংগ্রেসের প্রধান খাড়গেমশাইয়ের সঙ্গে গল্পে মশগুল ছিলেন এক বর্ষীয়ান কংগ্রেসি নেতা। তা, সেই নেতা আসর থেকে বেরনোর অনুমতি নিয়ে খাড়গেমশাইকে জানাতে গিয়েছেন আর কী। সেই দেখে, জনৈক সাংবাদিক খোরাক পেড়েছিলেন– আশা করি নেতামশাই কেবল আসর ছেড়েই যাচ্ছেন, দল ছাড়ছেন না!