প্রয়াত জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-কে ভবিষ্যৎ প্রধানত মনে রাখবে তাঁর অর্থনৈতিক মডেল ‘অ্যাবেনোমিক্স’-এর জন্য। যা দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভের উপর। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার- জাপানের ক্রমহ্রাসমান জন্মহারের পতন আটকানো এবং এমন একটি সমাজ তৈরি করা, যা কর্মশক্তিতে নারীদের সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করে। জাপানি সমাজের মানসিকতার এক অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছিলেন আবে। লিখছেন অতনু বিশ্বাস
আততায়ীর গুলিতে সদ্য মৃত প্রাক্তন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রের প্রধান উত্তরাধিকার অবশ্যই একুশ শতকের পটভূমিতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের পুনঃরূপায়ণের মধ্যে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে রুখতে অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং জাপানকে একটি কৌশলগত জোটে একত্রিত করে ‘কোয়াড’ নামের চতুর্ভুজ পুনরুজ্জীবনের পিছনে অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন আবে। তবে, আবে-র প্রধান লেগ্যাসি অবশ্যই ‘অ্যাবেনোমিক্স’ নামে পরিচিত এক উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক বিষয়সূচি, যা জাপানের স্থবির অর্থনীতিকে উদারীকরণ এবং কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। যা প্রধানত হয়েছিল ২০১২-’২০- এই সময়কালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর কার্যকালে। ভবিষ্যৎকাল কিন্তু আবেকে প্রধানত মনে রাখবে তাঁর এই অনেকখানি অসফল অর্থনৈতিক মডেলের জন্য।
আসলে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক মডেল দেওয়া যতটা সহজ, তার বাস্তব রূপায়ণ একেবারেই সেরকম নয়। একজন রাষ্ট্রনেতার পক্ষেও তার রূপায়ণ যথেষ্ট কঠিন। আজকের জাপানের অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়তে থাকে নয়ের দশকের গোড়ার দিকে সম্পত্তির দামের বুদ্বুদ চৌচির হয়ে যাওয়ার সময় থেকে। আবে-র দ্বিতীয় দফার কার্যকাল শুরু হয় এর প্রায় দু’-দশক পরে। জাপানের অর্থনৈতিক সমস্যাটা অন্য অনেক দেশের থেকেই আলাদা। এক দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক স্থবিরতাই এ-দেশের অর্থনীতির প্রধান ব্যাধি। এই রোগটি আবার সে-দেশের ঐতিহ্যগত ‘সংকোচনমূলক মানসিকতা’-র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আসলে সে-দেশের কোম্পানি এবং পরিবারগুলি সবসময় ভাবতে থাকে যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কম হবে এবং দীর্ঘকাল ধরে বেতন স্থবির হয়ে থাকবে, ফলে তারা ব্যয় করা প্রায় বন্ধ-ই করে দেয়। সব মিলিয়ে এক বয়স্ক জনগোষ্ঠী, ক্রমাগত সংকোচন এবং শ্রমবাজার আর শক্তি সরবরাহে কাঠামোগত সমস্যা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাপানের। এসবের ফলে এই ধনী দেশটার আর্থিক অবস্থা কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খারাপ।
[আরও পড়ুন: ঝোপ বুঝে কোপ, আগামী দিনে বিজেপির ‘টার্গেট’ দাক্ষিণাত্য]
শিনজো আবে-র প্রথম দফার কার্যকাল বেশ সংক্ষিপ্ত, ২০০৬-’০৭-এ। খুব বেশি কিছু করার সুযোগ সেখানে ছিল না নিশ্চয়ই। ২০১২-তে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েই এই স্থবিরতা কাটিয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন আবে। মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়া তখনও লেম্যান সংকটের ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি পুরোপুরি।
শিনজো আবে-র ‘অ্যাবেনোমিক্স’ দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভের উপর, যাকে বলা হয় তিনটি ‘তির’। বড় ধরনের আর্থিক সহজীকরণ, সরকারি ব্যয়ে বড় আকারের বৃদ্ধি এবং কাঠামোগত সংস্কার- এই তিনটি তির। আসলে নিয়ন্ত্রিত সংস্কার, কর্পোরেট পরিচালনায় সংস্কার এবং কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো ইত্যাদি বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে ২ শতাংশ করাই ছিল অ্যাবেনোমিক্সের মূল উদ্দেশ্য। সমাজের মানসিকতায় ধাক্কা-দেওয়া এবং বিস্ময়-জাগানো এই আর্থিক উদ্দীপনার আসল উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল দু’দশকের জমাট-বাঁধা স্থবিরতা ভাঙা, যা হয়তো আদপে জাপানি সমাজের যুগ-সঞ্চিত মানসিকতা।
প্রাথমিকভাবে কিন্তু ভাল ফল দেখায় শিনজো আবে প্রবর্তিত এই ‘অ্যাবেনোমিক্স’। ২০১২-র শেষদিকে এর সূত্রপাত। শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই জাপানি ক্রেতারা কেনাকাটায় বেশ উৎসাহ দেখাতে শুরু করে। পোশাক এবং প্রসাধনের ক্ষেত্রে এই কেনাকাটার উৎসাহ বাজারে ভাল প্রভাব ফেলে। অনেকেই একে বলেছেন অ্যাবেনোমিক্সের ‘কিমোনো এফেক্ট’। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল যে, আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবিকই যুগসঞ্চিত অচলায়তনকে ভেঙে ফেলা সহজ নয়।
পাঁচ বছরের সার্বিক প্রয়াস এবং আর্থিক সহজীকরণের পরেও দেখা গেল, মূল্যবৃদ্ধির হার ১ শতাংশের কম থেকে গিয়েছে। এমনকী, ‘ব্যাংক অফ জাপান’ তিনমাস পর-পর যে অনুমান দিচ্ছিল কবে ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি হতে পারে, তা-ও বন্ধ করে দিল ২০১৮-তে। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল অ্যাবেনোমিক্সের বিভিন্ন পদক্ষেপ।
অ্যাবেনোমিক্সের তৃতীয় তির, অর্থাৎ পরিকাঠামোগত সংস্কার যে এর এক প্রধান ব্যর্থতা, সে নিয়ে সংশয় নেই। সেই সঙ্গে ২০১৯-এ বিক্রয় কর বাড়ানো কিংবা চিন-আমেরিকার বাণিজ্য নিয়ে লড়াই এর সাফল্যের সম্ভাবনা কমিয়েছে আরও। তারপর এল অতিমারী। অ্যাবেনোমিক্সের যেসব স্বল্পকালীন ফল মিলেছিল, তারও অনেকটাই মোটামুটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল অতিমারীর দাপটে।
আসলে তিনটি তিরের কথা বলা হলেও অ্যাবেনোমিক্সের তূণে কিন্তু একটা চতুর্থ তির লুকনো ছিল। ২০১৩-তে টোকিও জিতে নেয় ২০২০-র অলিম্পিক সংগঠনের সুযোগ। অলিম্পিক সংগঠন নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন আবে নিজে। এবং ‘টোকিও ২০২০’ অলিম্পিককে অ্যাবেনোমিক্সের চতুর্থ তির হিসাবে বর্ণনা করেছেন অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞই। আসলে ভাবা হয়েছিল যে, অলিম্পিক সংগঠন অর্থনীতিতে জোয়ার আনবে, যা প্রকারান্তরে অনুঘটকের কাজ করবে অ্যাবেনোমিক্সের জন্য। অলিম্পিক সংক্রান্ত বিপুল বিনিয়োগ, খরচ এবং পর্যটনের মাধ্যমে। ভাবা হয়েছিল, অন্তত দেড় লক্ষ কর্মসংস্থান হবে এর ফলে। কিন্তু অতিমারী
বাদ সাধল। অলিম্পিক পিছিয়ে গিয়ে এবং পর্যটনের দফারফা হয়ে অলিম্পিকের সুফল কমে গেল অনেকটাই। দীর্ঘকালীন মেয়াদে অ্যাবেনোমিক্সের ব্যর্থতার পিছনে তাই কোভিড অতিমারীর প্রভাব বড় কম নয়।
তবু অ্যাবেনোমিক্স একেবারে কিছু কাজ করেনি, তেমনটাও নয়। এর শুরুর সময় থেকে গত এক দশকে জাপানে বেকারত্ব কমেছে মোটামুটি ২ শতাংশ। বেকারত্বের হার মোটামুটি সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে কমে এখন মোটামুটি আড়াই শতাংশ। ২০২০-তে স্বাস্থ্যের কারণে যখন প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেন আবে, তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাঁর উত্তরাধিকার ঠিক কী। অ্যাবে নিজে কিন্তু মনে করেছেন ‘অ্যাবেনোমিক্স’-ই তাঁর প্রধান উত্তরাধিকার। হ্যাঁ, এর ব্যর্থতা সত্ত্বেও।
২০১৫-তে অ্যাবেনোমিক্সের নতুন তিনটি তির ঘোষণা করেন আবে। এই নতুন তির তিনটি হল- একটি শক্তিশালী অর্থনীতি, যা আশার জোগান দেয়, শিশু লালন-পালনের জন্য সহযোগিতা, যা স্বপ্নকে লালন করে এবং সামাজিক নিরাপত্তা, যা নাগরিকদের আশ্বাস দেয়। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার- জাপানের ক্রমাগত কমে যাওয়া জন্মহারের পতন আটকানো এবং এমন একটি সমাজ তৈরি করা, যা কর্মশক্তিতে নারীদের সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করে। আসলে, দেশটা যে ক্রমশ বয়স্ক হয়ে পড়ছে, সেটা আটকানোর এক মরিয়া প্রয়াস ছিল এটা। এছাড়াও, জাপানকে আরও বেশি পরিমাণে ডিজিটাল সমাজের দিকে ঠেলে দেওয়াও ছিল এক উদ্দেশ্য। সেই সমাজের নাম ‘সোসাইটি ৫.০’। যাই হোক, একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। অ্যাবেনোমিক্সের রূপরেখা প্রয়োজন মতো বদলে নেওয়ার নমনীয়তা দেখিয়েছিলেন আবে। ২০২০-তে অবসরের সময়ও তাঁর মুখে শোনা গেল সেই একই কথা। অ্যাবেনোমিক্সের যদি কোনও ক্ষতিকর দিক থাকে, তাকে কী করে শুধরে নেওয়া যায়, দরকার সেই পরামর্শ। জাপানি সমাজের মানসিকতার এক অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছিলেন আবে, যা সহজ ছিল না একেবারেই। তিনি সফলও হননি তাঁর প্রচেষ্টায়। তবু, এই নমনীয়তাই বোধকরি শিনজো আবে-র লেগ্যাসি। নমনীয়তা তাঁর অর্থনীতিতে, জাপানের রাজনীতিতে, এমনকী ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও।