৬৬ মহাত্মা গান্ধী রোড। ধুলোয় ভরা মেসের সাইনবোর্ড। এখানেই থাকতেন অজিত। তারপর এসে ওঠেন অতুলরূপী ব্যোমকেশ। সেখানেই কি না হাজির এখনকার ব্যোমকেশ আবির চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গী বোর্ডার ইন্দ্রনীল রায়।
ছোটবেলা কেটেছে উত্তর ও মধ্য কলকাতায় বলেই বোধহয় সেখানকার সব রাস্তা তাঁর নখদর্পণে। এর আগে এ বাড়িতে তিনি একবারই এসেছেন। তাও বেশ কিছু বছর আগে। কিন্তু আশ্চর্য রকম ভাবে রাস্তাটা ভোলেননি। তাঁর পক্ষে সত্যি ভোলা সম্ভবও না। তাই গুগল ম্যাপের তোয়াক্কা না করেই সোজা মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর, চিত্তরঞ্জন কলেজের উল্টো দিকের তিন তলা বাড়ির সামনে এসেই গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন তিনি।
“এইটা, এই বাড়িটা। দিস ইজ দ্য হাউস,” শিশুসুলভ উত্তেজনায় বলেন তিনি।
পুজোর আগের ব্যস্ত কলকাতার রাস্তা, বহু মানুষজন সকালের ফুটপাথ ধরে হাঁটছেন। তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ওই বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। ধুলো পড়ে গেছে সাইনবোর্ডে। একতলার বারান্দায় বিছানার চাদর আর নাইটি শোকাচ্ছে। কোনও পূর্বজন্মের (না কি এই জন্মের?) যোগাযোগ না থাকলে কোনওমতেই আজকের বাংলা ছবির অন্যতম সেরা নায়ক এতটা স্বচ্ছন্দ হতে পারেন না এই পরিবেশে। ব্যোমকেশ বক্সীর সেই মেসবাড়ির সামনে তখন দাঁড়িয়ে পর্দার ব্যোমকেশ। বুঝতে পারলাম, পুরো পরিবেশটা আত্মস্থ করছেন নিজের মতো করে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ‘প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস’ লেখা সাইনবোর্ডটার দিকে।
এটাই তো সেই মেস যেখানে অজিত আর ব্যোমকেশের সঙ্গে থাকতেন পরিচারক পুঁটিরাম। এই সেই হ্যারিসন রোডের মেস, যে বাড়িতে বিয়ের পর সত্যবতীকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এই সেই মেস যার ঘরের দরজার পাশে পিতলের ফলকে লেখা থাকত: শ্রী ব্যোমকেশ বক্সী/সত্যান্বেষী। এতদিন পর সেখানে এসে দাঁড়ালেন আবির চট্টোপাধ্যায়।
গেটের কাছে লাল রঙের একটা স্কুটার। তার হ্যান্ডলে হাত রেখে ধীরে ধীরে বললেন, “কী অদ্ভুত লাগছে। এই মেসবাড়িতেই এক সময় থাকতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দক্ষিণ কলকাতা চলে যাওয়ার আগে এখানেই থাকতেন ব্যোমকেশ বক্সী। কে বলেছে ব্যোমকেশ কাল্পনিক চরিত্র? এই বাড়িতে এলে মনে হবে এখুনি সিঁড়ি দিয়ে তিনি নিচে নেমে আসবেন।”
এর আগে একবারই এসেছিলেন তিনি, বেশ কিছু বছর আগে। কিন্তু সে বার বাইরে থেকে দেখেই চলে যান। এ বার সাহস করে তাঁকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল ‘কফিহাউস’।
[ পুজোয় সুন্দরী হতে এভাবেই সারুন লাস্ট মিনিটের রূপচর্চা ]
‘ব্যোমকেশের সঙ্গে থাকতেন জীবনানন্দ’
ঢুকেই দেখলাম উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িতে যেমন হয়, ঠিক তেমনই বাড়ির মাঝখানে একটা খোলা উঠোন। সেখানে মাছ ধোয়া হচ্ছে। একদিকে আলু কাটা, অন্য দিকে মিক্সারের বাটিতে নারকেলের পেস্ট। দেখতে পেলাম বাড়ির একতলায় এখন ‘মহল ভাতের হোটেল’ বলে একটা ছোট দোকান চলে। বুঝলাম দুপুরের খাওয়ার রান্না হচ্ছে।
একটা ছবি তোলা যাবে আবিরকে নিয়ে জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল, বাড়ির কর্তাকে না জিজ্ঞেস করে ছবি তোলা নিষেধ।
উঠোনের ডান হাত দিয়ে ছোট একটা সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ির পাশের বারান্দায় তখন এসে হাজির বাড়ির কর্তা সন্দীপ দত্ত। আবিরকে দেখে তিনি হাসিমুখে অনুমতি দিয়ে দিলেন।
কথায় কথায় সন্দীপবাবুর কাছে জানতে পারলাম, তাঁর দাদু যখন এ বাড়ির কর্তা ছিলেন, সেই সময়ই এখানে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন। তিনিই বললেন, ব্যোমকেশের স্রষ্টা ছাড়াও আরও একজন থাকতেন এই মেসবাড়িতে। যা অনেকেই জানে না। জীবনানন্দ দাশ।
হ্যাঁ, কবি জীবনানন্দ দাশ।
“উনি এ বাড়িতে আট বছর থেকেছেন। সেই সময় নর্থ সিটি কলেজে পড়াতেন। সেই পুরো সময়টা এটাই ছিল তাঁর বাসস্থান,” আবিরের দিকে তাকিয়ে বলেন বাড়ির কর্তা।
বাংলা সাহিত্যের দুই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ একই মেসবাড়িতে!
ইউরোপের যে কোনও দেশ হলে এই বাড়িটা হত শহরের অন্যতম ‘মাস্ট ভিজিট’ প্লেস। কিন্তু এখানে…
হায় রে কলকাতা!
[ পুজোর বাকি ন’দিন, কীভাবে সারবেন শেষ মুহূর্তের শপিং? ]
একটু ওঁর ঘরটা দেখান না
এর পরে বাড়ির কর্তার কাছে শরদিন্দুবাবুর ঘর কোনটা ছিল, সেটা দেখানোর অনুরোধ করেন আবির।
“একটু ওঁর ঘরটা দেখান না”।
আর আবদার করবেন না-ই বা কেন আবির? ওই ঘরেই তো রয়েছে ব্যোমকেশ আর অজিতের প্রাণভোমরা।
আবিরের আবদার শুনে হেসে ফেলেন সন্দীপবাবু। “আসলে আবির, সেই সময় কোনও একজনের নির্দিষ্ট কোনও ঘর থাকত না। সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ ঘরে-ও ঘরে থাকতেন। আজকে কোনও একটা ঘর দেখিয়ে যদি বলি এটায় শরদিন্দুবাবু থাকতেন, তা হলে সেটা সত্যি বলা হবে না,” বলেন বাড়ির মালিক।
ব্যোমকেশের সঙ্গে একটা ব্যাপারে কিন্তু আবিরের বিশেষ মিল। একটা সময় উত্তর কলকাতায় থাকলেও পরের দিকে তাঁরা দু’জনেই দক্ষিণ কলকাতায় চলে যান। “একদম কারেক্ট ধরেছেন। উনি কেয়াতলা, আমি বাইপাসের পাশের ফ্ল্যাটে। কিছু মিল তো থাকতেই হবে ওঁর আর আমার,” রসিকতা করেই বলেন আবির।
এর পরেও দেখি তরতর করে হেঁটে ওপরে চলে গিয়ে দোতলার বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এই রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতেই তো কত রহস্যের সমাধান করেছেন ‘সত্যান্বেষী’। এ বাড়ির রেলিংয়ে দাঁড়িয়েই হয়তো ভেবেছেন কোকনদ গুপ্তকে কী ভাবে বাগে আনা যায়?
অক্টোবরের সকালে পর্দার ব্যোমকেশও দেখলাম আনমনা। গভীর কিছু ভাবছেন, ফোটোগ্রাফার তোয়াক্কা না করে শুধুই দেখছেন ঘরগুলো।
‘সত্যান্বেষী’ গল্পে অজিতের মেসে সেই কোকেনের ব্যবসা করা ডাক্তার, অনুকূলবাবু তো এই মেসেই কোকনদ গুপ্ত পরিচয় দিয়ে হাজির হয়েছিলেন তাঁর সামনে।
এত বছর পরে তা হলে ‘অগ্নিবাণ’ গল্পে কোকনদ গুপ্তর সেই পাঁচ নম্বর ঘরই কি খুঁজছেন ব্যোমকেশ?
কী ভাবছেন আর জিজ্ঞেস করা হয়নি আবিরকে।
তবে এবারে পুজোতেও রয়েছে তাঁর বড় রিলিজ, ‘ব্যোমকেশ গোত্র’।
টাইম এসে গেছে ‘বিগার রোল’ প্লে করার ইন্ডাস্ট্রিতে
পুজোয় রিলিজ, এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে বলুন, কতটা টেনশন হচ্ছে? প্রশ্ন শুনে হেসেই ফেলেন আবির। “পুজোর রিলিজের সময় একটা টেনশন তো থাকেই। তবে আগে যে রকম পুজো রিলিজের আগেই লোকে বলে দিত এই দুটো ছবি দারুণ করবে, এ বার কিন্তু কেউ একদম শিওর হয়ে কিছু বলতে পারছে না,” সাফ জবাব ‘সত্যান্বেষী’-র।
বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে নয় নয় করে আবিরের দশ বছর হয়ে গেল। আজকের এই পালটে যাওয়া বাংলা ছবির অন্যতম বড় নাম তিনি। কিন্তু অনেকেই বলে আবির অসম্ভব ‘সেফ’ খেলেন। কোনও বিতর্কে জড়ান না। ইন্ডাস্ট্রির কোনও ঝামেলায় তাঁকে সামনের সারিতে দেখা যায় না।
টালিগঞ্জের একটা এত বড় নাম হয়ে তাঁরও তো ধীরে ধীরে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ইন্ডাস্ট্রির কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত? এ ব্যাপারে কিছু কি ভাবছেন তিনি?
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ফ্যানের সঙ্গে ছবি তুলে তিনি কথা বলা শুরু করলেন।
“এটা ঠিকই বলেছেন। টাইম বোধহয় এসে গেছে আর একটু বিগার রোল নেওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে। সত্যি কথা বলতে, এখন এমন একটা সময় যে আপনি যা-ই বলবেন, লোকে তার পেছনে কোনও না কোনও মোটিভ খুঁজবে। তার ভয়েই হয়তো আমি একটু পেছনের সারিতে থাকতাম। বাট আপনাকে বলছি, এ বার থেকে একটু একটু করে বদলানো আবিরকে দেখতে পাবেন আপনারা। আর যাঁরা ব্যক্তিগত লেভেলে আমাকে চেনেন তাঁরা জানেন আমি কিন্তু একদম ডিপ্লোম্যাটিক ছেলে নই। যা মনে আসে আমি সেটাই বলি। হয়তো এ বার ইন্ডাস্ট্রিও সেই আবিরকেই দেখতে পাবে,” বলতে বলতে সানগ্লাসটা পরেন তিনি।
[ ভাওয়াল রাজার আদালতে একান্তে ধরা দিলেন যিশু সেনগুপ্ত ]
রেডবুল খুব খারাপ একটা ড্রিংক
এমনিতে এই বছরটা খুব ভাল যাচ্ছে আবিরের। ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ বড় হিট। ‘বিদায় ব্যোমকেশ’ মানুষের ভাল লেগেছে। পুজোয় অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ গোত্র’ আর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’। পরের মাসে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিজয়া’। বছর শেষে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘শাহজাহান রিজেন্সি’। এ তো প্রায় স্বপ্নের বছর?
“অত ভাবছি না। মন দিয়ে কাজ করে চলেছি। আর এ বছর একটা অদ্ভুত জিনিস হয়েছে। যে ছবিগুলো রিলিজ হয়েছে বা হবে, সেগুলোর শুটিং এ বছরই করেছি। কোনও ব্যাকলগ থাকছে না। তাই পারফরম্যান্সগুলো আরও ফ্রেশ লাগছে। আর ভাল লাগছে এটা দেখে যে আমরা আজকে যে ছবি করছি সেটাই মেনস্ট্রিম বাংলা ছবি হয়ে উঠেছে,” প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন আবির।
প্রসেনজিতকে সমীকরণের বাইরে রাখলে, সত্যি আবির, যিশু, ঋত্বিক, পরমের ছবিই আজকে মেনস্ট্রিম। দর্শকও তাঁদেরই বেশি চাইছে। কিন্তু তা-ও তো সো-কল্ড ‘বাণিজ্যিক’ ছবির জুনিয়র নায়কের জন্য সেটে থাকে রেডবুল আর আপনাদের জন্য ডাবের জল। তাঁদের জন্য নামী রেস্তোরাঁর খাবার, আপনার প্রোডাকশনে ট্যালট্যালে মাছের ঝোল। এই তফাতটা ঘুচবে কবে?
প্রশ্ন শুনে যেন অবজ্ঞার হাসি হাসেন আবির। তার পর চোয়াল শক্ত করে বলেন “রেডবুল খুব খারাপ একটা ড্রিংক। ডাবের জল অনেক বেটার। আর আমার বিশ্বাস, কমার্শিয়াল আর আর্বান ছবির মধ্যে যে দেওয়ালটা ছিল তা আজ ভেঙে গেছে। পুরনো রীতি, ধারণাও পাল্টে যাবে খুব শিগগির,” বলেন আবির।
[ লাইভ কিশোর কুমারের গান শুনতে চান? ঢুঁ মারুন বেনিয়াটোলা লেনে ]
ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে সাড়ে এগারোটা। যে পরিমাণ ভিড় বাড়ছে তা দেখে আশপাশের বিয়ের কার্ডের দোকানদার কিঞ্চিৎ বিরক্ত। যা বুঝলাম, এখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা যাবে না।
যাওয়ার আগে দেখলাম, আবির আরও একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়িটা দেখছেন। চোখের কোণটাও যেন অদ্ভুত ভাবে চিকচিক করছে। কবীর সুমনের গান থেকে ধার নিলে বলতে হয়, আবিরের যেন তখন ‘গলায়, বুকে বাস্তুভিটে’।
সত্যি তো এই মেসবাড়ির সেই মানুষটাই দু’হাত ভরে দিয়েছেন আবিরকে। নাম, খ্যাতি, প্রতিপত্তি।
‘চলুন এ বার বেরোই এখান থেকে, ভিড় বাড়ছে।’
কথাটা শুনেও যেন শুনতে পেলেন না আবির। শুধু ধীরে ধীরে বললেন, “আজকাল আমাদের লাইফস্টাইলটা ভীষণ জাঁকজমকের, কিন্তু চিন্তাধারায় যেন কোনও ব্যাপ্তি নেই। আর যে মানুষটা এই মেসবাড়িতে থাকতেন, তাঁর জীবন কতটা সাধারণ, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি কত অমর। বাড়িটা দেখতে দেখতে এটাই ভাবছিলাম।”
৬৬ মহাত্মা গান্ধী রোড।
প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস।
ব্যোমকেশ বক্সীর বাড়ি।
আবির চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাস্তুভিটে’।
The post ব্যোমকেশের ডেরায় ঘুরে এলেন ব্যোমকেশ appeared first on Sangbad Pratidin.