ভাস্কর লেট: ‘মানুষের কাছে অ্যান্টি-বিজেপি সাংবাদিক হিসাবেই আপনি পরিচিত। আপনার কি কোনও ইমেজ প্রবলেম আছে?’
সোমবার জয়পুর লিটারারি ফেস্টিভ্যালের শেষদিনে এই প্রশ্নটি যাঁর দিকে ধেয়ে এল বিষমাখা তিরের মতো, তিনি নিজেই একসময় সাংবাদিক রূপে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘ইমেজ প্রবলেম’ নিয়ে দুঃসাহসিক প্রশ্ন করেছিলেন, এবং বিপাকেও পড়েছিলেন। সেই সাংবাদিকের নাম করণ থাপার। তবে এদিনের প্রশ্নকর্তা যুবককে কোনওরকম বিপদে পড়তে হয়নি।
খানিক থমকে, খানিক বা ভেবে নিয়ে করণ থাপার বলেন, ‘আমি মনে করি সাংবাদিকের প্রকৃত পরিচয় তাঁর পেশাগত নিরপেক্ষতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সাংবাদিকের কাছে দল বা মত বড় হয়ে উঠলে মুশকিল। ফলে মানুষ যদি মনে করে আমি একজন অ্যান্টি-বিজেপি সাংবাদিক, তাহলে আমার তো ইমেজ প্রবলেম হবেই।’
করণ থাপারের লেখা ‘ডেভিল’স অ্যাডভোকেট’ বইটি বেশিদিন হল বেরোয়নি। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা মূলধন করে ওই বইতে তিনি একাধিক রোমহর্ষক ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। যেসব ঘটনার গনগনে আঁচ রাজনীতি তো বটেই, এমনকী খেলা থেকে বিনোদন জগৎ অবধি ছড়িয়েছিল।
মঞ্চে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন আরেকজন দিকপাল সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষ। জনতাকে তিনি মনে করিয়ে দেন, করণ থাপার হচ্ছেন সেই বিরল গোত্রের সাংবাদিক, সবথেকে বেশিসংখ্যক রাজনীতিবিদ ইন্টারভিউ চলাকালীনই যাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অথবা প্রবলভাবে অসন্তোষ জানিয়েছেন। তাঁদের নামও একে একে বলেন। লালকৃষ্ণ আডবানী, রাম জেঠমালানি এবং নরেন্দ্র মোদি ইন্টারভিউ চলার মাঝেই নাকচ করে দিয়েছিলেন নির্ধারিত সূচি। আর জয়ললিতা ইন্টারভিউ বাতিল হয়তো করেননি, কিন্তু এত রেগে গিয়েছিলেন যে ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পরেই স্পষ্টভাষায় বলে দেন: ‘আপনার সঙ্গে কথা বলে মোটেও খুশি হতে পারলাম না।’
সাগরিকার প্রশ্ন ছিল: রাজনীতিকের সঙ্গে একজন সাংবাদিকের বন্ধুত্ব বা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক কি আদৌ গড়ে উঠতে পারে?
করণ থাপার উত্তর দেওয়ার সময় দ্বিধা রাখেননি মনে। জানান, সৌহার্দ্যের সম্পর্ক থাকতেই পারে। একজন সাংবাদিক যথেষ্ট শালীনভাবে রাজনীতিকের সঙ্গে মিশবেন, এটাই তো হওয়া উচিত। একেই বলে সভ্যতা। কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, বাস্তবিকই রাজনীতিবিদের সঙ্গে সাংবাদিকের ‘বন্ধুত্ব’ হয় না। কোনও সাংবাদিকেরই উচিত না বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে রাজনীতিকদের সঙ্গে মেলামেশা করা। নিজেরই জীবন থেকে দু’টি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তিনি।
[ রাহুল-প্রিয়াঙ্কার পদ নিয়ে কংগ্রেসকে আক্রমণ অমিত শাহের ]
প্রথমে আসেন লালকৃষ্ণ আডবানীর প্রসঙ্গে। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, লালকৃষ্ণ আডবানীর সঙ্গে একদা তাঁর গভীর সখ্য ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁকে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন আডবানী। সমস্যা দেখা দিল, ২০০৬ সালে রাজনাথ সিং বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মাস দুয়েক পর। সভাপতিত্বে আসীন হয়েই দলীয় নীতিতে এমন পাঁচ-ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন তিনি। যে নীতিগুলি বস্তুত লালকৃষ্ণ আডবানীর সভাপতি থাকার সময় প্রযুক্ত ও প্রযোজ্য হয়েছিল। করণ থাপার সেসব নিয়েই যথারীতি প্রশ্ন করেছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হয়। ইন্টারভিউ শেষ হলে হঠাৎ লালকৃষ্ণ আদবানী বলেন, ‘ইন্টারভিউটি কি আরও একবার নেওয়া যেতে পারে?’ কারণ, ওঁর তখন মনে হচ্ছিল পূর্বসুরি রূপে এইভাবে রাজনাথ সিংয়ের সমালোচনা করা ঠিক হল না। ফলে ওটা বাতিল করে আরেকটা নতুন ইন্টারনিউ নিলে ভাল হয়।
করণ রাজি হননি। তাঁর মনে হয়েছিল, রাজনাথের জমানায় হওয়া বিজেপির নীতি পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নগুলি করা জরুরি। তাছাড়া, লালকৃষ্ণ আডবানীর রক্ষণাত্মক অবস্থানও বলে দিচ্ছিল, ওই প্রশ্নগুলি কতটা সংবেদনশীল, সময়োপযোগী। এরপর মতান্তর ও মনান্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন করণ থাপার ‘সিএনএন আইবিএন’ চ্যানেলে কর্মরত। লালকৃষ্ণ আদবানী নতুন করে ইন্টারভিউ করার আর্জি জানিয়ে রাজদীপ সরদেশাইকেও ফোন করেছিলেন, কেননা তখন রাজদীপও রয়েছেন ওখানে। কিন্তু তাতেও বরফ গলেনি। রাজদীপ সতর্ক করেছিলেন করণ থাপারকে যে, ‘এর ফলে কিন্তু তিল তিল করে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তোলা একটি বন্ধুত্ব তুমি হারাতে চলেছ। চাইলে আরও একবার ইন্টারভিউ করে নিতে পারো।’
তবু সংকল্পে অটল থাকেন করণ। এবং যা হওয়ার তাই হয়। লালকৃষ্ণ আডবানীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে শৈত্য নেমে আসে। না, মুখোমুখি সৌজন্যে দাগ পড়েনি। কথা, আলাপ, গল্প, সাক্ষাৎ সবই হয়েছে। কিন্তু আন্তরিকতার অভাব যে ঘটছে, তা বুঝতে পারতেন করণ থাপার। সোমবার জেএলএফে করণ থাপার মেনে নিলেন, ‘আডবানীজির অনুরোধে আরও একবার ইন্টারভিউ না করাটা অামার ভুলই হয়েছিল। বইয়েও বলেছি সে কথা।’
বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে অত্যন্ত উষ্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল করণ থাপারের। তবে ওঁর আপশোস- ‘রাজনীতিবিদ’ হিসাবে বেনজির ভুট্টো কখনওই ‘সাংবাদিক’ করণ থাপারের পেশাগত অভিপ্রায় ও অবস্থান বুঝতে পারেননি। বন্ধুত্ব এক জিনিস, আর পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা আরেক জিনিস। করণ বলেন, ‘বেনজির যেহেতু আমার বিশেষ বন্ধু ছিল, তাই ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় ও আশা করত আমি এমন কোনও প্রশ্ন ওকে করব না যাতে ও অস্বস্তিতে পড়ে। বা, থতমত খেয়ে যায়। আসলে বেনজির এটা বুঝতে চাইত না যে, ও যেমন ওর পেশার প্রতি দায়বদ্ধ, তেমনই আমিও আমার পেশার প্রতি সমান দায়বদ্ধ। পেশদার সাংবাদিক হিসাবে আমি তো চাইবই যে বেনজিরকে করা ইন্টারভিউটাও হার্ড হিটিং ও মারকাটারি হোক।’
করণ থাপারকে ইন্টারভিউ দিতে দিতে নরেন্দ্র মোদির উঠে যাওয়ার ঘটনা আজ মিথতুল্য। সেবারও ‘সিএনএন আইবিএন’ চ্যানেলের হয়ে করণ থাপার গিয়েছিলেন ইন্টারভিউ নিতে। এবং সেবারও রাজদীপ সরদেশাই তাঁকে বলেছিলেন, ‘ইন্টারভিউয়ের শুরুতেই এমন প্রশ্ন করো না যাতে বিপত্তি হতে পারে।’ যদিও বাস্তবে করণ বিপরীতটাই করেন। গোধরা কাণ্ড এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থহানির প্রসঙ্গ গোড়াতেই তুলে নরেন্দ্র মোদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আপনার প্রশাসক ভাবমূর্তির উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারছে না। আপনার কি কোনও ধরনের ইমেজ প্রবেলম আছে?
এর খানিকক্ষণ পরেই নরেন্দ্র মোদি ‘আমার তেষ্টা পেয়েছে, জল খাব’ বলে ইন্টারভিউ থেকে উঠে যান এবং সেটাই হয়ে ওঠে বিরাট ‘ব্রেকিং নিউজ’।
জয়া বচ্চনের সামনে করণ থাপার অমিতাভ বচ্চনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বিয়ের পর আপনার জীবনে কতজন নারী এসেছে?’ অমিতাভ বলেন, ‘একজনও না।’ করণ তখন জয়া বচ্চনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন অমিতাভের সামনেই, যে- ‘আপনি বিশ্বাস করেন আপনার স্বামী সত্য বলছে?’
[ রাষ্ট্রপতিকে স্যালুটই সেরা মুহূর্ত, প্যারেডে পুরুষদের নেতৃত্ব দিয়ে বললেন কস্তুরী ]
আবার, এই করণ থাপারের শোতে এসেই টাকা খেয়ে ম্যাচ ফিক্সিং সংক্রান্ত অভিযোগের মুখে পড়ে কপিল দেব হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেই ঘটনা স্মরণ করে করণ বলেন, ‘‘আমি দেখছি কপিল কাঁদছেন। শুরুতে অবাক হলেও, পরের মুহূর্তেই ভাবলাম, বাঃ, এ তো দারুণ ব্যাপার! আমি বরাবর বিশ্বাস করেছি টিভি ইন্টারভিউতে দুটো বিষয় সবসময় হিট করে। এক, যদি বাচ্চারা হাসে। দুই, যদি বড়রা কাঁদে। কপিলকে কাঁদতে দেখে আমি মনে মনে স্থির করে নিলাম, আরও যে পনেরো মিনিট বাকি আছে, এই পুরো সময়টা ধরেই কপিল যাতে কাঁদেন সেইভাবে রুক্ষ্ম প্রশ্ন করে যেতে হবে। আর, আমি সফলও হয়েছিলাম।’
‘ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় তুমি কি সজাগ থাকো যে তোমাকে একটা হেডলাইন ব্রেক করতেই হবে?’ সাগরিকা ঘোষ জানতে চেয়েছিলেন। মৃদু হেসে করণ উত্তর দেন, ‘বিশ্বাস করো, না। আমি প্রতিবার ঈশ্বরকে ডাকি। যেন ভুলভাল কিছু না হয়।’
সাংবাদিকের এহেন অন্তরঙ্গ ঈশ্বর-বিশ্বাসও কি হয়ে উঠতে পারে না একটি আকর্ষক হেডলাইনের উপলক্ষ? কারণ, সোমবারই জেএলএফে করণ থাপার বলেছেন- ‘লালকৃষ্ণ আডবানী ও রাম জেঠমালানি ইন্টারভিউ বানচাল করে দিলেও পরে আবার আমাকে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। অপেক্ষা করছি আরেকজনের জন্য। দেরি হলেও হয়তো বা তিনিও আমাকে পুনরায় একটি পূর্ণাঙ্গ ইন্টারভিউ দিতে রাজি হবেন।’
ইঙ্গিতই যথেষ্ট, সেই ‘আরেকজন’ কে!
The post ইন্টারভিউ দিয়েও তা বাতিল করতে চেয়েছিলেন আডবানী, বিস্ফোরক করণ থাপার appeared first on Sangbad Pratidin.