পাণ্ডিত্যের ভার পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাণ্ডজ্ঞান ও কর্মবুদ্ধির বিনাশ ঘটায়নি। সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়ে আরম্ভ করেছিলেন পুস্তক ব্যবসা। হালের ভাষায় যাকে বলে ‘স্টার্ট-আপ’, বাংলা পুস্তক বিক্রির জগতে সেই স্টার্ট-আপেরই যেন-বা জনক ছিলেন বিদ্যাসাগর– এমন বলা যায়? আজ তাঁর জন্মদিনে বিশেষ নিবন্ধ। লিখলেন অংশুমান কর।
‘তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন– আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না’– সংস্কৃতিবান বাঙালিকে বলে দিতে হয় না যে, এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের, আর যে-মানুষটির কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের এই আত্মসমালোচনা, সেই মানুষটির নাম পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এই বাক্যগুলির অভিঘাত এতই তীব্র যে, অনেক সময়ই আমরা খেয়াল করি না, যে-রচনায় এই মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ রচনায় তিনি বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে আরও বেশ কিছু প্রণিধানযোগ্য বাক্য লিখেছিলেন, চিহ্নিত করেছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মূলগত কিছু বৈশিষ্ট্যকে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর যদিচ ব্রাহ্মণ, এবং ন্যায়শাস্ত্রও যথোচিত অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, তথাপি যাহাকে বলে কাণ্ডজ্ঞান সেটা তঁাহার যথেষ্ট ছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানটি যদি না থাকিত তবে যিনি একসময় ছোলা ও বাতাসা জলপান করিয়া পাঠশিক্ষা করিয়াছিলেন, তিনি অকুতোভয়ে চাকরি ছাড়িয়া দিয়া, স্বাধীন জীবিকা অবলম্বন করিয়া, জীবনের মধ্যপথে সচ্ছলস্বচ্ছন্দাবস্থায় উত্তীর্ণ হইতে পারিতেন না।’ বড় খঁাটি কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যথার্থই বলেছিলেন যে, বিদ্যাসাগরের মতো ‘সবল কর্মবুদ্ধি’ বাঙালির মধ্যে বিরল। অথচ, তঁাকে ঈশ্বর-জ্ঞানে পুজো করতে গিয়ে অনেক সময়ই আমরা তঁার এই কর্মবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে তেমন কথা বলি না।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, ‘কাণ্ডজ্ঞান’ ছিল বলেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বচ্ছন্দে জীবন-নির্বাহ করা সম্ভব হয়েছিল। সরকারি চাকরি যখন বিদ্যাসাগর ছেড়ে দিচ্ছেন, তখন কী ছিল তঁার জীবিকা? পুস্তক-ব্যবসা। বই বিক্রি করতেন তিনি। মূলত পাঠ্যপুস্তক। ১৮৪৮-’৪৯ সাল নাগাদ বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার দু’জনে মিলে খুলেছিলেন ছাপাখানা। নাম দিয়েছিলেন ‘সংস্কৃত যন্ত্র’। খরচ হয়েছিল ৬০০ টাকা। সেই টাকাটি বিদ্যাসাগর ধার নিয়েছিলেন বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। অনতিবিলম্বেই সেই ধার কিন্তু শোধও করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ছাপাখানা খোলার পর সোজা গিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মার্শাল সাহেবকে বলেছিলেন, তঁারা একটি ছাপাখানা খুলেছেন, বই ছাপার বরাত চাই। মিলেছিল বরাত। ভারতচন্দ্রর ‘অন্নদামঙ্গল’ পঁুথি পড়ানো হত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। সে-বইটি ছাপারই বরাত মিলেছিল বিদ্যাসাগরের। এমন নয় যে, বইটি তখন ছাপা ছিল না। বাজারে থাকা ছাপা বইটির মান ভাল ছিল না। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে আদি ‘অন্নদামঙ্গল’ পঁুথি জোগাড় করে যত্ন করে ছাপলেন বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন তর্কালঙ্কার। শুরু হল সংস্কৃত প্রেসের জয়যাত্রা। বই ছেপে ধার তো শোধ হলই, লাভের অতিরিক্ত টাকা বিদ্যাসাগর ব্যয় করলেন প্রেসের উন্নতিকল্পে।
মোটামুটিভাবে সিলেবাসের পাঠ্যপুস্তকই ছাপতেন বিদ্যাসাগর। পাঠ্যপুস্তক-ব্যবসার জগতে প্রায় তৈরি করে ফেলেছিলেন সংস্কৃত প্রেসের মোনোপলি। তথ্য বলছে যে, ব্যবসা শুরু করার প্রায় বছর দশেক পরে, ১৮৫৭-’৫৮ সাল নাগাদ, কলকাতার ৪৬টি প্রেস থেকে প্রকাশ পাওয়া ৫,৭১,৬৭০টি বইয়ের মধ্যে ৮৪,২২০টি বই-ই ছিল সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা। শুধু অবশ্য প্রেস তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি বিদ্যাসাগর। তঁার কাণ্ডজ্ঞান আর কর্মবুদ্ধি-ই তঁাকে বুঝিয়েছিল যে, ছাপা বই যাতে পুস্তক-বিক্রেতারা সহজে সংগ্রহ করতে পারে, তারও একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার। পণ্য বিপণনের দিকে তঁার ছিল সতর্ক দৃষ্টি। তাই সংস্কৃত প্রেসের সঙ্গেই কিছুকাল পরে তৈরি করেছিলেন ডিপোজিটেরি। ‘বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ’ বইয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘সংস্কৃত প্রেস হইতে মুদ্রিত সকল পুস্তক বিক্রয়ের জন্য ডিপোজিটারীতে মজুত থাকিত। ব্যবসাটি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হইয়াছিল এবং বহু বৎসর ধরিয়া ইহা হইতে রীতিমতো লাভ হইত।’
কেমন ছিল সেই লাভের পরিমাণ? তথ্য বলছে, একমাসে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বইয়ের ব্যবসা থেকে সে-আমলে আয় হত বিদ্যাসাগরের। সরকারি চাকরি থেকে তিনি তখন মাইনে পেতেন মাসিক ৫০০ টাকা। সন্দেহ নেই যে, সফল পুস্তক-ব্যবসায়ী ছিলেন বলেই তঁার পক্ষে অকুতোভয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এ-কথাও অনস্বীকার্য যে, সরকারি মাইনের পাশাপাশি এই ব্যবসাটি ছিল বলেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে দরাজ হাতে দানধ্যান করা সম্ভব হয়েছিল। সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ফলে তঁার কর্মজগৎও বিস্তৃতি পেয়েছিল অনেকখানি। ব্রজেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বিদ্যাসাগরের সরকারী কর্ম্ম হইতে অবসরগ্রহণ দেশ ও দশের পক্ষে প্রভূত কল্যাণকর হইয়াছিল।’
হালের ভাষায় যাকে বলে ‘স্টার্ট-আপ’, বাংলা পুস্তক বিক্রি জগতে সেই স্টার্ট-আপেরই যেন-বা জনক ছিলেন বিদ্যাসাগর। পাণ্ডিত্যর ভার কখনওই তঁার কাণ্ডজ্ঞান ও কর্মবুদ্ধির বিনাশ ঘটায়নি। অনায়াসে তিনি তাই মার্শাল সাহেবের কাছে কাজের বরাতের জন্য তদারকি করতে পেরেছিলেন। এখনকার অনেক শিক্ষিত তরুণের মতো ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ তঁাকে গ্রাস করেনি। লক্ষ করেছিলেন, বাংলা ভাষায় ছাপা পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা অপ্রতুল। চিনতে শিখেছিলেন বাজারের দাবি। বলা বাহুল্য, নিজের লেখা বই নিজেই ছেপে এখনকার ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সেল্ফ পাবলিকেশন’– তারও সূচনা করেন বিদ্যাসাগরই।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘বাংলার লোক বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সমাজ সংস্কারক বলিয়াই জানে। তিনি বিধবা-বিবাহ চালাইয়াছেন, বহুবিবাহ বন্ধ করিয়াছেন। তাহারা আরও জানে তিনি পড়ার বই নূতন করিয়া লিখিয়াছেন, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে বাঙালীও ইংরেজের মত স্কুল-কলেজ করিয়া চালাইতে পারে, সর্ব্বপ্রথম দেখাইয়া দিয়াছেন যে সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলাতেও পড়ানো যায়, সর্ব্বপ্রথম সুরুচিপূর্ণ বাংলা বই তিনিই লিখিয়াছেন।’ এর সঙ্গে এখন বোধহয় আরও একটু যোগ করা যায়। বাঙালি হিসাবে বিদ্যাসাগরই প্রথম প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, পূজারি যোগ্য হলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর একত্র আরাধনা সম্ভব– কাণ্ডজ্ঞানযুক্ত মেধা অর্থ উপার্জনের উপায় হতেই পারে।