শ্যাম বেনেগাল অবশ্যই ‘নাশকতার দেবদূত’ নন। তবে এখন যাঁরা ভারতীয় ভাষায় সিনেমা বানাচ্ছেন, তাঁদের কাছে ছাঁচ রেখে গেলেন– কী করে গল্পকে সুচারু সমাধানে নিয়ে যেতে হবে, সে ইশারা-সহ। লিখলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়।
শ্যাম বেনেগালের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সিনেমায় বাস্তববাদের একটি ধারার অবসান হল। ‘বাস্তববাদ’ বলতে যে ধরনের রুচিসম্মত বাস্তবতার বোধ সত্যজিৎ রায় গড়ে তুলেছিলেন ১৯৫৫ সালে ‘পথের পঁাচালী’-র মধ্য দিয়ে, তারই অভিঘাত দেখা দিয়েছিল গত শতকের সাতের দশকের হিন্দি সিনেমায়। বাস্তববাদী অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করতে চেয়ে লেখা একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় উল্লেখ করেছিলেন চারজন ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালকের কথা। তঁাদের দু’জন মণি কউল ও কুমার সাহানি। এঁরা বাস্তব অতিরিক্ত বাস্তবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। বাকি দু’জন এম. এস. সাত্তু এবং শ্যাম বেনেগাল, উভয়ই বাস্তবতার চিত্ররেখা উপস্থিত করেছিলেন, যা সত্যজিতের দ্বারা অভিনন্দিত হয়েছিল।
শ্যাম বেনেগাল শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে সুচারু মেলবন্ধন করতে জানতেন। ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪) আমাদের তা দেখিয়েছে– বিশেষত, গল্প বলার কায়দায়। এমনকী, ভারতীয় সামন্ততন্ত্র নিয়ে মতামত দেওয়ার সময়ও তিনি মাত্রা অতিক্রম করতেন না। সাতের দশকে, পরপর কয়েক বছরে, তিনি এমন চারটি সিনেমা বানিয়েছিলেন, যা এখন কিংবদন্তির স্তরে উন্নীত। এসব সিনেমায় সামন্ততন্ত্রর দঁাত-নখের সামনে নারীদের নতুন করে সম্ভ্রমহীন হতে দেখেছিল ভারতীয় দর্শক। আর, যেভাবে সেটা দেখানো হয়েছিল, তা একদমই ‘স্পেকট্যাকুলার’ নয়। কিন্তু দৈনন্দিন বাস্তবতার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়েছিল, যে, তা মুহূর্তে আমাদের কাছে টেনে নেয়।
ভারতীয় কাহিনিচিত্রের বিরোধিতা শ্যাম বেনেগাল ঘোষিতভাবে করেছিলেন, এমনটা নয়। তঁার সিনেমায় আখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে আদি-মধ্য-অন্তও রয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায় তঁার সিনেমায় খুঁজে পেয়েছিলেন দু’টি বিশেষত্ব– যা কিনা প্রশংসনীয়। প্রথমত, আখ্যানের স্তরগুলি যুক্তি-তর্কের পরম্পরায় নিবদ্ধ। দ্বিতীয়ত, এই বুনটবদ্ধ আখ্যান কখনওই মেলোড্রামাটিক হতে চায়নি। অর্থাৎ, শ্যাম বেনেগাল বাস্তবতার প্রাঙ্গণটিকে উপেক্ষা করেননি। গল্প বলার এই ধরনটি তপন সিংহর সিনেমাতেও পাওয়া যায় বইকি, তবে হিন্দি সিনেমায় এর প্রবক্তা নিশ্চিতভাবে শ্যান বেনেগাল। আত্মীয়তার সম্পর্কে
জুড়ে থাকার পরেও গুরু দত্তর মতো মেলোড্রামাটিক সিনেমা বানানোর দিকে শ্যাম ঝেঁাকেননি। বরং তঁার অনুসরণের পাথেয় হয়েছিল সত্যজিতের সিনেমা, যিনি বাস্তবের মানবিকীকরণের পন্থাটি আমাদের ইতোপূর্বেই দেখিয়ে গিয়েছিলেন।
শ্যাম বেনেগাল যখন ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫) বানান বা ‘ভূমিকা’ (১৯৭৭)– তখন আমরা দেখি– বাস্তবের মধ্যে তিনি একটি অতিরেক যোগ করছেন, এবং সেই অতিরেকটিকে করে তুলছেন সুরেলা। পরে যখন তঁার সিনেমায় (‘জুনুন’ বা ‘মাম্মো’) মুসলিম মহিলারা উঠে আসছেন, তখন আমরা দেখি– মসালা মুভি বানানোর উপকরণ ছেড়ে– তিনি রুচিসম্মত মধ্যবিত্ততার প্রতিকৃতি অঁাকছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তঁার সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, আর এখন বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিও ক্রমশ স্বাভাবিকতা বিসর্জন দিয়ে জটিলতর হচ্ছে– একেও রুচিসম্মত সমাপতন-ই বলব।
শ্যাম বেনেগাল একজন সম্ভ্রান্ত, রুচিসম্মত কথক। অবশ্যই ‘নাশকতার দেবদূত’ তিনি নন। তবে এখন যঁারা ভারতীয় ভাষায় সিনেমা বানাচ্ছেন, তঁাদের কাছে মান্য ছঁাচ রেখে গেলেন– কী করে একটা গল্পকে সুচারু সমাধানে নিয়ে যেতে হবে, তার প্রতি ইশারা নিক্ষেপ করে। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রর বিরুদ্ধে তঁার প্রতিবাদের ভাষ্যে আগুন কখনও কম ছিল না, অথচ এরপরেও তা উচ্চকিত স্বরের হয়ে ওঠেনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ যে-ধরনের সিনেমা, সম্ভবত শ্যাম বেনেগাল সেই ধারাটিকেই অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন আজীবন। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে শ্যাম বানিয়েছিলেন ‘আরোহণ’ (১৯৮২), যা এখানকার ভূমি সংস্কার নিয়ে বামপন্থীদের দিগ্দর্শনের কথা বলে।
সব মিলিয়ে, শ্যাম বেনেগালের প্রয়াণ বয়সোচিত হলেও তা ভারতীয় তথা বাংলা সিনেমার পক্ষে বিশেষ ক্ষতির। কেননা, এখন টিকে থাকার লড়াই চলছে দু’টি ঘরানার মধ্যে। হয় সিনেমাকে হতে হবে শহুরে মধ্যবিত্তর বয়ান, নয়তো অভূতপূর্বভাবে স্পেকট্যাকুলার। ‘অতর’ প্রবৃত্তির দায় নেওয়ার যুগ সম্ভবত শেষ হতে চলেছে।
(মতামত নিজস্ব)