কলকাতার সব রয়েছে। আছে গির্জা– দেড়শো, দুশো, তিনশো বছরের প্রাচীন। সেই গির্জার নিচে কোনও মন্দির ছিল কি না, আমরা খুঁজি না। বরং যিশুকে ঈশ্বরজ্ঞানে প্রণাম করি। পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের রাতে ঠাসাঠাসি করে হাঁটি। আত্মহারা চোখ বলে যেন, যিশুও বাঙালি! লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
গত একশো বছরে অনেক বদলে গিয়েছে কলকাতা। ইউরোপীয়রা একে-একে ফিরে গিয়েছে নিজেদের দেশে। এখন কলকাতায় ইংরেজরা থাকে না। ডাচরা থাকে না। পর্তুগিজরা থাকে না। স্কটিশরা থাকে না। রোমানরা নেই। গ্রিকরা থাকে না। ফরাসিরা থাকে না। অার্মেনীয়রা থাকে না। একসময় কলকাতায় থাকত পারসি এবং অাফগানরাও। তারাও ফিরে গিয়েছে নিজের দেশে। ফেলে রেখে গিয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। তাদের প্রচীন উপাসনাগৃহগুলি রয়ে গিয়েছে। আছে তাদের তৈরি সুবিশাল অট্টালিকা, তাদের কবরখানা। বিজাতীয় সেই সৌধ অামরা বাঙালিরা সযত্নে রক্ষা করছি। চুনকাম করে সাজিয়ে দিচ্ছি। হাতের অালতো পরশ দিয়ে ভালবাসছি। সম্ভ্রম অার সম্মানও জানাচ্ছি মনে মনে।
কলকাতার সব রয়েছে। অাছে গির্জা– দেড়শো, দুশো, তিনশো বছরের প্রাচীন। সেই গির্জার নিচে কোনও মন্দির ছিল কি না, অামরা খঁুজি না। বরং যিশুকে ঈশ্বরজ্ঞানে প্রণাম করি। পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের রাতে ঠাসাঠাসি করে হঁাটি। অাত্মহারা চোখ বলে যেন, যিশুও বাঙালি! বাংলাদেশে যখন মন্দির ভাঙে, মণিপুরে যখন গির্জায় অাগুন জ্বলে, অযোধ্যায় যখন মসজিদ গুঁড়িয়ে যায়, তখন কলকাতায় উৎসবের সমস্ত পদাতিক মিছিল ধ্বজা উড়িয়ে বলে– বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।
এ সাহস কলকাতাই দেখাতে পারে। এই শহর কারও একার নয়। সবার– অামার, তোমার। তিনশো বছর ধরে তিল-তিল করে এই অনন্য বৈচিত্রময় গথিক শৈলীর গির্জাগুলো গড়েছিল যারা, তাদের উত্তরসূরিরা এখন অার খেঁাজও রাখে না। কলকাতা কিন্তু অাগলে রাখে। বিলেতে যখন ‘ক্রিসমাস’, তখন প্রতি বছর উত্তুরে হাওয়ায় ভেসে কলকাতায় অাসে বড়দিন। গির্জায়-গির্জায় জ্বলে ওঠে প্রভু যিশুর অাবির্ভাবের অালো। সান্তাক্লজের লাল টুকটুকে বেশ। ও মা, কবে সে দখল করে নিয়েছে ঠাকুমার ঝুলির অাবেগ! সান্তা নাকি অনেক রাতে চুপি চুপি অাসে, মোজার ভিতর উপহার রেখে যায়। মা ঘুম পাড়াতে পাড়াতে শিশুকে বলে– সান্তা এসো, টিপ দিয়ে যাও।
বড়দিন কলকাতার হিন্দু-মুসলমানেরও উৎসবের দিন। সবাই ভিড় করে গির্জায়। মাছে-ভাতে-নলেন গুড়ের বাঙালি সাহেবি ঢঙে কেক কাটে। মোবাইলে ওঠে এসএমএসের ঝড়, ‘মেরি ক্রিসমাস’। উৎসবের সেই অালো কেউ নেভায় না। কারও মনে হয় না বড়দিন শুধু খ্রিস্টানের, অামার নয়। তিনশো বছর কবে পেরিয়েছে কলকাতার। অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর। বুড়ির তস্য বুড়ি। কিন্তু সে এখনও যেন তিরিশ বছরের তন্বী। বিশৃঙ্খলার গ্রাসে ঐতিহে্যর গায়ে জরা। তবু তাকে বুড়ি মনে হয় না। পূর্ণযৌবনা লাবণ্যময়ী বিকেলে ভোরের ফুল। তাকে ভালবাসতেই হয়। তাকে জড়িয়ে ধরতে হয়। এক হঁাটুজলে ঠনঠনিয়ার দঁাড়িয়েও বলতে হয়– কলকাতায় ছিলাম, কলকাতায় অাছি, কলকাতায় থাকবও।
হয়তো লন্ডন, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, মিলান, রোম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, অামস্টারডাম, মাদ্রিদের মতো শৃঙ্খলায় মোড়া নয় কলকাতা। হয়তো সিডনি, ডারবান, ব্রাসেলস, বার্সিলোনা, জুরিখ, ম্যানহাটনের মতো ঝকঝকে তকতকে নয় তিলোত্তমা। তবুও ভাল থাকার সব গুণ অাছে একমাত্র কলকাতায়। ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত সবাই একসঙ্গে বঁাচে এই শহরে। কারও জন্য দরজা বন্ধ করে না কলকাতা।
কলকাতা হারায়নি তার বিবেক, একতা, বন্ধুত্ব। এখানে রথযাত্রা হয়, দুর্গাপুজো হয়। খুশির ইদের নমাজ হয়। বড়দিনের প্রার্থনা হয়। ময়দানে গুরু গোবিন্দ সিংয়ের জন্মদিনে হালুয়া বিলি হয়। মিছিল করে জৈনরা। ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ ধ্বনিত হয়। এই শহরে হিংসার আগুন জ্বলবে না। বিদ্বেষের বিষবাষ্প উড়বে না। এই শহরে সবাই কথা বলতে পারে। সবাই তার মত দিতে পারে। সবাই চিৎকার করে বলতে পারে, ‘বেশ করেছি’।
কলকাতা স্বাধীন শহর। কলকাতা সাম্যবাদী জনপদ। ভারতের সব রাজে্যর মানুষ দর্পে থাকে কলকাতায়। চাকরি করে। ব্যবসা করে। কলকাতা ধর্ম, উৎসব, রাজনীতি, সিনেমা, গান, কবিতা, ছবি অার প্রেমের শহর। এই শহর মিছিল করে। এই শহর মিটিং করে। এই শহরে জনস্রোত বয়ে যায়। এই শহর ইট ছুড়তে জানে। রক্তে ভিজতে জানে। এই শহর লাঠিপেটা খায়। জলকামানে ভিজে গোবর হয়। তবু হাসিমুখে ঘরে ফেরে। এই শহর অান্দোলন করে। জিতে সাহসী হয়। হেরে হয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশ্বে কলকাতার মতো বিচিত্র অার একটি শহর অাছে কি?
অাসলে যুগে যুগে দেশ-বিদেশের বহু মানুষের উপস্থিতিতে এক নতুন সংবিধান রচনা করেছে কলকাতা। হাজারো সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার। যে-সংবিধানে কোনও দ্বেষ নেই, ক্লেশ নেই, ক্রোধ নেই, বঁাধন নেই। অাছে রাশি রাশি চকোলেট। বড়দিনের ঠিক অাগে মঙ্গলবার বিকেলে এই কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে গড়ের মাঠে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হঁাটতে লাগলাম। ওই যে দূরে পার্ক স্ট্রিট। কত অালো ওদিকে! ময়দানের এই পথে একসময় অনেক হেঁটেছি। সব বয়সে হেঁটেছি। বহুবার মিছিলে হেঁটেছি। মিছিল দেখতে হেঁটেছি। কলম হাতে হেঁটেছি। কখনও অাবার ভেঙে যাওয়া মনে জীবনের বাতাস দিতে প্রাণপণ হেঁটেছি।
সতি্যকথা বলতে কী, কলকাতায় এই একটি এলাকায় এসে অাজীবন নিজেকে খুঁজে পাই। অামাকে দু’-দণ্ড শান্তি দেয়। জীবনের নানা পদে– বিপদে-অাপদে, ভাল-মন্দে, অানন্দে গড়ের মাঠের সুনীল, মেঘময়, শ্বেতশুভ্র অাকাশ দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অাকাশ। যেখানে নিশ্চিন্তে উড়িয়ে দিতে পারি, অামার মনের রঙ্ের ঘুড়ি। যেদিকে খুশি সে যেত পারে। কেউ এসে সেই ঘুড়ি কেটে নেবে না।
কলকাতার বড়দিনের বয়সও তিনশো। এই শহরে প্রথম গির্জাটি কবে তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ অাছে। অনেকেই বলেন এখন যেখানে জিপিও, সেখানে ছিল প্রথম গির্জা। বাংলায় প্রথম গির্জা তৈরি করে পর্তুগিজরা। তার নাম ‘ব্যাসিলিকা অফ হোলি রোজারি’। যা অামরা এখন ‘ব্যান্ডেল চার্চ’ নামে চিনি। ১৫৯৯ সালে এটি নির্মিত হয়। মানে ৪২৩ বছর অাগে। কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা বড়বাজারের ‘অার্মেনিয়ান চার্চ অব দ্য হোলি নাজারেথ’। প্রতিষ্ঠা হয় ১৬৮৮ সালে। কলকাতার সবচেয়ে সুন্দর ও বিশাল গির্জার নাম ‘সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল’। প্রায় দুশো বছর বয়স হতে চলল। অতীতে এই এলাকায় ঘন জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে বাঘ থাকত বলে নানা গ্রন্থে উল্লিখিত। ময়দানে এই গির্জার গঠনশৈলী এখনও সবাইকে মুগ্ধ করে।
১৭৮৪ সালে রাজভবনের উত্তরদিকে সেন্ট জন্স চার্চ নির্মিত হয়। এটিও কলকাতার অন্যতম প্রাচীন গির্জা। গ্রিকদের প্রথম চার্চ নির্মিত হয় ১৭৫২ সালে। ক্যানিং স্ট্রিটে এই চার্চের নাম ছিল ‘গ্রিক চার্চ অফ ট্রান্সফিগারেশন’। এটি এখন আর নেই। ১৮১৫ সালে স্কটিশদের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ তৈরি হয়।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, কলকাতায় কখনও ধর্মীয় স্থানে হামলা হয় না। এই তথ্য খানিক ভুল প্রমাণ করেছিলেন নবাব সিরাজদৌল্লা। তিনি ১৭৫৬ সালে কলকাতা অাক্রমণ করেন। পলাশির যুদ্ধের একবছর অাগে সিরাজের অাক্রমণে দিশাহারা হয়ে ইংরেজরা পালিয়ে যায়। সেই সময় সিরাজের গোলায় ভাঙা পড়ে কলকাতায় একাধিক চার্চ।
সেই ব্যতিক্রমী অধ্যায় পেরিয়ে কলকাতা এখনও দঁাড়িয়ে অাছে ইতিহাসকেই অাশ্রয় করে। সম্প্রীতির পীঠস্থান হয়ে। িদন যায়, রাত যায়, বছর যায়, বড়দিন অাসে, বড়দিন যায়। গির্জায় জ্বলে ওঠে অালো। মাদার মেরির কোল অালো করে অাসে যিশু। ভবানীপুর থেকে মল্লিকবাজার, উল্টোডাঙা থেকে ফুলবাগান, প্রচীনতম কবরে যঁারা ঘুমিয়ে অাছেন, তারা বিজাতীয় হয়েও ভালবেসেছিলেন কলকাতাকে। বড়দিনের অালো পড়ে সেখানেও। কলকাতার উদারবক্ষে।
ইতালির মিলানে গিয়ে লাইন দিয়েও দেখতে পাইনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-র ‘দ্য লাস্ট সাপার’ (শেষ নৈশভোজ) মুরাল। তবু অামার একমাত্র শান্তি এমন এক প্রাচীনতম গির্জার শহর নিশ্চিন্তে ঘুমতে যায়। এখন সেখানে বড়দিনে পথে পথে যিশুর জয়গান। জনগণের সেই মহাস্রোতে কে হিন্দু, কে মুসলমান, অার কে-ই বা খ্রিস্টান!