জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অরুণ মিশ্র বলেছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র জন্যই উপত্যকায় এখন নতুন আলোর ঝলকানি। কিন্তু বাস্তবে, কাশ্মীরে আবারও শুরু হয়েছে বাছাই করে হিন্দু-শিখ হত্যা। শাহ-বন্দনার এক সপ্তাহের মধ্যে ১১ জন অ-মুসলমান খুন হলেন। অর্থাৎ, এত কিছুর পরেও সেই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অরুণ মিশ্র কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র উচ্চকিত প্রশংসা করে বলেছেন, তাঁর জন্যই জম্মু-কাশ্মীরে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। সেই যুগ, রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের মধ্য দিয়ে যার শুরু, তা পুরোপুরি অমিত শাহর মস্তিষ্কপ্রসূত। সুপ্রিম কোর্টের এই প্রাক্তন বিচারপতি আরও বলেছেন, সেই সিদ্ধান্ত ছিল ‘ঐতিহাসিক, সাহসী ও যুগান্তকারী।’ একথা বলতেও তিনি দ্বিধা করেননি, ওই সিদ্ধান্তের দরুন কাশ্মীর এখন ‘শান্তির নিকেতন’। তিন দশকের অন্ধকার পেরিয়ে উপত্যকায় এখন আলোর ঝলকানি।
অরুণ মিশ্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন ছ’-বছর দু’মাস। অবসর গ্রহণের ন’মাসের মাথায় তাঁকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই নিযুক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে বিভিন্ন মামলায় তাঁর রায় কী ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, কীভাবে তাঁর রায়ে ‘সাহারা-বিড়লা ডায়েরি’ মামলায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিড়ম্বনার হাত থেকে বেঁচেছিলেন, অথবা গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পান্ডিয়া হত্যা মামলার নিষ্পত্তি তিনি কীভাবে ঘটিয়েছিলেন, কিংবা কীভাবে সুপ্রিম কোর্টের দুই প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র ও রঞ্জন গগৈয়ের সম্মান রক্ষা করেছিলেন- ওই নিযুক্তির সময় সেসব আতশকাচের তলায় এসেছিল। লোকজন বলাবলি করেছিল, আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন বলেই ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে কর্মক্ষম রাখার বন্দোবস্ত সরকার করে দিয়েছে। কমিশনের ২৮ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির প্রশংসার মধ্য দিয়ে অরুণ মিশ্র সেই প্রশ্নহীন আনুগত্যের আরও এক নমুনা পেশ করলেন। কিন্তু তা করার সময় ভুলে গেলেন, কাশ্মীরি সমাজের বাস্তবতা রাতারাতি কীভাবে ও কতটা বদলে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: আমরা-ওরা করেননি মুজিবকন্যা, উত্তপ্ত বাংলাদেশে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাসিনা]
অমিত শাহ-র বন্দনা ঠিক সেই সময় করা হল, যখন কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলিরেখা গাঢ় করেছে। উপত্যকার ঘড়ি পিছিয়ে গিয়েছে বত্রিশটা বছর। ফিরে এসেছে বেছে বেছে অ-মুসলমান হত্যার দিন। আপেল সংগ্রহ শিকেয় তুলে দলে দলে বিহারি-ছত্তিশগড়ি শ্রমিক ফিরে যাচ্ছেন। কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না কেন্দ্র।
উপত্যকা অশান্ত করতে জঙ্গিদের কৌশল ছিল ‘টার্গেটেড কিলিং’। নিজগৃহে প্রথম খুন হন আইনজীবী টিকালাল টাপলু, ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঠিক দু’মাস পর দ্বিতীয় খুন। প্রাণ হারান হাই কোর্টের বিচারপতি নীলকান্ত গঞ্জু, যিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মকবুল ভাট-কে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তৃতীয় ঘটনাটি ভূস্বর্গে জঙ্গিয়ানার ভিত পাকাপাকি করে দেয়। ভারতের প্রথম মুসলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের ডাক্তার মেয়ে রুবাইয়াকে অপহরণ করে ‘জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট’। পাঁচ জঙ্গির মুক্তির বিনিময়ে রুবাইয়া ছাড়া পেয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর। পরের বছর জানুয়ারি থেকে শুরু ব্যাপক হারে ‘টার্গেটেড কিলিং’। বিধর্মীদের উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি লেখা পোস্টার পড়ে দিকে দিকে। কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। উদ্বাস্তু স্রোতের সেই শুরু, যা থামে চার-পাঁচ লক্ষ পণ্ডিত ও শিখ উপত্যকা ছেড়ে জম্মু, দিল্লি, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলে আশ্রয় নেওয়ার পর। ঠাইনাড়া হননি শুধু তাঁরাই, যাঁদের যাওয়ার কোনও স্থান ছিল না ও যাঁরা অসমসাহসী।
এত বছর পর আবার ফিরে এসেছে সেই কৌশল। শুরু হয়েছে বাছাই করে হিন্দু-শিখ হত্যা।
শাহ-বন্দনার এক সপ্তাহের মধ্যে ১১ জন অ-মুসলমান খুন হলেন। রজৌরিতে জঙ্গি আক্রমণে মারা গেলেন পাঁচ জওয়ান। পুঞ্চে আরও চারজন। সেখানে জঙ্গলে টানা আট দিন ধরে চলছে জঙ্গি-জওয়ান সংঘর্ষ! অথচ ‘নতুন যুগের আলোর ঝলকানি’ দেখলেন অরুণ মিশ্র!
এই শাহ-স্তুতি নিছক নেতা-তোষণ ও ‘ব্যাড টাইমিং’ মনে করা মূর্খামি। বরং সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত। কাশ্মীরের জন্য কষা অঙ্কে গোলমাল ধরা পড়তেই অমিত শাহ ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ হুঙ্কার দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সীমান্তে সন্ত্রাস না কমলে ভারত প্রয়োজনে আরও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হানবে।’ এই মন্তব্য জমিনি-বাস্তবতারই স্বীকৃতি। ‘যুগ-স্রষ্টা’ বোঝালেন, তিন বছরের এত পরিশ্রম পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। উপত্যকা রয়েছে সেই তিমিরেই। বরং আরও খারাপ হয়েছে অবস্থা। নিরাপত্তার ভরসা ও চাকরি দিয়ে যাঁদের উপত্যকায় ফেরানো হয়েছিল, (রাজ্যসভায় সরকারি তথ্য অনুযায়ী তিন হাজার ৮৪১ জন), ‘বাছাই-হত্যা’ শুরু হতে তাঁরা দলে দলে ফেরত যাচ্ছেন সরকারি আশ্বাস ও ঘেরাটোপের নিরাপত্তায় আস্থা হারিয়ে। জম্মুতে তাই জনস্রোতের জোয়ার। সরকার এখন ভিন প্রদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে জেরবার। কেননা, অর্থনীতির কারণে তা জরুরি। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে অধিকাংশই ঘরমুখী।
এই বিপর্যয় থেকে চোখ সরানো সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের হুঙ্কার ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ক্ষমতার পরিধি বিস্তারের অন্যতম লক্ষ্য। অসম ছাড়া আরও যে দুই সীমান্তবর্তী রাজ্যকে এই আওতায় আনা হল- সেই পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবে বিজেপি ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। পাঞ্জাবে পাঁচমাস পর ভোট। সেখানে কংগ্রেসকে উৎখাত করা শাসকের মাছের চোখ। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে নাক কাটা যাওয়ার পর অরুণ মিশ্র-র গড়া মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটিতে ভর দিয়ে বিজেপি হাত-পা ছোড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বিএসএফের বাড়তি ক্ষমতায়নে তারা নব উদ্যমী। সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত পরিধি বিস্তারের অর্থ, কালিম্পং ছাড়া উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলার সিংহভাগে কেন্দ্রীয় খবরদারি নিশ্চিত করা। দক্ষিণবঙ্গে তা হবে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও দুই চব্বিশ পরগনায়। এর ফলে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাত শুধু অনিবার্যই হবে না, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অবনতিও ঘটবে দ্রুত লয়ে। কিন্তু তাতে কী? দিল্লির শাসকের হাতে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী অস্ত্র, যার ঝলকানি গত সাত বছর ধরে দেশবাসীকে দেখানো হচ্ছে।
এবারও সেই ভরসায় শাসকের বুক বাঁধা। বিশেষত, কৃষক আন্দোলনে যখন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে দলীয় ভিত নড়বড়ে। বিজেপি-নিযুক্ত মেঘালয়ের রাজ্যপাল, মিরাটের বাসিন্দা, জাঠ নেতা সত্যপাল মালিক দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন, কৃষক আন্দোলন না মেটালে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। সত্যটা কবুল করে তিনি জানিয়েছেন, মিরাট, মুজফ্ফরনগর, বাগপত্- কোথাও বিজেপি নেতারা গ্রামে ঢুকতে পারছেন না।
সত্যপাল আরও এক ‘সত্য’ কবুল করেছেন। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শেষ রাজ্যপাল তিনিই। তাঁর আমলেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিত। তিন বছর কেন্দ্রের আওতায় থাকা উপত্যকায় অরুণ মিশ্র যখন ‘নতুন যুগের আলোর ঝলকানি’ দেখছেন, সত্যপাল তখন বলছেন, তাঁর আমলে জঙ্গিরা শ্রীনগরের চৌহদ্দিতে ঢুকতে ভয় পেত। এখন নাকের ডগায় নির্ভয়ে অপকর্ম করে চলেছে। সহজ কথায়, এর মানে এত কিছুর পরেও সেই থোড়-বড়ি-খাড়া, আর খাড়া-বড়ি-থোড়। সাত মণ তেল পুড়েছে, রাধার নাচ কিন্তু দেখা যায়নি!
শাসক-অনুগত ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর পরিসংখ্যান, কাশ্মীরে তিন বছরে সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটেছে ২৩০টি, দু’বছরে সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে ৩৯৩ জন, গ্রেফতার ৩৬৩, সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে ৫৭টি। সরকারি স্বীকারোক্তি, আফগানিস্তানে পালাবদলের পর পরিস্থিতি ভয়াল হওয়ার আশঙ্কা। কারণ, পাকিস্তান দ্বিগুণ উৎসাহিত ও উজ্জীবিত।
কিন্তু তাতে কী?
উগ্র জাতীয়তাবাদী তাস তো হাতেই। পুজোর আবহে বাংলাদেশে তাণ্ডব বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদী পালের বাড়তি বাতাস। কাশ্মীরের ভাগ্যে যা-ই থাকুক, আর-একটা বালাকোট হয়তো আসন্নপ্রায়। হুমকি খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে তা ঘটলে সেটাই রাষ্ট্রনীতির ‘নতুন যুগ’।