শংকর: দেখতে দেখতে আর-একটা বছর কাটানো গেল। চৈত্রমাসের শেষদিনে এই লেখা লিখতে বসে কত কথাই তো মনে আসছে। প্রতি বছরেই তো এই দিনে বিশেষজ্ঞদের হা-হুতাশ, নিত্য প্রয়োজনীয়র দাম বাড়ছে এবং একই সঙ্গে মানুষের দাম কমছে। যে-সময়ে জন্মেছিলাম তখন আমরা পরপদানত, পরাধীন। কেউ প্রকাশ্যে এবং অনেকে গোপনে ভাবত, দেশ স্বাধীন হলে এই সমস্যার অবসান হবে। ইংরেজ আইসিএস এত পড়াশোনা করেও জানে না, সেদিনও টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: রামকে কেন ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ বলা হয়]
গ্রামের মেয়েরা ইংরেজ শাসকের বিরোধী নয়, তবু তাঁরা ছড়া কাটতেন, ‘চাইলা জিরা, পাইলা হিরা!’ ইঙ্গিতটা বিলেতে সমিতিবদ্ধ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিকে, যারা মশলার ব্যবসা করার জন্য এদেশে এসে পাকেচক্রে হিরের মুকুট মাথায় পরল। কেউ কেউ বলল, শাসকরা দু’রকম– সু-ইংরেজ এবং কু-ইংরেজ। কেউ কেউ হতাশ হয়ে বলল, মাথার উকুন এইভাবে বাছা যায় না, গেলে সবাই যাবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সে মস্ত ইতিহাস। ডজন ডজন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, লাইফ সায়েন্স, কম্পিউটার প্রযুক্তির বইয়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা আজকের ছেলেমেয়েরা অতীতের শবব্যবচ্ছেদের সময় পায় না, তারা ওসব বিষয় নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। নেতাদের নেতারাও মহাব্যস্ত, তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে প্রতিশ্রুতির সনদ প্রকাশ করেন। পরস্পরের মধ্যে প্রতিশ্রুতির প্রবল টেক্কা– লক্ষ্য একটাই, কোন প্রতিশ্রুতি কত ভোট টানবে।
তবু মানুষের কষ্ট কমে না, শায়েস্তা খাঁ-র সময়ের টাকায় আট মন চাল, পঞ্চাশের মন্বন্তরে চল্লিশ টাকা মন হয়। যাঁরা সংখ্যাতত্ত্ব জানেন, তাঁরা বলেন, ৩২০ গুণ দাম বাড়ল সায়েবদের দোষে। আবার কেউ কেউ বললেন, হনুমানের দোসর সুগ্রীবরাও রয়েছে, তারাও তো
লুটেপুটে খাচ্ছে। এদের খাঁচায় পোরো, ওদের তাড়াও, যে-দেশ থেকে এসেছে সেখানে ফেরাও।
আরও ক’বছর পরে মন্বন্তরের ৪০ টাকা মন ৪০ টাকা কেজি হল। যাঁরা এসব বোঝেন, তাঁরা বললেন– এরই নাম ‘মুদ্রাস্ফীতি’। জল পড়ে, পাতা নড়ে, দাম বাড়ে। আরও বাড়বে, কত হারে বাড়বে সেটাই চ্যালেঞ্জ। তবু এখনও চৈত্র সেল আসে, কিছু মানুষ কয়েক দিন ছোটাছুটি করে। সবাই স্বীকার করে নেয়– সস্তাই সুন্দর, আবার বিচক্ষণ ব্যক্তিরা বলেন, সাবধান, এই কঠিন পৃথিবীতে কোনও সুন্দরই সস্তা নয়। সবকিছুই কড়ি দিয়ে কিনতে হয়।
তবু নববর্ষ আসে। একসময় এই বৈশাখী দিন কেন্দ্র করে ছিল সব মধ্যবিত্তের বিপুল ব্যস্ততা। এই সেদিনও একগোছা ছাপানো নিমন্ত্রণ আসত মুদিখানা, মনোহারি এবং কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বইয়ের দোকান থেকে। দোকানের মালিকরা লাল রঙের নতুন খেরোর খাতা নিয়ে ছুটতেন স্থানীয় কালীমন্দিরে, তারপর হাজির হতেন ময়রার দোকানে বোঁদের অর্ডার মনে করিয়ে দিতে।নববর্ষের হালখাতা নিয়ে এত হইহই কেন বুঝতে পারতাম না। তথ্যাভিজ্ঞদের মুখে এক সময় শুনেছিলাম– ওদিনে গৃহস্থরা দোকানে আসেন দোকানির দেনা মিটিয়ে দিতে এবং মিষ্টি খেয়ে আবার বাড়ি ফিরে যেতেন।
পাঁজিতে একটা প্রাচীন ছবি বহু বছর ধরে পুনর্মুদ্রিত হত, এখনও হয়। একটা কাঠের ক্যাশবাক্স নিয়ে বিনয়ী দোকানি আসর আলো করে বসে আছেন, একদিনের জন্য সরিয়ে দিয়েছেন কাচের ফ্রেমে বাঁধানো ‘আজ নগদ কাল ধার’ বিজ্ঞপ্তিটা। পঞ্জিকার ছবিতে খরিদ্দারও উপস্থিত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এবং তাঁর পাশেই ফ্রকপরা বালিকা-কন্যা, দু’জন গেলে দু’-প্যাকেট মিষ্টি পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা।
বঙ্গীয় ১৪২৮-এর ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে। পাঁজির দোষ ধরতে নেই, কিন্তু না বলে আমরা যে আধুনিক হতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছি, তার প্রমাণ কোথায়? কাঠের ক্যাশবাক্স তো অনেক আগেই উধাও। লাল রঙের একটা খেরোর খাতা এখনও কেনা হয়, তাতে সিঁদুরমাখা রুপোর টাকার ছাপও মন্দিরে দেওয়া হয়। কিন্তু হিসাব এখন খাতায় লেখা হয় না। প্রিন্ট হয় ডিজিটাল যন্ত্রে। আরও দুশ্চিন্তা– খরিদ্দার, দোকানি, দোকান-কর্মী কেউ আর ধুতি পরে না। বড়বাজারে খবর নিলে জানবেন, বিধবার থান, বাবুর ধুতি আর তৈরিই হয় না। যা অবস্থা, তাতে শাড়িও টিকবে বলে মনে হয় না। এখন সালওয়ার ও হাফপ্যান্ট পরা বউমাদের যুগ। ‘হাফপ্যান্ট’ কথাটা অসভ্য, বলতে হয় ‘বারমুডাস’। আরও দুঃসংবাদ, ‘আজ নগদ কাল ধার’ যুগ থেকে আমরা এখন এসে গিয়েছি আজ ধার, কাল ধার, পরশু ধারের যুগে। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, তুমি যুগ যুগ জিও।
বইপাড়ায় মন্দ দিন ছিল না এই নববর্ষ। সবাই নতুন বই বের করত, দেশের দোকানদাররা আসত কলকাতায় গত বছরের দেনা মিটিয়ে কিছু নতুন বই নিয়ে যেতে। গত কয়েক বছর ধরে এই নববর্ষে বেজায় ভাটা। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর– লেখক আছে, কাগজ আছে, কালি আছে, ছাপাখানা আছে, দোকানদার আছে, কিন্তু পাঠক তেমন নেই। সবাই এখন ভার্চুয়াল যুগে চলে যাচ্ছে, বইয়ের প্রিন্ট অর্ডার তিন হাজার থেকে আড়াই হাজার এবং তারপরে ক্রমশ অধঃপতনের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আড়াইশোয় নেমেছে। অফসেট যুগে আপসেট হওয়ার কিছু নেই, খুব শীঘ্রই আরও কমতে পারে মুদ্রণ সংখ্যা।
তাহলে লেখকের কী হবে? সে কি না-খেয়ে মরবে? তাকে তো কোনও ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ড দিতে চাইছে না। প্রাচীন বিত্তবান পুস্তক ব্যবসায়ীরা বলছেন– চিন্তা করবেন না, লেখাই একমাত্র বৃত্তি, যা মৃত্যুঞ্জয়ী। মরার পরে একমাত্র লেখকরাই তো নতুনভাবে বেঁচে ওঠার দুর্লভ সুযোগ পান, ওঁদের তো হোল লাইফ ইনসিওরেন্স পলিসি, বেঁচে থাকার কালে কেবল জনমজুরের ‘খোরাকি’, মরার পরে অবশ্যই মাল্যদান এবং অমরত্বের দুর্লভ সুযোগ। শৃণ্বন্তু বিশ্বে লেখকদের মৃত্যু নেই, মরার পরেই তাঁদের জেগে ওঠা।
তাহলে? সম্ভাব্য সকল লেখকই কি সেক্টর ফাইভে নাইট ডিউটিতে হারিয়ে যাবেন? যাঁরা আশাবাদী তাঁরা বলছেন, ‘ভয় নাই ওরে ভয় নাই’, বিশ্বজুড়ে এই বেঙ্গলি ভাষা। দুনিয়ায় ১৬+ ৯+১ = ২৬ কোটি বঙ্গভাষী, চিন্তা কী? মুখ পুড়েছে, কিন্তু ফেসবুক তো আছে, একটা কিছু হবেই এই ডিজিটাল যুগে। তাহলে ১৪২৮-এর নববর্ষে কিংকর্তব্যম? দোকানদাররা বলছেন– দেনা থাকলে মেটান, ভুল করে থাকলে নিজেকে সংশোধন করুন। দেশের সিনিয়র সিটিজেনরা কোভিড স্টক ক্লিয়ারেন্স সেলে প্রায় নিঃশেষিত, তাঁরা আর কোন ত্রুটি সংশোধন করবেন? তবু একটা কিছু ভ্রম সংশোধন তো করতেই হবে।
মনে পড়ে গেল, বহু বছর আগে উৎসাহভরে ছাপার অক্ষরে লিখে ফেলেছিলাম, দুর্গোৎসবই বাঙালির বৃহত্তম উৎসব। তখনও পূর্ব পাকিস্তান রয়েছে, ঢাকায় বেড়ে ওঠা বিলেতনিবাসী একজন বঙ্গীয় পাঠক লিখে পাঠালেন– মহিষাসুর ও দুর্গা হিন্দু বাঙালির বৃহত্তম উৎসব,
ওটা নিখিল বাঙালির বৃহত্তম উৎসব নয়। তাঁকে লিখলাম, তাহলে আমাদের বৃহত্তম উৎসব কোনটা? তিনি নির্দ্বিধায় জানালেন– বিশ্ববাঙালির বৃহত্তম উৎসব অবশ্যই পয়লা বৈশাখ। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনি জানালেন, বাংলায় অনভ্যস্ত নিউ জেনারেশন ‘১লা বৈশাখ’-কে ‘একলা বৈশাখ’ বলে। ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে আমরা অনেকেই প্রকৃত অর্থে একলা। তবু সবাই মিলে একবার বলা যাক–বেঁচে থাক আমাদের নববর্ষ, পয়লা বৈশাখ যুগ যুগ জিও।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: নিচু জাতের মানুষই কর্মহীন হয়েছে বেশি]
(মতামত নিজস্ব)