সব্যসাচী বাগচী: তখন ঈশান কিষাণ (Ishan Kishan) ও শুভমান গিল (Shubman Gill) সবে ক্রিজের দিকে এগিয়েছেন। ভারত যে রেকর্ড গড়ে অষ্টমবার এশিয়া কাপ (Asia Cup 2023) জিততে চলেছে সেটা তো আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মহম্মদ সিরাজ (Mohammed Siraj)। তাই সংবাদ প্রতিদিন.ইন-এর তরফ থেকে ফোন গেল হায়দরাবাদে। এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে (Sri Lanka) একার হাতে উড়িয়ে দেওয়া ২১ রানে ৬ উইকেট নেওয়া সিরাজের কোচ কে সাই বাবা-র (K Sai Baba) কাছে। ছাত্রের এমন আগুনে স্পেল থেকে স্বভাবতই উচ্ছ্বস্বিত এই ক্রিকেট প্রশিক্ষক। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “মহম্মদ সিরাজ হতে দম লাগে।” যে ভাবে সিরাজ উত্থান ঘটিয়েছেন, সেটা থেকেই বোঝা যায় তিনি সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নন।
বলছিলেন, “অ্যাকাডেমিতে কিছু কাজ ছিল। তাই ছেলেদের অনুশীলন দ্রুত শেষ করিয়ে ম্যাচ দেখতে বসে গিয়েছিলাম। এত দ্রুত শ্রীলঙ্কার ইনিংস শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। এমন ম্যাড়ম্যাড়ে ফাইনাল কে দেখতে চায় বলুন! তবে মন ভরে গেল সিরাজের বোলিং দেখে। শুরুটা করেছিল জশপ্রীত বুমরাহ। শেষটা হার্দিক পাণ্ডিয়া। তবে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংকে আমার সিরাজ একাই উড়িয়ে দিল। এটা দেখে ভালো লাগছে।”
[আরও পড়ুন: কীভাবে মহানুভবতার পরিচয় দিলেন এক ওভারে চার উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা হওয়া সিরাজ?]
সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপের ফাইনালে তাঁর বোলিং ফিগার চমকে দেওয়ার মতো। এক ওভারে চার উইকেট। বিপক্ষকে ময়দানের দ্বিতীয় ডিভিশনে পরিণত করা সিরাজের বোলিং ফিগার ৭-১-২১-৬। এরমধ্যে ইনিংসের চতুর্থ ও নিজের দ্বিতীয় ওভারেই নিয়েছিলেন চার উইকেট। এক ওভারে পথুম নিশাঙ্কা, সাদিরা সমরবিক্রমা, চরিথ আসালাঙ্কা এবং ধনঞ্জয় ডি সিলভার উইকেট তুলে নেন সিরাজ। ব্যস সেখানেই শ্রীলঙ্কা ব্যাকফুটে চলে যায়।
যদিও তাঁর কোচের কাছে কুশল মেন্ডিসকে বোল্ড করাই সেরা। কিন্তু কোন ছকে সিরাজ বিপক্ষ ব্যাটিংকে একাই বুঝে নিলেন? সাই বাবা যোগ করলেন, “ম্যাচের আগের রাতে কয়েক মিনিটের জন্য সিরাজের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভালো করে লক্ষ্য করবেন, সিরাজ কিন্তু সাধারণত ক্রস সিমে বল করে। কিন্তু এই ম্যাচে সিম ধরে বল করেছে। তাই ইনসুইংয়ের থেকে আউটসুইং বেশি হচ্ছিল। সেটাই সিরাজ খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাটার আউটসুইংয়ে আউট হয়েছে। তবে এই পারফরম্যান্স বিশ্বকাপেও ধরে রাখতে হবে।”
সিরাজের ক্রিকেটার হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর স্বর্গীয় বাবা মহম্মদ ঘউসের অক্লান্ত পরিশ্রম ও লড়াই। হায়দরাবাদের ফার্স্ট ল্যান্সার বস্তিতে জন্ম সিরাজের। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অটোচালক বাবার পক্ষে ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তবুও ছেলের ইচ্ছেপূরণের খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন ঘউস। দুই কিলোমিটার দূরে স্পোর্টস কোচিং ফাউন্ডেশনে নিয়ে যান সিরাজকে। কিন্তু সেখানে বেতন দেওয়ার মতোও আয় ছিল না। তবুও সিরাজের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ছোটবেলার কোচ সাইবাবা-কে। খুদে সিরাজের বোলিং দেখেই চমকে ওঠেন কোচ। কী বলেছিলেন ঘউসকে? সিরাজের কোচের প্রতিক্রিয়া, “আমি কয়েকটা বল দেখার পরেই ওর বাবাকে গিয়ে বলি, কোনও বেতন লাগবে না। আপনার ছেলের মধ্যে দারুণ প্রতিভা রয়েছে। ওকে আমার হাতে তুলে দিন। এরপর কিন্তু নিজের দমেই সিরাজ এগিয়ে গিয়েছে।”
[আরও পড়ুন: ছয় উইকেট নেওয়া সিরাজের কাণ্ডকারখানা দেখে হেসে লুটোপুটি বিরাট! দেখুন ভাইরাল ভিডিও]
সিরাজ কতটা সাহসী ও লড়াকু সেটা এই ফাইনালে ফের দেখা গিয়েছে। তবে তাঁর কোচ শোনালেন এক আনটোল্ড স্টোরি। বলছিলেন, “অনূর্ধ্ব-১৪ বিভাগের ম্যাচে ব্যাট করার সময় ইয়র্কার আছড়ে পড়ে সিরাজের পায়ে। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার পরে দেখি চোটের জায়গাটা নীল হয়ে গিয়েছে রক্ত জমাট বেঁধে। ভেবেছিলাম, এই ম্যাচে ওর পক্ষে বল করা সম্ভবই না। কিন্তু আমাদের বোলিং শুরু হওয়ার পাঁচ ওভারের মধ্যেই হঠাৎ এসে বলে আমি বল করব। বলেছিলাম, ভেবে দেখ। পা তো এখনও ফুলে আছে। নাছোড় সিরাজ মাঠে নামল। এমনকি ছোট স্টেপে বল করে তিন উইকেট নিয়ে জিতিয়ে দিল আমাদের।”
বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে দেশে ফিরে আসেননি সিরাজ। যে বাবা আজীবন লড়াই করে অর্থ উপার্জন করেছেন। শুধুমাত্র তাঁর ছোট ছেলেকে দেশের জার্সিতে খেলতে দেখবেন বলে। বাবার সেই স্বপ্নের কথা মাথায় রেখে সিরাজ জানিয়ে দেন, দেশে ফিরবেন না। বাকিটা কী ঘটেছিল সেটা তো সবাই জানে। এবারও শুধু স্কিল নয়, সঙ্গে ছিল মনের অদম্য জোর। সেটা সম্বল করেই বাইশ গজের যুদ্ধে আগুন জ্বালিয়ে চলেছেন ‘মিয়া ম্যাজিক’।