shono
Advertisement

বাংলা খেয়াল দস্তুরমতো সম্ভব

কবীর সুমনের সাপ্তাহিক কলাম। The post বাংলা খেয়াল দস্তুরমতো সম্ভব appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 03:51 PM Sep 01, 2018Updated: 04:21 PM Sep 01, 2018

হিন্দি, হিন্দুস্তানি, ভোজপুরি, মূলতানি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, রাজস্থানি, মারাঠি এমনকী দরি (ফারসির একটি ডায়ালেক্ট)- এই এতগুলি ভাষায় খেয়াল রচিত ও গাওয়া হয়ে থাকে। এতে বাঙালির কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু বাংলায় খেয়াল রচনায় ও গাওয়ায়। ভারতের অন্য ন’টি ভাষায় যদি খেয়াল রচনা করা ও গাওয়া যায় তাহলে বাংলা ভাষাতেই বা যাবে না কেন! লিখেছেন কবীর সুমন

Advertisement

A genius is not a person who knows or who can do a lot of things; a genius is a person who understands the importance of things.’
George Bernard Shaw

হিন্দুস্থানি সংগীতের খেয়াল আঙ্গিকটি তৈরি হয় মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার (১৭০২-১৭৪৮) দরবারে অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে। তার আগে দরবারে ধ্রুপদ গাওয়া হত। ধ্রুপদের আঙ্গিক ও পরিবেশনার কঠোরতা লোকের আর ভাল লাগছিল না– বিশেষ করে রাজদরবারে। আরবি ভাষায় ‘খেয়াল’ মানে কল্পনা। কল্পনার আশ্রয় নিয়ে ‘খেয়াল’ আঙ্গিকটি তৈরি করা হয় ধ্রুপদের কঠোর নিয়মনিষ্ঠা দূর করে ধ্রুপদী কণ্ঠ সংগীতে আরও বেশি স্বাভাবিক আলোবাতাস খেলানোর জন্য। প্রেমও হয়ে ওঠে বিষয়। ছোট বড় তান ও স্বরালংকার হয়ে পড়ে গায়কির অঙ্গ। বিভিন্ন গুণী শিল্পীর অবদানে খেয়াল হয়ে ওঠে হিন্দুস্তানি কণ্ঠ সংগীতের এক সচল আঙ্গিক।

কিন্তু কথা বা লিরিকের দিক দিয়ে খেয়াল হয়ে পড়ে একঘেয়ে। খেয়ালের লিরিককে বন্দিশ বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন রাগ আর গায়কির বৈচিত্রের মধ্য দিয়ে খেয়াল সুর তাল ছন্দে দিনে দিনে আরও গতিশীল ও জৌলুসময় হয়ে উঠলেও খেয়ালের বন্দিশের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় প্রধানত রাধাকৃষ্ণের লীলা, যমুনার ধারে সখীদের খেলা, শাশুড়ি-ননদের গঞ্জনা, বসন্তকালে কোকিলের ডাক আর ফুলের বাহার, বর্ষায় বিদ্যুতের ঝিলিক, বৃষ্টিপাত, ময়ূরের নাচ। খেয়ালগান বা বন্দিশের এই একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির একটা বড় কারণ ছিল- প্রসিদ্ধ খেয়ালশিল্পীরা খেয়ালের বন্দিশ লিখতেন। এঁরা ছিলেন সুর ও গায়কির জাদুকর, কিন্তু বন্দিশ রচনায় এঁদের পারদর্শিতা ছিল না। এর ফলে খেয়ালে সুর-তাল-ছন্দ-গায়কি এবং বন্দিশের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব গোড়ার থেকেই ছিল, যেটার ফলে অনেকে এমনকী ধরেই নিয়েছিলেন যে খেয়ালে কথার কোনও গুরুত্ব নেই। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে এই মনোভাবকে খণ্ডন করে এক জায়গায় লিখেছিলেন- খেয়ালে কথার কোনও গুরুত্ব যদি না-ই থাকে তাহলে টেবিল, চেয়ার, খাট এসব শব্দ দিয়ে বন্দিশ লিখলেই তো হয়। কিন্তু সেটা তো লোকে লেখে না।

বিংশ শতাব্দীতে যখন বাংলায় খেয়াল লেখা ও গাওয়া শুরু হল তখন সুর ও কথার সেই দ্বন্দ্বটাকে বাংলা খেয়াল উত্তরাধিকার হিসাবে পেল। আশ্চর্য, খেয়ালের বন্দিশ যে আরও আধুনিক ও স্বাভাবিক হওয়া দরকার তা বাংলার খেয়ালরচয়িতা ও শিল্পীরা ভেবে দেখেননি। বাংলা ভাষায় গান রচনার ক্ষেত্রে যে জোয়ার এসেছিল বিংশ শতাব্দীর মোটামুটি প্রথম দিকে তার প্রভাব বাংলা বন্দিশ রচনায় পড়েনি। হিন্দি, হিন্দুস্তানি, ভোজপুরি, মূলতানি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, রাজস্থানি, মারাঠি এমনকী দরি (ফারসির একটি ডায়ালেক্ট)- এই এতগুলি ভাষায় খেয়াল রচিত ও গাওয়া হয়ে থাকে। এতে বাঙালির কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু বাংলায় খেয়াল রচনায় ও গাওয়ায়। ‘আকাশবাণী কলকাতা’ কিছুতেই বাংলায় খেয়াল গাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না- এ নিয়ে বিষ্ণুপুর ঘরানার কণ্ঠশিল্পী সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আকাশবাণী কলকাতা কর্তৃপক্ষের বিবাদ হয়। এই বিবাদ মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। সংগীতের ইতিহাসবেত্তা ও গবেষক রন্তিদেব মৈত্র আমায় জানিয়েছিলেন- কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করে সত্যকিংকর হেরে গেলেও সুপ্রিম কোর্টে তিনি জিতে যান। সাব্যস্ত হয়- খেয়াল বাংলা ভাষায় বিলক্ষণ গাওয়া যেতে পারে এবং আকাশবাণী তা সম্প্রচারও করবে। তার আগে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বাংলায় খেয়াল গাওয়া নিয়ে সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বিবাদ বিষয়ে কলকাতার নানা পত্রিকায় যেসব খবর বেরয়, তা নিয়ে কলকাতা-সফররত তখনকার কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী বি. ভি. কেশকারকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি জানান– ভারতের নাগরিকদের যার যার মাতৃভাষায় খেয়াল গাওয়ার অধিকার আছে এবং তা আকাশবাণী থেকে প্রচারও করা যাবে। এই খবরটি সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নিবন্ধেই আছে। অথচ বাংলার অনেকেই কেন জানি না দীর্ঘকাল মানতে চাননি যে বাংলা খেয়াল দস্তুরমতো সম্ভব। ভারতের অন্য ন’টি ভাষায় যদি খেয়াল রচনা করা ও গাওয়া যায় তাহলে বাংলা ভাষাতেই বা যাবে না কেন!

মামলায় আচার্য সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চূড়ান্ত জয়ের পর আকাশবাণী কলকাতা তাঁকে বাংলায় খেয়াল গাওয়ার জন্য কন্ট্র্যাক্ট পাঠায়। যতদূর জানি তিনি ওই একবারই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বাংলা খেয়াল গাইতে পেরেছিলেন। তার পর বার্ধক্যের কারণে তিনি মারা যান। সব খবরই শ্রী রন্তিদেব মৈত্রর কাছে পাওয়া। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ কোথাওই বাংলা খেয়াল সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্য সংগীত অ্যাকাডেমিতে বাংলা খেয়াল বিষয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করল ২৭ আগস্ট। এটি চলল ৩০ আগস্ট পর্যন্ত। ২৯ জন নবীন সংগীতশিক্ষার্থী সেই কর্মশালায় অংশ নিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির দীর্ঘ ইতিহাসে বাংলা খেয়াল প্রথম সরকারি স্বীকৃতি পেল।

এতকাল ধরে বাংলার সংগীত শিক্ষার্থীদের হিন্দুস্তানি রাগসংগীত ও খেয়াল শেখানো হচ্ছিল হিন্দি খেয়ালের মাধ্যমেই। ভাষার এই দূরত্বের কারণে খেয়াল আঙ্গিকটির জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমছিল। হিন্দিতে খেয়াল শিখতে গিয়ে ভাষার দুর্বোধ্যতার কারণে অসুবিধে হচ্ছিল বাংলার ছেলেমেয়েদের। বাংলা ভাষায় খেয়াল চালু হয়ে গেলে ভাষার দূরত্ব থাকবে না, ফলে আরও শ্রোতা খেয়াল শুনতে আগ্রহী হবেন হয়তো। আর মাতৃভাষায় খেয়াল শেখার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীদেরও সুবিধে হবে অনেক।

(মতামত নিজস্ব)
kabirsuman2013@gmail.com

The post বাংলা খেয়াল দস্তুরমতো সম্ভব appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার