সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘যুদ্ধ বাধাইতেসেন না কি?’ ঢাকায় আসা ইস্তক এই প্রশ্নটা শুনতে হচ্ছে। বিরামহীন।
শেষ ফাল্গুনের এই সময় ঢাকা বড়ই মনোরম। সকাল-সন্ধে মিহি মিহি। দুপুর তেজি হলেও সেই তেজ শরীর-মনকে এখনও হাঁসফাঁসানির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি। শঙ্কা ও বিতর্কের অবিরাম ঢেউ সামলে সংসদীয় ভোট চুকে গিয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। দেখতে দেখতে তাও প্রায় মাস আড়াই হয়ে গেল। ভোটের রেশ অবশ্য রিনরিন করে জেগেই আছে। ধাপে ধাপে শুরু হয়েছে উপজেলার ভোট। আমাদের দেশের ত্রিস্তরীয় শাসনব্যবস্থায় পঞ্চায়েত সমিতির সমতুল্য এই উপজেলা পরিষদ। এই প্রথম উপজেলা পরিষদের ভোট হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। গ্রাম পঞ্চায়েত তুল্য ইউনিয়ন পরিষদের ভোটও হয়েছে দলীয় প্রতীকে। এ দেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষজন বলেন, দলহীন পঞ্চায়েতকে ‘গুড বাই’ জানানোর এই কায়দাটা তাঁরা রপ্ত করেছেন পশ্চিমবঙ্গকে দেখে। ভাল কথা। তাতে দেশ ও রাজনীতির ভাল হলে ভাল।
[ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অবস্থান বিক্ষোভে পড়ুয়ারা]
কিন্তু জেলা পরিষদের প্রথম দফার যে ভোট হয়ে গেল, কী আশ্চর্য, তাতে কারও আগ্রহ রয়েছে বোঝাই গেল না! কারণটা হয়তো আড়াই মাস আগের একতরফা সংসদীয় ভোট ঘিরে বিতর্ক। বয়কটের রাস্তা থেকে সরে এসে সেই ভোটে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু গোহারা হারে তারা। সম্ভবত সেই কারণে বিপর্যস্ত বিএনপি আরও একবার পর্যুদস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি। ভোট বয়কটের পুরনো রাস্তায় তারা ‘হাঁটা’ দিয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (‘ডাকসু’) ভোট ঘিরে রাজনীতি ফের গমগম করে উঠেছে। হওয়ারই কথা। ভোট হল দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পর। হাই কোর্টের আদেশে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ভঙ্গুর বলে ‘ডাকসু’ বা প্রেস ক্লাবের ভোটের দিকে গোটা দেশ চেয়ে থাকে। ক’দিন ধরেই তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর চনমনে। তারুণ্যে প্রাণ ফিরেছে যেন। হইহই করে প্রচার চালিয়েছে শাসক, বিরোধী ও নির্দলীয় প্রার্থীরা। একটা উৎসব-উৎসব ভাব।
এই ব্যস্ততা ও ঝমঝমানির মাঝে ‘যুদ্ধ’ সম্পর্কিত প্রশ্নটা যতই বেমানান হোক, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলেই তা শুনতে হচ্ছে। অবশ্য উত্তরটাও দিতে ভুলছেন না তাঁরা। বলছেন, ‘ভোটের সময় নানা ধরনের বাজনা বাজে। যুদ্ধের এই বাজনাটা একটু অপরিচিত এই যা।’
অবস্থানগত কারণেই ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভারত যত মাথা ঘামায়, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের ভোট নিয়ে তার চেয়ে বহু, বহুগুণ বেশি আগ্রহী। সেই ভোটের আগে আচমকা ঘটে যাওয়া পুলওয়ামা কাণ্ড ও তার বদলা ঘিরে যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি রাজ্যে রাজ্যে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেই প্রভাব ক্ষমতাসীন দলকে কতটা সাহায্য করতে পারে, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মাঠে নামা কংগ্রেসের পালে কতটা বাতাস দেবে, নরেন্দ্র মোদি প্রতাপ অটুট রেখে দ্বিতীয়বার ফিরবেন কি না অথবা পশ্চিমবঙ্গের মমতা-দুর্গে মাথা ঠুকে এবারও বিরোধীরা রক্তাক্ত হবে কি না– এ নিয়ে বাংলাদেশে চলছে প্রবল গবেষণা। সেই কারণেই ‘ভারতীয় অতিথি’-র কাছে যুদ্ধ বাঁধানোর প্রশ্নটা এবার যেন সম্বোধনের পর্যায়ে উঠে এসেছে।
এমনিতে রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ স্থিতিশীল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে আগামী পাঁচটা বছর নিরুত্তেজই থাকবে। কোথাও তেমন বিরোধিতা নেই। প্রতিপক্ষও ক্রমেই হীনবল হচ্ছে। মাথাব্যথার বড় কারণ একটাই: রোহিঙ্গা। ১১ লাখ মানুষকে আরও কত বছর এইভাবে আশ্রয় দেওয়া যাবে সেই চিন্তার পাশাপাশি গুল্মলতা বৃদ্ধির মতো বেড়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসের আশঙ্কা। ভারতের দিকে আশার দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। হাই কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে এ দেশে সদ্য এসেছেন ভূমিকন্যা রিভা গঙ্গোপাধ্যায় দাস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা-প্রশ্নে ভারত দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। থাকবেও। তবে ঘটনা হল, সমাধানসূত্র এখনও অধরা।
এই বিপুল সমস্যা সত্ত্বেও হাসিনার বাংলাদেশের বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে আরও উত্তরমুখী। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এই অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বড় কারণ। তারই পাশাপাশি অন্য যে বিষয়টি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, তা হল: ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমোন্নতি। ভারতীয় কূটনীতির বড় বিশেষত্ব এই যে, কেন্দ্রে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে কূটনীতিতে পরিবর্তন আসে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই দাবি করা যায় না। ওই দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিহাসই তার প্রমাণ। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অদ্ভুত দক্ষতায় ভারতের আস্থাই শুধু অর্জন করেননি, একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু ও প্রতিবেশীর সম্মানও অর্জন করে নিয়েছেন। ভারতের চারধারে যত দেশ রয়েছে, সম্পর্কের নিরিখে টালমাটাল হয়েছে প্রতিটিই। একমাত্র ব্যতিক্রম হাসিনার বাংলাদেশ। তাঁর জন্যই এক সময় যা অসম্ভব ভাবা হত, আজ তা সম্ভব। একটা সময় ‘ট্রানজিট’ শব্দটির চেয়ে ঘৃণ্য বাংলাদেশে আর কিছু ছিল না। সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশই সেই ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল। তখন শেখানো হয়েছিল, বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করতে দেওয়ার অর্থ দেশটাকে ভারতের কোলে তুলে দেওয়া। সেই ধারণা থেকে দেশকে টেনে বের করে সুসম্পর্কের সোপানে তুলে হাসিনা দেখিয়েছেন– আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসে ভর দিয়ে কীভাবে এগোতে হয়। গত ১০ বছরের লেখচিত্র অব্যাহত থাকলে দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো স্রেফ সময়ের ব্যাপার। জল, স্থল, উপকূল, সমুদ্র ও অন্তরিক্ষের কোথাও আজ যোগাযোগের অভাব নেই। ভারতীয় বিনিয়োগ পেতে শুধুমাত্র ভারতীয় লগ্নিকারীদের জন্য হাসিনা তিনটি ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ (‘এসইজেড’) চিহ্নিত করেছেন। ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটি’-র কাছে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ভারতীয় লগ্নিপ্রস্তাব জমা পড়েছে। প্রত্যক্ষ ভারতীয় লগ্নির পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটা সময় বাণিজ্য হত নদীপথে। হারিয়ে যাওয়া সেই নদীপথ ক্রমে ফিরে আসছে। বঙ্গোপসাগর ও তার উপকূল ব্যবহারের মধ্য দিয়েও শুরু হয়ে গিয়েছে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ। হাসিনার টিকে থাকা ভারতের কাছে কতটা অর্থবহ আরও পাঁচ বছর পর তার নবমূল্যায়ন হবে।
ভারতে কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতার হাতবদলের পর বাংলাদেশের একাংশের মনে সম্পর্কের চরিত্র ঘিরে একটা সংশয় দানা বেঁধেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সংশয় দূর করতে দেরি করেননি। ক্ষণিকের সেই সংশয় দ্বিপাক্ষিক কোনও ক্ষেত্রে ছায়া ফেলেনি। তাঁর সরকারের পাঁচ বছর পূর্ণতা পেয়েছে। ভোটের দিনও ঘোষিত। এই পাঁচ বছরে অনেক স্বস্তির মধ্যে একটি অপূর্ণতা বাংলাদেশের হৃদয়ে বড় হয়ে জেগে রয়েছে। আর খচখচ করছে অস্বস্তির দুটো কাঁটা।
অপূর্ণতার নাম: তিস্তা। হাসিনার বাংলাদেশের বিশ্বাস ছিল, কাজটা হয়ে যাবে। অথচ পঁচ বছরে সেই ‘জরুরি কাজ’ কেন্দ্র সরকার করে উঠতে পারল না। যে যে কারণে তিস্তা অধরা রয়ে গেল, পরবর্তী পাঁচ বছরে তা কি করা সম্ভব? ভোটের প্রাক্কালে প্রশ্নটা নতুন করে ঘুরছে ফিরছে।
অস্বস্তির কাঁটা দুটোর একটা হল: অসমের নাগরিকপঞ্জি তৈরি, অন্যটা নাগরিকত্ব বিল সংশোধনের অঙ্গীকার। দু’টি বিষয়ই ভারতের শাসক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং দু’টির কোনওটিই বিজেপি অধরা রাখতে চায় না। নাগরিকপঞ্জি তৈরি নিয়ে বাংলাদেশের মাথাব্যথা না থাকলেও রয়েছে। হাসিনা সরকারকে ভারত আশ্বস্ত করে বলেছে, বিষয়টি অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সরকার এই আশ্বাস দিলেও বিজেপির বড় নেতারা বলেই চলেছেন, প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। অস্বস্তির কাঁটা তাই খচখচ করেই চলেছে।
দ্বিতীয় কাঁটা: নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন। বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিরোধে রাজ্যসভায় বিলটি আনাই যায়নি। প্রতিশ্রুতি পূরণে একাগ্র থাকলে নতুন লোকসভায় নতুনভাবে সেই পুরনো বিল বিজেপির সরকারকে আনতে হবে। সফল হলে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র রক্ষা হাসিনার কছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। নাগরিকত্ব বিল বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মননে এমনি এমনি সিঁদুরে মেঘ হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধ না লাগলেও ভোট পর্যন্ত যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা থাকবে। এটাই বাংলাদেশে জনপ্রিয় ধারণা। এর সঙ্গে অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ এবং অস্বস্তির জোড়া কাঁটার খচখচানি নিয়ে বাংলাদেশ চেয়ে রয়েছে ভারতের ভোটের দিকে।
[সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি, যৌথ প্রকল্প উদ্বোধনে কড়া বার্তা হাসিনার]
The post দিল্লির মসনদে বসছে কে? অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ওপার বাংলা appeared first on Sangbad Pratidin.