ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: মধ্যমগ্রামের শরৎকাননের আনাচে কানাচে শুধুই কান্নার রোল। শোকস্তব্ধ। বিপর্যস্ত। নিষ্প্রাণ। অস্বস্তিকর। কালীপুজোর আগেই বাড়ি ফিরব বলেছিল। ফিরল তার আগেই। কিন্তু সাদা কাপড়ে মুড়ে। নিষ্প্রাণ শরীর হয়ে। সঙ্গে নিদারুণ বিষাদ আর একরাশ প্রশ্ন নিয়ে।
সকলের প্রিয় শানু। দুষ্কৃতীদের গুলিতে শহিদ অমিতাভ মালিককে শানু নামেই চিনত মধ্যমগ্রামের শ্রীনগর। শানুর প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলবে না। কিন্তু শহিদ ছেলের কফিন ঘিরে আছড়ে পড়া জনসুনামি যেন জানান দিয়ে গেল দেশের জন্য কুরবান হতে প্রস্তুত শত সহস্র অমিতাভ।
মধ্যমগ্রাম থানার পাশে ১ নম্বর শ্রীনগর এলাকার আমরা ক’জন ক্লাবের মাঠে তখন থিক থিক করছে ভিড়। আশপাশের ছাদে অশ্রুসজল চোখে ভিড় করা মানুষের সারি। সাদা ফুল হাতে রাস্তায় ভিড় করা মানুষ। অমিতাভর কফিনবন্দি দেহ আসতেই এক ঘন দীর্ঘশ্বাস গ্রাস করল মাঠজুড়ে। তারপরই গুঞ্জন। আর কান্নার রোল।
চোখের জল আর ফুলের মোড়ক আর গান স্যালুটে শহিদ সাব-ইনস্পেক্টর অমিতাভ মালিককে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হল। শনিবার দুপুর ১টা ৪২ মিনিটে কলকাতা বিমানবন্দরে দেহ আসার পরই শামিয়ানা খাটিয়ে একপ্রস্থ গান স্যালুট দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বিমানবন্দরেই শহীদের দেহ জাতীয় পতাকায় মুড়ে ফেলা হয়। সেখানেই শ্রদ্ধা জানান দুই মন্ত্রী। শ্রদ্ধা জানায় নিহত এসআইয়ের ভাই ও পরিবারের লোকজন। ছিলেন মধ্যমগ্রামের পুর প্রধান তথা বিধায়ক রথীন ঘোষ।
[বাংলাকে ভাগ হতে দেব না, সংকল্প ছিল শহিদ অমিতাভের]
এদিকে বাড়িতেও শহিদ সাব ইনস্পেক্টরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। ছিলেন রাজ্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা। ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ, ডিআইজি তন্ময় রায়চৌধুরি সহ অনান্য পুলিশকর্মীরা। ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার সমস্ত থানার পুলিশ কর্মীরা। সকালে অমিতাভর বাড়ি যান সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। মধ্যমগ্রাম থানার পাশে ১ নম্বর শ্রীনগর এলাকার আমরা ক’জন ক্লাবের মাঠে শহিদকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। দেড়টার সময় দেহ আসার কথা থাকলেও তার আগেই সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে সোজা অমিতাভর কফিনবন্দি দেহ নিয়ে যাওয়া হয় মধ্যমগ্রামে। সেখান থেকে তাঁর বাড়ি। বাড়ি থেকে আমার ক’জন ক্লাবের মাঠে। সেখানেই গান স্যালুট দেওয়া হয় শহিদকে।
শুক্রবারের গোটা রাত বিনিদ্র কেটেছে মধ্যমগ্রাম শরৎকাননের বাসিন্দাদের। তাই শনিবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অমিতাভদের বাড়ি আছড়ে পড়েন পাড়ার মানুষজন। অপেক্ষা অমিতাভকে শেষবারের জন্য দেখার। বেলা যত বাড়তে থাকে ততই ভিড় বাড়তে থাকে। অমিতাভর বন্ধুরা জড়ো হয়েছিলেন হাতে ফুল নিয়ে। চোখের জল যেন বাঁধ মানছিল না। মধ্যমগ্রাম বয়েজ হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন অমিতাভ। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। স্কুলের শিক্ষকরা বারবার সেকথাই বলছিলেন। অমিতাভর স্কুলের সহপাঠীরা তো বটেই, শহিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল স্কুলের সব ছাত্রই। ২০১৫ সালে সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের পোস্টিং হয় দার্জিলিঙে। তড়িঘড়ি বিয়ে সেরেছিলেন। মার্চ মাসে বিয়ে হয়েছিল। সাত মাস কাটতে না কাটতেই সব শেষ। স্বামীর কফিনবন্দি সাদা কাপড়ে মোড়া নিথর দেহটা ছাড়তেই চাইছিলেন না স্ত্রী। বারবার টেনে তোলার চেষ্টা করেও তোলা যাচ্ছিল না! সব ঠিক থাকলে সোমবার মধ্যমগ্রামের শরৎকাননের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল অমিতাভর।
[ছোট ছেলেও ফৌজে যাবে, বলছেন গর্বিত শহিদের বাবা]
সেই মতোই তৈরি হচ্ছিল বাড়ির লোকেরা। দীপাবলিতে বড় ছেলে বাড়ি ফেরার আগাম আনন্দে চলছিল উৎসবের পরিকল্পনা। কিন্তু এখন শুধুই শূন্যতা। স্তব্ধতা। নিঃসঙ্গতা আর একরাশ দুঃখ। শহিদকে শ্রদ্ধা জানাতে ভেঙে পড়েছিলেন শুধু মধ্যমগ্রামই নয়। বারাসত ও সংলগ্ন এলাকার মানুষ। অমিতাভর পরিবারের পাশে থাকার সবরকম আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য সরকার। শহিদের স্ত্রীকে চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর বাবাকেও চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এছাড়াও পরিবারের সাহায্যার্থে এককালীন দেওয়া হচ্ছে ৫ লক্ষ টাকা।
কিন্তু কোনও শান্তনাই যে কাজে আসছে না মায়ের। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছেন এখনও। গোধূলি কেটে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। ছবি আর ব্যানারে ঢেকে যাচ্ছে গোটা পাড়া। হাতে হাতে জ্বলে উঠছে মোমবাতি। মোমবাতির তির তির আলো, নিস্তব্ধ আঁধার, তবুও ডুকরে কেঁদে চলেছেন মা। বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে বুক ফাটা আর্তনাদ। ছেলে তুই কোথায় গেলি?
The post শহিদ অমিতাভর কফিন ঘিরে শোকার্ত মধ্যমগ্রাম, গান স্যালুটে শেষ বিদায় appeared first on Sangbad Pratidin.