গৌতম ভট্টাচার্য: সমরেশ চৌধুরী (Samaresh Chowdhury) সেই দুপুর থেকে অঝোরে কাঁদছেন। এত আকুল যে এখুনি দৌড়ে আসবেন কিনা অনিশ্চিত। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কেউ বলল, ভাস্কর গাঙ্গুলি ফোন করেছিলেন। আসছেন হাসপাতালে।
ততক্ষণে নজরদারি তুঙ্গে। নির্দিষ্ট চিকিৎসাজনিত কারণ ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। মিডিয়ার বিশাল ঝাঁকও বাইরে। পিয়ারলেস হাসপাতালের তিনতলার আইটিইউ-র বাইরে তবু বড় জটলা। অনেকে কাঁদছেন। কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পরিবারের ঘনিষ্ঠ চশমাধারী কেউ বললেন, ‘‘আমাদের একটু ফাঁকা করে দেওয়া উচিত। অন্য পেশেন্টদের ফ্যামিলির অসুবিধে হচ্ছে।” ভদ্রলোককে চিনি না। কিন্তু ওই পরিবেশেও না বলে পারলাম না, সুরজিৎ সেনগুপ্ত-র (Surajit Sengupta) জন্য যদি ভিড় না হয় তাহলে কার জন্য হবে? কোথায় হবে? যে লোকটার রিটায়ারমেন্টের পরেও জর্জ টেলিগ্রাফের হয়ে তার খেলা দেখতে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার লোক ভিড় করত, সে চলে যাচ্ছে শেষ বারের মতো। বাঙালি আকুল হবে না? গভীর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবে না? কাঁদবে না তার ভালবাসার এত গুরুত্বপূর্ণ চিপ চিরতরে চুল্লিতে ঢুকে যাচ্ছে দেখে? তাহলে তো ধরতে হবে সে-ও বেঁচে নেই।
[আরও পড়ুন: ইডেনে আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ, জয়ের সঙ্গে প্রার্থনা কোহলির প্রত্যাবর্তনের]
মোহনবাগান (Mohun Bagan) থেকেই সুরজিৎ সেনগুপ্ত নামক হুগলির লাজুক তরুণের বঙ্গসমাজে উত্থান আর এত নাম-যশ কুড়োনো। সবুজ মেরুনের সেই চিরঐতিহ্যশালী লনে যখন মানস-বিদেশ আর সত্যজিতের মতো অনুজ খেলোয়াড়রা সন্ধের আলোয় শুইয়ে দিলেন তাঁর দেহ, কেউ যেন ঢ্যাং করে মাথায় স্কুলের ফার্স্ট বেল মারল। ১৯৭৩। স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড কেটে মোহনবাগান-বালি প্রতিভা দেখা শেষ করেছি এবং তারপর গন্তব্য ওই লন। ৫-০ জিতেছে মোহনবাগান। কিন্তু জেতা-টেতা নয়, ভালবাসার প্রথম নায়ককে যে সশরীরে পেয়ে গেছি। এখন তাঁকে কাছ থেকে দেখা এবং অটোগ্রাফ না নিলেই নয়। সাবেকি মোহনবাগানে একটা রেওয়াজ ছিল খেলার পর বিশাল সব জাগে লেবুর শরবত গোলা থাকত। প্লেয়াররা টেন্টে না ফিরে ওই লনেই সরবত খেতেন। বিশ্রাম নিতেন। প্রাক্তনদের করা ম্যাচ বিশ্লেষণ শুনতেন। অটোগ্রাফ শিকারিদের আদর্শ জোন ছিল জায়গাটা। ইস্টবেঙ্গলে যেটা করার জন্য টেন্টে ঢোকার ব্যবস্থা না করলে নয়, সেটা মোহনবাগান লনেই হয়ে যেত। গোটা টিম তো সেখানে।
অটোগ্রাফ নিলাম প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাওয়া নায়কের। দু’একটা দিন বাদে পুলিশের সঙ্গে খেলা। সুরজিৎ এক টাকা দশের গোলপোস্টের দিকে একটা গোল করলেন যেখানে তাঁর ফলসে গোলকিপার পড়ে গেল। ফার্স্ট বারে সে ডাইভ মারার পর তিনি উল্টো দিকে ঠেলে দিলেন। পঞ্চাশ বছর আগে নিছক কিশোরমনে আস্বাদিত ইমেজারি। কিন্তু আজও ভুলতে পারি না। কেন গোল হিসেবে আইএফএ নথিভুক্ত করেছে জানি না। ওটা কৃত্তিবাসের কবিতা সংকলনে থাকা উচিত।
কলকাতা ময়দানের ঘটনাবহুল তিয়াত্তর সাল যেমন ২৬ দিন আগে চলে যাওয়া সুভাষ ভৌমিককে (Subhash Bhowmick) জিরো থেকে হিরো করে দেয়। তেমনই সুরজিতকে নতুন হিরো থেকে সাধারণ ক্যারেক্টার আর্টিস্টে নামিয়ে আনে। দুটো বড় ম্যাচেই ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্স ভাঙতে পারেননি। দ্রুত রটে গেল, এ বড় ম্যাচে অচল। ক্যাপটিভ অডিয়েন্স অবশ্য তাতে বিক্ষিপ্ত হয়নি। ময়দানমুখী সমাজের অনেক কিশোর এবং তরুণ ততদিনে তাদের সিলেবাস পেয়ে গিয়েছে যে স্থানীয় ফুটবল মানে চারটে টিমের ওপর নজর রাখতে হবে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান এবং সুরজিৎ সেনগুপ্ত!
যে কোনও কারণেই হোক, ইস্টবেঙ্গলে জীবনের শেষ চার বছর না খেলেও লাল-হলুদ আবেগের সঙ্গে অনেক বেশি জড়িয়ে ছিলেন সুরজিৎ। চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তাঁর বুকে যেন ইস্টবেঙ্গল ফ্ল্যাগ জড়িয়ে দেওয়া হয়। সমরেশ চৌধুরী ও গৌতম সরকার –ইস্টবেঙ্গল এবং বাংলায় তাঁর পেছনে থাকা দুই প্রবাদপ্রতিম মিডফিল্ডার যখন মৃতদেহের পাশে চোখের জল ফেলছিলেন, তখন মনে পড়ে গেল পুরনো শিল্পকর্মের স্মৃতিতে আজ সবাই কী বিভোর। রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়— সুরজিতের ভ্রাতৃপ্রতিম স্ট্রাইকার যেমন কেঁদেই চলেছেন। আর গৌতম খালি বলে চলেছেন, প্রিয়দা যে কী ফ্যান ছিল সুরোর স্টাইলের ভাবতে পারবেন না। খালি বলত রিয়াল আর্টিস্ট। ইস্টবেঙ্গল শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার তখন তাঁবুর আর এক কোণে রোমন্থন করছেন মাসখানেক আগে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের ছেলের বিয়েতে এই সাংবাদিকের সঙ্গে সুরজিতের কোরিয়া ম্যাচের গোল নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়ার কথা। তর্কের বিষয় ছিল ১৯৭৯ সালের শিল্ড সেমিফাইনালে করা তাঁর গোলটা কর্নার থেকে হয়েছিল? না দূরপাল্লার শটে? সুরজিৎ সমাধান করে দিয়ে হেসেছিলেন, ‘‘কর্নার থেকে নয়।” এসব ফুটবল তর্কের বিষয় কি তাঁকে আরও হতে হয়? বলেছিলেন, “বেশির ভাগ ভুলে গিয়েছে। সেই কবে খেলতাম। তবে একটু বেশি বয়সীরা আজও দেখি প্রসঙ্গ উঠলে উত্তেজিত হয়ে পড়ে।’’ হায় সুরজিৎ যদি দেখতেন, মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে শোক-উত্তেজনার তীব্রতা !
আচ্ছা, একটু আগে ময়দানমুখী সমাজ কথাটা ভুল লিখলাম। লেখা উচিত ছিল ময়দানমনস্ক সমাজ। নইলে সুরজিতের অবসর নেওয়ার বছরে কেন ‘দেশ’ দফতরে সুনীল-শীর্ষেন্দুর আলোচনায় সত্তর-আশির দশকের এত তারকার মধ্যে একমাত্র তিনি বারবার উঠে আসবেন? আর কেউ নন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে কেন তাঁকে নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত দেখব? তার পাঁচ-ছয় বছর আগে ‘উলঙ্গ রাজা’ অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে। নীরেনবাবুকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিন্তু তিনি নিজে যেন সুরজিতের ফ্যান বয়। ‘আনন্দমেলা’-তে লেখার জন্য ফুটবলারদের মধ্যে তাঁকেই উপযুক্ত খুঁজে পান। একদিন দিল্লি থেকে মোহনবাগান যে ফ্লাইটে ফিরছিল, তাতে কবি-সম্পাদক ছিলেন। ফিরে এসে অফিসে বললেন “সুরজিৎকে দেখে আমি আরও মুগ্ধ হয়ে গেলাম।” কেন ? নীরেন চক্রবর্তী ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘‘সবচেয়ে পিছনের সিটে একা বসে ও বই পড়ছিল। সবাই গল্প করছে। সুরজিৎ বই পড়ছে। যে পারফর্মার সবার মধ্যে থেকে একা হতে পারে তার বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে।’’
বিখ্যাত কবি একা নন। শিল্পী-সাহিত্যিক-নাট্যকর্মী-ডাক্তার-আইনজীবী সত্তরের বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বিশাল অংশ সুরজিতের সঙ্গে নিজেদের অদ্ভুত আইডেন্টিফাই করত। কোথাও যেন রাইট উইং ধরে ওই দ্রুত দৌড়োনো, লম্বা লম্বা চুল ওড়া, সেই শৈল্পিক ড্রিবলের লাবণ্যে বাঙালি তার ভালোবাসার ফুটবলকে দেখত জ্যান্ত কবিতা হয়ে যেতে। গান হয়ে যেতে। তৈলচিত্র হয়ে যেতে।
কফি হাউসে তখনও দুদ্দাড় প্রেম হয়। কলেজ স্ট্রিটে ট্রাম পোড়ে। মেয়ে বেকারকে বিয়ে করে বাবাকে গিয়ে বলে, ও এখনও কিছু করে না, কিন্তু করবে। নকশাল আন্দোলন উত্তর বঙ্গসমাজ। যখন রোম্যান্টিকতা আবার ফিরছে। বাঙালিয়ানা হারিয়ে যেতে পারে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রলোভনে এই আতঙ্কে বাঙালি আরও বেশি আঁকড়ে থাকতে চাইছে তার শেকড়কে। সেই সমাজের ময়দানি প্রতিনিধি ছিলেন সুরজিৎ। অন্য তারকাদের সম্পর্কে বলা হত বড় ফুটবলার। সুরজিৎ সম্পর্কে বলা হত বুদ্ধিজীবী-ফুটবলার। দ্য বয় ইউ ক্যান টেক হোম টু ইওর মাদার। বাঙালি নাগরিক সমাজ আর ফুটবল সমাজের মাঝে পারাপারের সেতু ছিলেন সুরজিৎ। আজ মনে হচ্ছে একমাত্র সেতু ছিলেন যা তাঁর তিরোধানে নদীতে ভেঙে পড়ল।
বিদেশের টিমে ডাক পেয়েছেন। ফাটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। জীবনের শেষ ইস্টবেঙ্গল ম্যাচেও গোল করেছেন। রাইট উইংয়ে তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ মানস ভট্টাচার্য রাতে উদাসী গলায় বলছিলেন, “গোল অনেক করেছি। কিন্তু সুরোদার মতো পারফেকশন আমার ছিল না।” বিদেশ-সত্যজিৎরাও বরাবরের ফ্যান এবং একইরকম শোকাহত। ফুটবল অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু সুরজিতের একমাত্র দিক নয়। হলে এমন আবেগের বিস্ফোরণ হয় না। নইলে শেষ বড় টিম খেলেছেন তো চল্লিশ বছর আগে। কোচিং করেননি।
তাহলেও কেন বিস্মৃত নন ? কেন চলে যাওয়ার পরেও সোশ্যাল মিডিয়া নামক কমবয়েসি মাধ্যমেও এমন ভরপুর বিষণ্ণতা? কেন কলকাতার মেজাজ দুপুর একটা চুয়ান্ন মিনিট থেকে অর্ধনমিত? আসলে নিছক নামী প্রাক্তন ফুটবলার তো যাননি। সে তো অনেকেই যায়। কিন্তু তারা এত মানুষের রোমান্সভরা ছোটবেলা সঙ্গে নিয়ে নাকে তুলো গোঁজে না। কোভিড মৃত্যুর হিসেব হয়। সুরজিৎ চলে যাওয়ার পর আবেগ-মৃত্যুসংখ্যা গুনবে কে?
আর হ্যাঁ ফুটবল-ফুটবল বারবার করার মানে হয় না। ঘটনাক্রমেই ফুটবলার। আসলে শেষ সুপারস্টার ছিলেন চুনী গোস্বামী পরবর্তী কলকাতা ময়দানের। যার অঙ্গরাজ্য বাঙালি আবেগ। কৃশানু দে বেঁচে থাকলে তা-ও একটা কথা ছিল। এ তো মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ চলে যাওয়ার মতো বিপন্নতা। বাঙালির হয়তো গানটা মনেও পড়ছে –জব ছোড় চলে ফুটবল -রোম্যান্স নগরী!