সরোজ দরবার: শেষ কবে আন্তর্জাতিক আসরে ঘটা করে শোনা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম? শেষ কোন ঘটনায় সারা বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে রাজ্য? বাঙালি অন্তত সাম্প্রতিককালে এরকম কোনও ঘটনার কথা মনে করতে পারছে না৷ মনে আসার কথাও নয়৷ কিন্তু কথা হল মাদার টেরিজাকে ‘ফ্রড’ বলে প্রমাণ করতে বাঙালির চেষ্টার কসুর নেই৷ হ্যাঁ, সারা দুনিয়া যখন মাদারের সেন্টহুড সেলিব্রেশন করছে, খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন এই উপলক্ষ্যেই ভ্যাটিকানে, তখন দেশবাসীর একাংশের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাঙালিরও মাদার-বিরুদ্ধ কথার যেন শেষ নেই৷
বাংলার পরিধি ছাড়িয়ে যাঁরা ভিনরাজ্যের জমিতে সামান্য হলেও ঘুরে এসেছেন, তাঁরা বলে থাকেন, নাক উুঁচুতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার৷ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে অতিরিক্ত ভাববিলাস যেন তার মজ্জাগত৷ শৌখিনভাবে তা অহঙ্কার বলে সাব্যস্ত হলেও, পাঁচ রাজ্যে জল খেয়ে আসা মানুষ তাকে কুয়ো ও ব্যাঙের বাইরে অন্য কোনও উপমায় এঁটে উঠতে পারেন না৷ আসলে যুক্তিও তেমন পান না৷ এহেন বাঙালি হঠাৎ প্রবল যুক্তিবাদী হয়ে মাদারের সন্তায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন৷ যে অলৌকিক নিয়ে মাদার আজ সন্তরূপেণ, তা স্রেফ ‘বুজরুকি’ ছাড়া আর কোনওভাবে প্রতিভাত হচ্ছে না
প্রশ্ন হল, এই সব প্রশ্ন তোলার মতো যোগ্যতা বাঙালির কতখানি আছে? যদি ধরে নেওয়া যায় মাদার কিছু করেননি, পাল্টা প্রশ্ন ওঠে ক’জন বাঙালি কটা মিশনারিজ অফ চ্যারিটি গড়ে তুলেছেন? মাদারের আশ্রয় পেয়ে যে ছেলেটি আজ পাইলট হতে পেরেছেন, তাঁর জীবনকাহিনীর মতো কটা রূপকথা লিখতে পেরেছে ক’জন বাঙালি, এমনকী দেশবাসীও! মাদার যে ধর্মপ্রচারক এ নিয়ে বরবারই সরব আরএসএস! এক শ্রেণির শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কথা আরএসএসের কট্টর ভাবাদর্শের থেকে আজ অন্তত আলাদা কিছু শোনাচ্ছে না বলেই মনে করছেন কয়েকজন৷
এক শ্রেণির মানুষ আবার বলছেন, থাক এত কূটতর্ক৷ মাদারের সৌজন্যে অন্তত বিশ্বের আসরে বাংলার নাম তো আরও একবার উঠে এল৷ এই বা কম গৌরবের কীসে? অবশ্য সেখানেও ছিদ্র দেখছেন কেউ কেউ৷ দেশের দারিদ্র্য তুলে ধরেই মাদার নাকি নাম কুড়িয়েছেন এমন মতও ঘুরছে হেথাহোথা৷ বলাবাহুল্য, এ সেই বাঙালি শ্রেণি, যাঁরা ‘পথের পাঁচালী’কেও দারিদ্র্য তুলে ধরে বিদেশে কলকে পাওয়ার বদনাম দিয়েছিল৷
সব মিলিয়ে নেটদুনিয়ায় এখন বেজায় ঘ্যানঘ্যান৷ দেশের অন্যান্য প্রদেশের বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বাঙালিও৷ যাঁকে অপদস্থ করার জন্য এত যুক্তির ঘটা, তাঁর কর্মকাণ্ডের সবথেকে বেশি সুফল পেয়েছে এ বাংলাই৷ বঙ্কিমবাবুর কমলাকান্তকে ভ্রমর বলেছিল, ‘তোমরা না জান শুধু মধু সংগ্রহ করিতে না জান হুল ফোটাইতে-কেবল ঘ্যানঘ্যান পার৷ একটা কাজের খোঁজ নাই-কেবল কাঁদুনে মেয়ের মতো দিবারাত্র ঘ্যানঘ্যান৷ একটু বকাবকি লেখালেখি কম করিয়া কিছু কাজে মন দাও-তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইবে৷ মধু করিতে শেখ-হুল ফুটাইতে শেখ৷’ আজ অন্তত নেট দুনিয়ার এই ঘ্যানঘ্যান দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছে ভ্রমরের পরামর্শ অপাত্রেই বর্ষিত হয়েছিল৷ শ্রীবৃদ্ধি তো দূর, মধু সংগ্রহের সামান্যতম স্পৃহাটুকুও সম্ভবত হারিয়েছে বাঙালি৷
The post ‘ফ্রড টেরিজা’! তর্কে মেতে কী লাভ হল বাঙালির? appeared first on Sangbad Pratidin.
