সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: দুর্গাপুজো (Durga Puja In Village) তো শুধুই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব নয়। একেকটা পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে কতশত ইতিহাস, কাহিনি, কল্পনা। তেমনই একটি ডায়মন্ড হারবারের (Diamond Harbour) বারদ্রোণ গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের ৩০০ বছরের পুজো। এ পুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক রোমহর্ষক গল্প। যা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। রীতি মেনে দুর্গাপুজো হয় আজও। তবে জৌলুস কমেছে অনেকটাই।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার (South 24 Parganss) ডায়মন্ড হারবারের বারদ্রোণ গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবার। কথিত আছে, জমিদার লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্যর মৃত্যুর পর তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। দাহ করার আগে অবিশ্বাস্যভাবে জমিদারের পুনর্জন্ম হয়! বেঁচে ফিরে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ভট্টাচার্য পরিবারে দেবী দুর্গার পুজো শুরু করেন তিনিই।
বাংলাদেশের (Bangladesh) যশোর জেলায় বাস ছিল জনৈক শ্রীরাম মিশ্রের। সেখান থেকে কটকে যান তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম। এর পর মিশ্র পরিবার কলকাতার পদ্মপুকুর লেনে চলে আসেন। সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। মিশ্র পরিবারের মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সেই সূত্রে ব্রিটিশ সরকার তাঁদের ভট্টাচার্য উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁদেরই এক বংশধর ডায়মন্ড হারবারের বারদ্রোণ গ্রামে এসে কাশ্যপ গোত্রের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। ভট্টাচার্য পরিবারের উত্তরপুরুষ ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত ভট্টাচার্য। জমিদারির পত্তন করেন তিনিই। ‘সানসেট ল’ অনুযায়ী ব্রিটিশদের কাছ থেকে জমিদারি পান তিনি। ব্রিটিশ আমলে এই আইন অনুযায়ী সূর্যোদয়ের আগে কোনও জমিদার খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে তাঁর জমিদারি কেড়ে নিয়ে অন্যজনকে বিক্রি করা হত। সেভাবেই জমিদারি কিনেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত।
[আরও পড়ুন: ৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু পাঁচ রাজ্যের ভোটগ্রহণ, দিনক্ষণ ঘোষণা কমিশনের]
পরিবারের বর্তমান দুই বংশধর নিমাইচাঁদ ভট্টাচার্য ও মনোজ কুমার ভট্টাচার্য জানান, সেই থেকে আজ পর্যন্ত একাদশ পুরুষ ধরে দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন তাঁদের পরিবারে। তাঁদের কথায়, প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজও উমা পূজিতা হলেও জৌলুস অনেকটাই কমেছে। বিষ্ণুপুরের আদিগঙ্গা থেকে বজরায় করে আসত গঙ্গাজল। বজরা ভিড়ে যেত বারদ্রোণ খালে। সেই গঙ্গাজলেই পুজো থেকে রান্নার ভোগ পর্যন্ত সারা হত। খাল মজে যাওয়ায় এখন গঙ্গা থেকে ম্যাটাডোরে ১২ ড্রাম গঙ্গাজল আসে ভট্টাচার্য বাড়িতে।
আগে পুজোয় প্রতিদিনই ১২-১৪ টি বলিদান হত। এখন সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে তিনটি পাঁঠাবলি হয়। নবমীতে আখ ও কুমড়ো বলি হয়। আগে সন্ধিপুজো শুরু হত বন্দুকের তোপধ্বনি আর বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে। কালের নিয়মে সেসবই আজ ইতিহাস। পরিবারের মেয়ে ৭৫ বছর বয়সী রুপালি ধর বলেন, “ছোটবেলায় বাড়িতে পুজোর যে জৌলুস দেখেছি, আজ তা অনেকটাই কমেছে। আগে নৈবেদ্য হত ২৪ পালির। যা এখন ১২ পালিতে এসে ঠেকেছে। ৫০০টি নারকেল ভেঙে তৈরি হত নারকেল নাড়ু। আগে পুজো উপলক্ষে প্রতিদিনই প্রজাদের দেবীর ভোগ খাওয়ানো হত। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আসতেন ভট্টাচার্য বাড়িতে পুজো উপলক্ষে ভোগ খেতে। মুসলমান প্রজাদের জন্য আলাদাভাবে তৈরি হত চিঁড়ে ও রসকরা। এখনও গ্রামের মানুষ ভোগ খেতে আসেন। তবে সংখ্যাটা নেহাতই নগন্য।”
[আরও পড়ুন: ‘১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে রাজভবনের সামনে ধরনা?’, তৃণমূলের কর্মসূচি নিয়ে মামলা হাই কোর্টে]
দেখুন ভিডিও:
পুজোর জৌলুস কমলেও ভাঁটা পড়েনি পুজো নিয়ে ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যদের উৎসাহে। অনেকেই এখন দেশে-বিদেশে কর্মরত। পুজোর সময় আসতে না পারলেও সকলেই তাঁদের অর্থসাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বাড়ির পুজোয়। এবছরও ভট্টাচার্যদের ঠাকুরদালানে পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। সারা বাড়ি ঘিরে এদিক-সেদিক চলেছে ঝাড়পোঁছ। মৃন্ময়ী মূর্তিকে দেবী চিন্ময়ী করে তুলতে বাড়ির ছোট থেকে বড়ো সকলেই হাত লাগাচ্ছেন নানা কাজে।