সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রাজ কোষাগারে অর্থের টান। কিন্তু সেই রন্ধনশালা থেকে পঞ্চব্যঞ্জনে আজও থালা আসে রাজরাজেশ্বরীর ঠাকুরদালানে। সেই সঙ্গে মা রাজরাজেশ্বরীর যন্ত্রও যায় সেই রন্ধনশালায়। সেখানেই থালা ছাড়া বাকি ভোগের অংশ মাকে নিবেদন করা হয়।
মেনুতে থাকে গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত, কোনকা শাক, অড়হর ডাল, আলু, পটল, বেগুন, কাঁচকলা, বড়ি, কুঁদরি ভাজা, ছোলা দিয়ে পুঁই-কুমড়োর তরকারি, কুমড়ো, বেগুন, মুলো দিয়ে নটে শাকের চচ্চড়ি, মাছ ভাজা, কলজা ভাজা, বলির পাঁঠার মাংস, পায়েস, বোঁদে, রসগোল্লা, সন্দেশ। পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোট রাজ পরিবারের পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগের পরম্পরা আজও অটুট। মহালয়ার পাঁচ দিন আগে জিতাষ্টমীর পরের দিন কৃষ্ণপক্ষের আর্দ্রা নক্ষত্র যুক্ত নবমী থেকে ভোগের পাত পড়া শুরু হয়েছে। টানা ১৬ দিন অর্থাৎ মহানবমী পর্যন্ত চলবে। আসলে এই পঞ্চকোট রাজপরিবারে একটা কথা ছিল, “যার পাত তার ভাত।” সেই বাক্য একটুও নড়চড় হয়নি।
অথচ সেই রাজা নেই। রাজতন্ত্র নেই। তবুও ঠাকুর দালানের বারান্দাতে শয়ে শয়ে মানুষ পাত পেড়ে ভোগ খান। পঞ্চকোট রাজ পরিবারের অন্যতম বর্তমান সদস্য সৌমেশ্বরলাল সিং দেও বলেন, “পুজোর জৌলুস হয়তো অনেকাংশেই ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু ভোগের পঞ্চব্যঞ্জনের পরম্পরা আমরা ধরে রেখেছি। রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে ১৬ দিনের পুজোয় শয়ে শয়ে মানুষ পাত পেড়ে ভোগ খান। আগে অবশ্য সংখ্যাটা হাজার হাজার ছিল। তবে ঠাকুরদালানে এলে কাউকে খালি হাতে ফেরানো হয় না।”
[আরও পড়ুন: চালচিত্রে বন্দেমাতরম, ইলামবাজারে দেশমাতৃকা রূপে পূজিতা উমা]
এই ভোগ প্রথা চালু হয়েছিল মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিং দেওর আমলে। তখন অবশ্য হাজার হাজার মানুষের পাত পড়ত বলে আয়োজন ছিল বিশাল। ভোগ রান্নার ঘ্রাণে ম-ম করত চতুর্দিক। বর্তমানে যে পাচক এই ভোগ রান্নায় যুক্ত সেই দীননাথ আচার্য বলেন, “বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে পরম্পরা অনুযায়ী আমরা রাজরাজেশ্বরী মায়ের ভোগ রান্না করে আসছি। সেই সময় এই ভোগ নিয়ে কত কথা শুনেছি। আগের মতো ব্যাপক হারে ভোগ না হলেও ঐতিহ্য একটুও কমেনি।”
আগে প্রায় ৪০-৫০ জন পাচক ভোগ রান্নায় যুক্ত ছিলেন। এখন সেই সংখ্যাটা কমে হয়েছে ৫। দীননাথ আচার্য ছাড়াও বাদল নায়েক, রাখাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হারাধন গঙ্গোপাধ্যায় ও তপন আচার্য। সেই সঙ্গে নিত্য ভোগের আয়োজন করা সুদেব দেওঘরিয়া। এছাড়া এখন ভোগ রান্নার জন্য সবজি কাটা থেকে নানান কাজে যুক্ত রয়েছেন আরও ১২ জন। মাকে ভোগের থালা সাজানোর কাজে যুক্ত থাকা সমীরণ দেওঘরিয়া বলেন, “এখানে নিত্য পুজো হয়। তাই ফি দিন মায়ের আমিষ ভোগ হয়। মাছ ছাড়া মায়ের ভোগ হবে না। মাকে ভোগ নিবেদন করার সময় দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন রাজপরিবারের সদস্যরাও মায়ের কাছে যেতে পারেন না। আগে প্রতি মঙ্গলবার বলি হত। এখন বিশেষ দিনে হয়।” মহালয়ার পাঁচ দিন আগে যেদিন পুজো শুরু হয়েছিল সেদিন একটি বলি, তারপর কমপক্ষে চতুর্থীতে চারটি, সপ্তমীতে সাতটি, অষ্টমীতে আটটি, নবমীতে ন’টি পাঁঠা বলি হতই।
মহাদশমীতে ঘট বিসর্জনের আগে মাকে দই, চিঁড়ে ভোগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে চ্যাং মাছ পোড়া ও সিদ্ধি। তারপর সেই প্রসাদ গ্রহণ করেন সকলে। আগে পাচকদের পরিবারকে এই রাজ পরিবার জমি-জায়গা, পুকুর দিয়ে তাদের আয়ের বন্দোবস্ত করেছিল। সেই কারণেই তারা আজও বংশ পরম্পরায় এই রাজ পরিবারের হেঁশেল টানেন। সেই হেঁশেল থেকে ভোগ রান্নার গন্ধ ম-ম করে আজও।
দেখুন ভিডিও: