বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: মা দুর্গা আগেই পূজিতা হয়েছিলেন ‘মেয়ে’দের হাতে। এবার মা কালীর উপাসনায় মহিলামহল। শাস্ত্রমতে মন্ত্রোচ্চারণ, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি মেনে কালীপুজো (Kali Puja) করবেন নদিয়ার কাননবালাদেবী, বিচিত্রা মজুমদাররা। আদ্যাস্তব পাঠ করে হোম যজ্ঞের মাধ্যমে পুরোহিতের ভূমিকা পালন করবেন তাঁরা। এবছর নদিয়ার হাঁসখালির একাধিক পুজো হবে মহিলা পুরোহিতদের হাত ধরেই।
দুর্গাপুজোর (Durga Puja) অনেক আগে থেকেই পুজোর নিয়মকানুন আচার-বিধি জানার জন্য রীতিমত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এমন একাধিক মহিলা। বহুদিন ধরে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা রপ্ত করেছেন পুজোপদ্ধতি। কাননবালাদেবী এবছর নদিয়ার (Nadia) হাঁসখালি ব্লকের গ্যারাপোতা শান্তি সংঘের দুর্গাপুজোয় এবছর ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত পুজো করেছেন। এবার তিনি বগুলার নোনাগঞ্জ মোড়ের ড: বি আর আম্বেদকর ক্লাবের কালীপুজো কমিটির পুজো করতে চলেছেন।
কাননবালাদেবীর পাশাপাশি আকাইপুরের বাসিন্দা বিচিত্রা মজুমদারও ওই এলাকাতেই এবার কালীপুজো করবেন। মূলত দুর্গা,লক্ষ্মী, গণেশ,বিশ্বকর্মা, মনসা ও কালীপুজোর মত বিভিন্ন পুজোর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলেও সেই তুলনায় অপ্রতুল পুরোহিত। লক্ষ্মী, সরস্বতী,কালীপুজোর মত যেসব পুজোগুলো বাঙালির বিভিন্ন ঘরে ঘরে হয়ে থাকে,সেইসব পুজোর জন্য পুরোহিতের (Priest) সংখ্যা ক্রমশ কমে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: মেলবোর্নে লেখা হল প্রতিশোধের ইতিহাস, হার্দিক-কোহলি ম্যাজিকে পাক বধ ভারতের]
সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে নদিয়ার হাঁসখালি ব্লকের বগুলায় রীতিমত প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন পুরোহিত তৈরির জন্য বেশ কিছুদিন আগেই চালু করা হয়েছে ‘গৌরহরি মডার্ন টোল’ নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।সম্পূর্ণ বিনা খরচে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন পুরুষেরা এবং একাধিক মহিলারাও। ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মহিলা এবং পুরুষেরা। বর্তমানে ওই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত মহিলার সংখ্যা শতাধিক। পুরুষদের সংখ্যা অবশ্য তুলনামূলক কিছুটা কম।
চাকদহের সিলিন্দা থেকে ৩৫ বছর বয়সী শম্পা মণ্ডল, মহুয়া পালরা ট্রেনে করে বগুলাতে গিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে থেকে যাচ্ছেন ইলা রায়। বগুলার কাছে ঘোলামারি গ্রাম থেকে শংকরী মন্ডল সহ একাধিক মহিলা ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে পুরোহিতের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক অভিরাম বিশ্বাস জানিয়েছেন, ”বাঙালি আগাগোড়াই ধর্মপরায়ণ। তাই বাঙালির ঘরে ঘরে গণেশ,লক্ষ্মী,সরস্বতী, বিশ্বকর্মা,মনসা, কার্তিক,এমনকী দুর্গা ও কালীপুজোর মত একাধিক পুজো সারা বছর ধরে হয়ে থাকে। বাড়ির মহিলারা সকাল থেকে উপোস থেকে পুজো সম্পন্ন করতে চান। কিন্তু ইদানিং পুজো করার জন্য পুরোহিতের ভীষণ অভাব। বিশেষ করে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী পুজোর দিন পুরোহিতের অভাব ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায়। ফলে পুজোর জোগাড় করার পরেও দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেও সঠিক সময়ে পুরোহিতের দেখা মেলে না। এ এক ধরনের বড় সমস্যা। এই অবস্থা আমরা বিগত কয়েকবছর ধরে দেখে আসছি।তাই পুরোহিতের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ‘গৌরহরি মডার্ন টোল’ নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে বগুলায়। সেখানে নতুন প্রজন্মের অনেকেই পুরোহিত হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।”
[আরও পড়ুন: নেতাজি এবং গুমনামি বাবার হাতের লেখা একই! বিতর্ক উসকে জানালেন বিখ্যাত মার্কিন বিশেষজ্ঞ]
লক্ষণীয় বিষয় এই যে,মহিলারাও অনেকেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন।কারণ, শাস্ত্রে মহিলাদের পূজো করার ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ নেই। বাধা নেই সংবিধানেও। ভারতীয় সংবিধানের ২৫ ও ২৬ ধারায় অব্রাহ্মণদেরও পুরোহিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। সেইমত ২০০২ সালে ৫ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছিল। পরদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছিল। সংবিধানে মহিলাদেরও পুরোহিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। তাই পুরোহিতের অভাব মেটাতে পুরুষ,মহিলা উভয়কেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এই টোলে।
মহিলা পুরোহিত কাননবালাদেবীর কথায়, ”আমি যখন এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলাম, তখন মহিলাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। এরপর আমি বিভিন্ন ধরনের পুজো শিখে পুজো করা শুরু করি। আমার পরিচিত বিভিন্ন মহিলাদের এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য নিয়ে আসি।এখন একাধিক মহিলা এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পুরোহিত হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আমি মনে করি, দেবতাকে পূজো দেওয়ার অধিকার যেমন পুরুষদের রয়েছে,তেমন মহিলাদেরও রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে অব্রাহ্মণদের পুজো দেওয়ার অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে।”