সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: জিনাত কি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে শাবক প্রসব করেছে? সেই শাবক কি মেলানিস্টিক? হলুদ ডোরাকাটার বদলে হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা? নাকি গহন জঙ্গলে জিনাতের গর্ভবতী হওয়ার খবর-ই ভুয়ো? ওড়িশার সিমলিপালের বাঘিনী জিনাতের বাংলা আগমনের বছর পার হতেই নাম বদলে ওই বাঘিনী 'গঙ্গা' এখন কেমন আছে জানতে চায় বাংলা। কারণ গতবছর ২০২৪-র ২০ ডিসেম্বর ঝাড়খন্ড হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেছিল জিনাত। সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে পালিয়ে। প্রথমে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর বনবিভাগের চাকুলিয়া। তারপর ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ির কাটুচুয়া। সেখান থেকে পুরুলিয়ার (Purulia) বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়। তারপর মানবাজার ২ বনাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ বাঁকুড়া থেকে উদ্ধার। ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, বাংলা তিন রাজ্যকে রীতিমত কাঁপুনি ধরিয়ে প্রায় এক মাস পর বাংলা দক্ষতার সঙ্গে ওই বাঘিনীকে উদ্ধার করে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি তাকে ঘরে ফিরিয়ে দেয়। তবে তা যে কত যন্ত্রণার ছিল জিনাত ধরার অভিযানে শামিল হওয়া বনকর্মী থেকে আধিকারিকরা তা টের পান। তবে জিনাতের চলে যাওয়ার দুঃখ যেন গুচিয়ে দিয়েছিল জিনাত সঙ্গী অর্থাৎ ঝাড়খণ্ডের পালামৌ থেকে আসা 'কিলা'। সেই 'কিলা' গত ২৫ জুন ঝাড়খণ্ড থেকে উদ্ধার হওয়ার পর ঘরে ফিরলেও আবার সে নিরুদ্দেশ। প্রায় ৬ মাস পরেও ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের খোঁজ দিতে পারেনি পালামৌ ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জিনাত সিমলিপালে দিব্যি রয়েছে।
কিন্তু বছর শেষে প্রশ্ন অন্য জায়গায়? চলতি বছরের জুলাই মাস নাগাদ ওড়িশা বনবিভাগ জানিয়েছিল, মেলানিস্টিক পুরুষ বাঘের সঙ্গে জিনাতের মেলামেশা সফল হয়েছে। তারা আশাবাদী নতুন জিনগত বৈশিষ্ট্যের শাবক জন্ম দেবে বাঘিনী জিনাত। অগাস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরে প্রথমেই এই ভালো খবরটা মিলবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর পার হয়ে গিয়েছে তিনমাস। ওড়িশা বনবিভাগ সরকারিভাবে কোন কিছু জানায়নি। বাংলার যে সকল বনাধিকারিক জিনাত ধরার অভিযানে ছিলেন তাঁরা জিনাতকে ভালোবেসে, মায়ার টানে, কৌতুহলবশত ওই বাঘিনী সম্বন্ধে বর্তমানে নানান তথ্য জানতে চেয়েছেন। কিন্তু উত্তর মেলেনি। তার আগমনের এক বছর পার হওয়ার পর এই রবিবারও জিনাত অভিযানে সামিল হওয়া বনদপ্তরের কর্তারা ওড়িশা বনবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোন সাড়া মেলেনি।
তবুও জিনাত নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই বেলপাহাড়ি, বান্দোয়ান, বারিকূল সহ বাংলার। জিনাত ধরার অভিযানে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা রাজ্যের মুখ্য বনপাল (মধ্যচক্র) ড. সিঙ্গারাম কুলান্দ্রাইভাল বলেন, " প্রায় এক বছর আগে জিনাতকে আমরা নিরাপদে, সুস্থ অবস্থায় ওড়িশার সিমলিপালের ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছি। এজন্য মুখ্যমন্ত্রী আমাদেরকে প্রশংসিত করেছেন। কিন্তু ওই কাজ খুব একটা সহজ ছিল না। জঙ্গলমহলে শীতের রাতে সবদিক মাথায় রেখে ওই বাঘিনীকে আমরা উদ্ধার করি, কোনরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই। কিন্তু জিনাতের এখন বর্তমান অবস্থা কি? এই বিষয়ে জানতে আমরা ওড়িশা, সিমলিপালের আধিকারিকদের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাইনি।" অভিযোগ, ওই বাঘিনীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে তথ্য চাপা হচ্ছে।
জিনাতের ফাইল ছবি।
দেশ জুড়ে বাঘ নিয়ে কাজ করা ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ তথা 'শের' নামে একটি সংগঠনের সম্পাদক জয়দীপ কুণ্ডু বলেন, "বর্তমানে জিনাতের অবস্থা কি এই বিষয়ে কোন কিছু জানা নেই। তবে পুরুলিয়ার বনাঞ্চল বাঘ থাকার আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। বাঘ যে তিনটে জিনিস পছন্দ করে নিরিবিলি, বিস্তীর্ণ এলাকা, সেই সঙ্গে সুরক্ষা। এই তিনটি পুরুলিয়ার জঙ্গলে রয়েছে। তাই আবার যে কোন সময় সেখানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসতে পারে।" জিনাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে ওড়িশার রিজওনাল চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্টস প্রকাশচাঁদ গোগিনেনিকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। তবে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ফাল্গুনী বেহারা বলেন, "জিনাতের সন্তান প্রসব সংক্রান্ত এ বিষয়ে এখনও কোন খবর নেই। এরকম বিষয় হলে জানানো হবে। " এই বিষয়ে ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটির কাছেও কোন রিপোর্ট হয়নি বলে খবর।
২০২৪ সালের ১৫ ই নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে ওড়িশার সিমলিপালে নিয়ে আসা হয় সাড়ে তিন বছরের জিনাত ও যমুনাকে। প্রথমে কোয়ারেন্টাইন। তারপর সফট রিলিজ। এরপর ২৪ শে নভেম্বর ওই দুই পূর্ণবয়স্ক বাঘিনীকে রেডিও কলার পরিয়ে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে মুক্ত করা হয়। কিন্তু তার ৪ দিন পরেই ২৮ শে নভেম্বরে ওই দুই বাঘিনী পালিয়ে যায়। যমুনাকে ওড়িশা থেকে উদ্ধার করা হলেও জিনাত ওড়িশা পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর বনবিভাগের চাকুলিয়ায় চলে আসে। তারপর বাংলায়। ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ বাঁকুড়া থেকে জিনাতকে উদ্ধারের পরেই ৩১ শে ডিসেম্বর বাংলা লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খরসোওয়ার জেলার চান্ডিলে আরেকটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার চলে আসে। যা জিনাতের ফেলে আসা পথে ঘুরতে থাকে। জিনাতের মত ওই বাঘও বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়কে ডেরা করে। কিন্তু প্রশ্ন যে কারণে জিনাতকে সিমলিপালে আনা হয়েছে অর্থাৎ হলুদ ডোরাকাটার রয়্যাল ফিরে পাওয়ার আশায়। তা কি ফিরে পাবে ওই ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ? হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা যে হারিয়েই গিয়েছে! জিনগঠিত কারণে রূপ বদলে সিমলিপালের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হয়ে গিয়েছে কালো। সেই কালো কুচকুচে তকমা কি গুচবে? বছর পার হতেই সিমলিপালের বাজি গঙ্গা- যমুনা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝুলছে!
