অর্ণব আইচ: এই যে পেয়েছি। মার মার।
ঢাকুরিয়া স্টেশনের অদূরে বাবুবাগান লেনে প্রৌঢ়া শিক্ষিকাকে ঘিরে ধরেছেন জনা পাঁচেক মহিলা। তাঁর সহকর্মীরা এগিয়ে গিয়েছেন একটু আগে। প্রাণপণে তিনি বের হওয়ার চেষ্টা করছেন ‘চক্রব্যূহ’ থেকে। রাস্তার মধ্যেই তাঁকে শুরু হল মার। আর্তনাদ করছেন শিক্ষিকা। কিন্তু কোনও ছাড় নেই। এক মহিলা তাঁর কাপড়ও ছিঁড়ে দিলেন। মহিলাদের দাবি, তাঁরা স্কুলের ছাত্রীদেরই অভিভাবিকা। মারতে মারতে শিক্ষিকাকে পাশেই একটি রাস্তার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শিক্ষিকা হাতজোড় করে কেঁদে বলছেন, “আমাকে বাঁচান।” হঠাৎই দৌড়ে এল স্কুলের চার ছাত্রী। “আন্টিকে ছেড়ে দাও।” বলে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ল চার বীরাঙ্গনা। শিক্ষিকা শ্যামলী চৌধুরিকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর পরই তারা খুঁজতে শুরু করল ‘রূপা আন্টি’কে। ঢাকুরিয়া স্টেশনে তাঁকে ততক্ষণে ঘিরে ধরেছে আরও কয়েকজন মহিলা। চার বীরাঙ্গনা ছাত্রী বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুলের প্রাইমারির শিক্ষিকা রূপা ভট্টাচার্যকেও উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচিয়ে ফের পৌঁছে দিল স্কুলে। এই চার বীরাঙ্গনা হচ্ছে অয়ন্তিকা প্রামাণিক, ইন্দ্রাণী দাস, পৌলমী সিংহ, তনুশ্রী ঘোষাল। তারা এই স্কুলেরই দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। কেউ কলা আর কেউ বাণিজ্য বিভাগের।
[ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় স্কুল চত্বরে ধুন্ধুমার, মাথা ফাটল অভিভাবকের]
মঙ্গলবার দুপুরে তখনও স্কুলের সামনে ঘোরাঘুরি করছেন উত্তেজিত অভিভাবকরা। তাঁরা চাইছেন অভিযুক্ত শিক্ষক দীপক কর্মকারের শাস্তি। স্কুলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন পাঁচ শিক্ষিকা। বাবুবাগান লেন দিয়ে ঢাকুরিয়া স্টেশনের দিকে যাচ্ছেন তাঁরা। রাস্তায় দাঁড়ানো বহু পুরুষ ও মহিলা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন তাঁদের লক্ষ্য করে। কয়েকজন তাঁদের পিছুও নিতে শুরু করেছেন। বেশিরভাগই মহিলা। “কেন স্কুলে এই ধরনের নোংরামি হচ্ছে? দীপক কর্মকারকে তোরাই বাড়িয়েছিস।” এই ধরনের মন্তব্য করতে করতে শিক্ষিকাদের কাপড় ধরে টানতে লাগলেন কয়েকজন মহিলা। দ্রুত পায়ে তাঁরা এগিয়ে গেলেও একটি অপরিসর রাস্তার মুখে শিক্ষিকা শ্যামলী চৌধুরিকে ধরে ফেলে মারতে শুরু করলেন কয়েকজন মহিলা। চার ছাত্রী তাঁকে বাঁচানোর পর এলাকারই কয়েকজন বাসিন্দা তাঁকে ফের নিয়ে গেলেন স্কুলের দিকে। ততক্ষণে খবর পেয়ে চলে এসেছে পুলিশ বাহিনী। রাস্তায় যেতে যেতে প্রায় অচেতন হওয়ার মতো অবস্থা তাঁর। পুলিশকে অনুরোধ করছেন বাঁচানোর জন্য। পুলিশ আধিকারিকরাই তাঁকে স্কুলের ভিতর নিয়ে গিয়ে শ্রুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। এর মধে্যই উন্মত্ত জনতা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শিক্ষিকা রূপা ভট্টাচার্যকে ঘিরে ফেলায় তিনি কাঁদতে শুরু করেছেন। অভিযোগ, তাঁকে মারধর করা হয়েছে। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে কাপড়। ভাঙা হয়েছে তাঁর চশমাও। চার ছাত্রীই তাঁর চোখেমুখে জল দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তারাই তাঁকে ধরে নিয়ে যায় স্কুলের ভিতরে। অয়ন্তিকা, ইন্দ্রাণী, পৌলমী, তনুশ্রীরা জানায়, তারা ছোট থেকেই এই স্কুলে পড়ছে। ‘রূপা আন্টি, শ্যামলী আন্টি’দের কাছে পড়ে বড় হয়েছে। তাই চোখের সামনে আন্টিদের এভাবে অপমানিত ও আক্রান্ত হতে দেখে আর চুপ করে থাকতে পারেনি তারা। ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের বাঁচানোর জন্য। নিরাপত্তার জন্যই স্কুলের ভিতর নিয়ে যায়।
[বিনোদিনী গার্লস হাই স্কুলের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর]
শিক্ষিকা রূপা ভট্টাচার্যের দাদা বিশ্বতোষ ভট্টাচার্য জানান, তাঁর বোন কুড়ি বছর ধরে এই স্কুলে পড়াচ্ছেন। এদিন তিনি ফোন করে জানান, স্কুলে গোলমাল চলছে। বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। তার মধ্যেই এই খবর পেয়ে বাড়ির প্রত্যেক সদস্য আতঙ্কিত। যারা এই কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিক, তা-ই চায় পরিবার।
ছবি: পিন্টু প্রধান
The post বিনোদিনী গার্লস কাণ্ড, উন্মত্ত জনতার হাত থেকে আন্টিদের রক্ষা করল ৪ ছাত্রীই appeared first on Sangbad Pratidin.