বিজেপি গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গ জয় করার জন্য মরিয়া, নানা আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিজেপি বাঙালিকে বোঝে না। তাই তাদের মুখে হীরক রাজার দেশের কথা বেমানান। বাঙালির সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার ডিএনএ থেকে বিজেপি এখনও সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
এই মুহূর্তে সচিব-সমূহের তালিকায় একজন বঙ্গসন্তানও কি আছে? না। কোনও বাঙালি সচিব নেই। শুধুমাত্র বাংলার ক্যাডার কেন, অন্য রাজে্যর আইএএস-আইপিএস ক্যাডার থেকেও বঙ্গসন্তানরা আসতে পারেন। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দু’জন গুজরাত ক্যাডারের বাঙালি সচিব হন। তঁারা অবসর নেওয়ার পরে আর কোনও বাঙালি সচিব সেই শূন্যস্থান পূরণ করেননি।
সচিব নিয়ে আলোচনা থাক, রাজ্যপাল? কোনও বাঙালি রাজ্যপালও তো নেই। ত্রিপুরা থেকে তথাগত রায়কে সরানোর পর রাজ্যপাল নিয়োগের সময় কোনও বাঙালি মুখ মনে পড়ল কই? এমনকী ২০১৯ সালে বিজেপির ১৮ জন সংসদ সদস্য জেতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে দশ বছরে একজনকেও পূর্ণমন্ত্রী করা হয়নি। অথচ, অনভিজ্ঞ নবীন বহু বিজেপি নেতাকে পূর্ণমন্ত্রী করে পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভাজপা শীর্ষ নেতৃত্ব।
সম্প্রতি ভোটের আগে ২০২৪ সালে পদ্ম-সম্মান দেওয়ার সময় কিছু বাঙালি প্রতিনিধির নাম রেখে এই অভিযোগের মোকাবিলার চেষ্টা হয়েছে বটে, কিন্তু দেশ-সরকার-সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঙালিরা কোথায়? এর জন্য কি আমরা বাঙালিরাই দায়ী? একদা প্রধানমন্ত্রী হতে না-পারলেও আমাদের একজন
প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন। মোদি যুগে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মূল স্রোতে বাঙালিরা কোথায়?
[আরও পড়ুন: ‘আর কখনও ভোটে লড়ব না’, নিজ গড়ে ছেলেকে জেতাতে ‘আবেগী বার্তা’ ব্রিজভূষণের]
আসলে, দেশে এখন বিজেপির যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আধিপত্যকামিতা তার সঙ্গে বাঙালি পরিচিতির সত্তা বোধহয় ‘রং নাম্বার’ হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তার জন্য নানা আক্রমণাত্মক রণকৌশল গ্রহণ করেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, বিজেপি বাঙালিকে বোঝে না! চল্লিশ বছর ধরে দিল্লিতে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বিজেপি নেতৃত্ব তাদের সংগঠন ও দলীয় অগ্রাধিকারগুলো দেখেছি, বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই রাজে্যর বহু বাঙালি, এমনকী বহু বাঙালি বিজেপি কর্মীও, বিজেপির ‘হিন্দি নেতৃত্ব’-কে বোঝেন না।
১৯৮৫ সালে বড়বাজারে নবীন সাংবাদিক হিসাবে বিজেপির তৎকালীন সহ-সভাপতি কেদারনাথ সাহনির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। বড়বাজারে এক সংঘ সমর্থক জৈন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর বাড়িতে তিনি উঠেছিলেন। তখন কলকাতার কোনও সাংবাদিকই তঁার কাছে যেত না। কেদারনাথ সাহনি পাঞ্জাব দেশের মানুষের, কাশ্মীরের ভারপ্রাপ্ত। সেদিন তিনি ৩৭০ ধারা কেন বাতিল করা প্রয়োজন বুঝিয়েছিলেন, কেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদান কী এসবও বোঝান। কলকাতার এক পুরনো বাড়ির দোতলায় মেঝেতে পাতা সাদা ফরাসের উপর তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে তিনি উপবিষ্ট। আমি জুতো-মোজা খুলে প্রাচীন গবাক্ষে বসা পায়রার বকম্-বকম্ শুনতে শুনতে সাক্ষাৎকার নিলাম।
এত বছর পর মোদির বিজেপি ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছে। অযোধ্যায় বালক রামচন্দ্রের প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। তিন তালাক রদ করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে এগচ্ছে বিজেপি। নাগরিকত্ব আইন জারি করেও বিজেপি তার ‘কোর ইসু্য’ বাস্তবায়নের ইতিহাস রচনা করছে। সব-ই বিজেপির প্রাচীন দলীয় মতাদর্শ। বাজপেয়ী-আদবানি এনডিএ জোট-ধর্ম পালন করতে গিয়ে যা পারেননি, মোদি তা পেরেছেন। কিন্তু এত কাণ্ডের পরেও বাংলায় বিজেপিকে লম্বা রাস্তা পার করতে হবে। মুরলীধর সেন লেনের বিজেপি অফিসে আমি যাচ্ছি– যখন দলের জেলা সভাপতি ছিলেন সুকুমার বন্দে্যাপাধ্যায়। হাওড়ার কর্মী মানুষ, রোজ গঙ্গা পেরিয়ে আসতেন তিনি। সেই গঙ্গায় কত স্রোত বয়ে গেল! কিন্তু বিজেপি কি বাঙালির হতে পারল?
উল্টে বাঙালি নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে খুশি করার জন্য হিন্দি বলয়ের নেতাদের মতো বেশভূষা, আচরণ, সংস্কৃতি অনুকরণ করতে শুরু করছেন। বাঙালিকে অযোধ্যায় পাঠিয়ে রামলালা দর্শনের দলীয় কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দক্ষিণেশ্বর-কালীঘাট শীর্ষনেতারা গেলেও এখনও তা ‘সিম্বলিক’। চিত্রনাটে্যর তাগিদে তৈরি ‘সিন’। এখন হঠাৎ করে দলিতদের বাড়িতে খেতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী দলীয় তকমা ঘোচাতে হচ্ছে, কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কবে রসিক মেথরের বাড়িতে গিয়ে মাথার চুল দিয়ে আবর্জনা সাফ করেন। বাঙালির রক্তে সেই মানসিকতা আছেই। তা কোনও তৈরি করা আলেখ্য নয়।
[আরও পড়ুন: ‘না পোষালে পাকিস্তান চলে যান’, সংরক্ষণ ইস্যুতে লালুকে নিদান হিমন্তের]
বাঙালির অনেক অধঃপতন হয়েছে স্বীকার করছি। রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেই আর বেলুড়ে জোড়াসঁাকোয়
ভিড় বাড়ালেই বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ প্রমাণ হয় না, ঠিক। কিন্তু অমিত শাহ-র মুখে সত্যজিৎ রায়ের
হীরক রাজার দেশের কথা বেমানান। মনে হয় সাজানো চিত্রনাট্য। বাঙালির সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার ডিএনএ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত।
কলকাতার কোনও অবাঙালি ব্যবসায়ী দেখলে, তা তিনি মাড়োয়ারি-গুজরাতি-বিহারি যাই হন, প্রথমেই ভাবি হয়তো মানসিকভাবে ইনি কি মোদি-শাহর ভক্ত? ‘জয় শ্রীরাম’ বলে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন? আবার এ-ও ঠিক, কোনও বাঙালি অধ্যাপক হয়তো নানা কারণে রাজ্যের শাসক দলের প্রতি ক্ষুণ্ণ। সন্দেশখালি-শাহজাহান নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু তা-ও তিনি মানসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিজেপিকে গ্রহণ করতে অপারগ। বিজেপি-তৃণমূল রাজনৈতিক বিবাদে এই বাঙালি-অবাঙালি মেরুকরণও কিন্তু কাম্য নয়।
নবরাত্রির সময় মাছ খাওয়ার জন্য বিহারে তেজস্বী যাদবকে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কাঠগড়ায় তুললেন। এতে বিহারে বিজেপির রাজনৈতিক লাভ কী হবে জানি না, কিন্তু বঙ্গদেশে আমরা তো মাছে-ভাতে বাঙালি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃণমূলের তাৎক্ষণিক জনপ্রিয় প্রচার– মাছ-ভাত খাও, বিজেপি হঠাও।
এরকম পরিস্থিতি কি কাম্য ছিল? বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই বহুত্ববাদী, বহুমাত্রিক। ছোটবেলা থেকে থেকেছি সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া মাড়োয়ারি যুবক বাঙালিদের সঙ্গে একযোগে ‘নিজাম’-এ সস্তায় বিফ রোল খাচ্ছে, আবার হিন্দু বাঙালির প্রিয় খাদ্য বিরিয়ানি। বাঙালি কখনও গজলে আর ভজনে ভেদ-ভাব করেনি। রসের প্রতিটি জিনিসকে সম্মান করেছে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ধন্যবাদ ‘আনন্দমঠ’) ও স্বামী বিবেকানন্দকে বিজেপি ‘হিন্দু পুরুষ’ বলে যতটা তুলে ধরতে উৎসাহী, ততটা কি ভারতের প্রথম ‘আধুনিক’ মানুষ ‘রাজা’ রামমোহন রায়কে নিয়ে? বিদ্যাসাগর মশাইয়ের চিন্তাদর্শন বা রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিজেপি কতটা প্রচার করে? বিজেপি দীনদয়াল উপাধ্যায়কে তঁার সুসংহত মানবতাবাদের জন্য যতটা গুরুত্ব দেয়, ততটা কি জনসংঘর প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দিয়েছে? ২০১৯ সালে দক্ষিণ কলকাতায় ‘স্যর’ আশুতোষ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাসভবন ঘুরে-ঘুরে দেখেছিলাম। সঙ্গে ক্যামরাপার্সন ছিল।
[আরও পড়ুন: ‘মেরে পাস মোদি হ্যায়’, পাকিস্তানের ‘পরমাণু বোমা’কে কাঁচকলা দেখিয়ে বার্তা শাহের]
বাড়ির ভিতরে শ্যামাপ্রসাদের জন্মস্থান অঁাতুরঘর থেকে বৈঠকখানা। তঁার ব্যবহৃত কালো প্রাচীন টেলিফোন, শয়নকক্ষ, খাট, পড়ার টেবিল– সব দেখলাম। ক্যামেরায় ছবি উঠল। দেখলাম বড় অবহেলা সর্বত্র। অথচ এ তো সাংঘাতিক একটা মিউজিয়াম হতে পারত! শুনলাম এটি এখনও পারিবারিক সম্পত্তি। চলছে শরিকি বিবাদ। পরিবারের বর্তমান সদস্যদের মধে্য কলহ-মামলা-মোকদ্দমা জারি।
ট্রাস্ট একটা আছে। সরকার নাকি অসহায়! মনে হল, মোদি সরকার যদি মামলার জট ছাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ-বলে অযোধ্যায় রামমন্দির করে ফেলতে পারে, তাহলে দলের এই বাঙালি প্রতিষ্ঠাতার বাসভবনটি সব পক্ষকে ডেকে অধিগ্রহণ করতে পারে না?
সেবার হিন্দি চ্যানেলের জন্য যখন ফুটেজ-সমেত এই খবর পরিবেশন করতে চাই, তখন তা দেখানো হল না। বলা হল, হিন্দি চ্যানেলে, হিন্দি বলয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অত খায় না। হিন্দি বলয়ে এই বাঙালিকে কে ক’জন জানে?
এরপরও বলব– বাঙালিকে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব জানে, বোঝে, মানে?