আশিস গুপ্ত: ২৩ ফেব্রুয়ারি,২০২৩-এ, কর্ণাটকের (Karnataka) বেল্লারিতে ‘বিজয় সংকল্প যাত্রা’য় ভাষণ দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদিকে একবার বিশ্বাস করুন এবং ইয়েদিউরপ্পাকে একবার বিশ্বাস করুন। আমরা এমন একটি সরকার গঠন করব যা কর্ণাটককে দুর্নীতিমুক্ত এবং দক্ষিণ ভারতের এক নম্বর রাজ্যে পরিণত করবে।”
অমিত শাহর এই আকুতি ছিল রাজ্যে তার দলের চার বছরের শাসনকালের অন্তিম লগ্নে। শাহ কর্ণাটকের ভোটারদের এমন একজনের উপর বিশ্বাস করতে বলছেন, যার উপর দল বিশ্বাস হারিয়ে দু’বছর আগেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। নির্বাচনের দোরগোড়ায় কেন বিশ্বাস অর্জনের এই আকুতি? একজন ঠিকাদারের মৃত্যু, বিভিন্ন সংস্থা দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি এবং লোকপালের তৎপরতায় একজন বিধায়কের গ্রেফতার- কর্ণাটকের বিজেপি সরকারকে গত চার বছরে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে, একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপে, কর্ণাটক রাজ্য ঠিকাদার সমিতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে (PM Modi) একটি চিঠি পাঠিয়েছিল।
[আরও পড়ুন: জমি ইস্যুতে ‘প্রতীচী’র সামনে প্রতিবাদ বিশিষ্টদের, রবীন্দ্রগানের একক অনুষ্ঠানে কবীর সুমন]
বিজেপি সরকারের সমস্ত স্তরে দুর্নীতিতে ক্লান্ত হয়ে, অ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছিল এবং প্রতিটি সরকারি চুক্তির জন্য যাতে তাদের ৩০-৪০ শতাংশ ঘুষ দিতে না হয় তা নিশ্চিত করতে বলেছিল। দুর্নীতি নতুন নয় এবং এর জন্য আগের সব সরকারই অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে দূরে থাকা ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিজেপি সরকারের উপর আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছে, তখন তাদের উত্তর ছিল- কংগ্রেস এবং জেডি(এস) শাসনামলে দুর্নীতি ছিল, তবে এতটা ব্যাপক ও ভয়ংকর ছিল না। অ্যাসোসিয়েশন বিএস ইয়েদিউরাপ্পা যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন রাজ্যপাল এবং পরবর্তীতে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইকে চিঠি লিখেছিলেন। তাদের কারও কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ প্রধানমন্ত্রীর বহু চর্চিত মন্তব্য ‘না খাউঙ্গা-না খানে দুঙ্গা’-তে ভরসা ছিল তাদের।
ঠিকাদাররা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র কারণ ঘুষ ছিল না। একজন দুর্দশাগ্রস্ত ঠিকাদার, যিনি বিজেপি সদস্যও ছিলেন, তার আত্মহত্যা একটি সংকেত ছিল যে, পরিস্থিতি খারাপ থেকে চূড়ান্ত খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ ২০২১ সালের মার্চ মাসে, বেলগাভি জেলার সন্তোষ কে পাটিল নামে একজন ঠিকাদার অভিযোগ করেন যে ,কর্নাটকের গ্রাম উন্নয়ন ও পঞ্চায়েতরাজ মন্ত্রী কে এস ঈশ্বরাপ্পা নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁর বিল পরিশোধ করা হয়নি, কারণ পাটিল মন্ত্রীকে তঁার ঘুষের অংশ দেননি। সন্তোষের মতে, তাঁকে ৪ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ১০৮টি রাস্তা নির্মাণের জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, এবং কাজটি শেষ করা সত্ত্বেও তিনি টাকা পাননি, ফলে তাকে ঋণের দুষ্ট চক্রের মধ্যে ডুবে যেতে হয়েছিল।
সন্তোষের অভিযোগ এবং অ্যাসোসিয়েশনের চিঠি কয়েকদিন ধরে শিরোনাম হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: চকোলেটের লোভ দেখিয়ে শিশুকে যৌন হেনস্তা, কুকীর্তি ঢাকতে ‘নিশি ভূতের’ গল্প ফাঁদল অভিযুক্ত!]
বিজেপি সরকার বলেছিল যে, অভিযোগগুলি অসত্য এবং তদন্তে তা প্রমাণিত হবে। কে এস ঈশ্বরাপ্পাকে বিজেপি এবার প্রার্থী করেনি, যদিও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে টেলিফোন করে সান্ত্বনা দিয়েছেন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে হিজাব বিতর্ক কর্নাটকের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ দখল করে নেয়, দুর্নীতি সম্পর্কে সংলাপ প্রায় ম্লান হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। ১২ এপ্রিল, ২০২২-এ সন্তোষ পাটিলকে উদুপির একটি লজে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার একদিন আগে, তিনি একজন বন্ধুকে মেসেজ করেছিলেন যে, ঈশ্বরাপ্পা ‘সরাসরি তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমাকে অন্ধকার কোণে ঠেলে দিয়েছে।’
ঈশ্বরাপ্পা ১৫ এপ্রিল মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের সময়ও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন নির্লজ্জভাবে এবং কয়েক মাস পর, পুলিশ তাকে ক্লিনচিট দেয়। যদিও সন্তোষের পরিবার আদালতে পুলিশের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করেছে, অভিযোগ করেছে যে, পুলিশ আদালতে মূল প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। এই ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় ওঠে। ২০২২ সালের আগস্টে নিবন্ধিত আনএডেড প্রাইভেট স্কুল ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আরইউপিএসএ) কর্নাটক ইউনিট শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেয়। প্রমাণের অভাবে কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশনকে কীভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরে, আরইউপিএসএ প্রমাণস্বরূপ কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার ফোন কল সংগ্রহ করে রেখেছিল।
তারা অভিযোগ করেছে যে, প্রাথমিকভাবে দু’টি অজুহাতে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে– শিক্ষার অধিকার খাতে বরাদ্দ সরকারি অনুদান অনুমোদন ও রিলিজ করা এবং স্কুলের স্বীকৃতি পুনর্নবীকরণের জন্য। রাজনৈতিক সুযোগ বুঝে কংগ্রেস পেটিএম-এর আদলে ‘পেসিএম’ প্রচার শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী বোম্মাইয়ের পোস্টারে উপহাসস্বরূপ কিউআর কোড-সহ রাজ্যজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং লোকেদের মুখ্যমন্ত্রীকে ৪০ শতাংশ দিতে বলা হয়েছিল। কংগ্রেস একটি স্লোগানও চালু করেছিল– “৪০ শতাংশ সরকার, বিজেপি মানে ভ্রষ্টাচার।”
গত দুই বছরে বিজেপি আরও অনেক দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়েছে। ৫৪৫ টি পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পদ পূরণের জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত কর্নাটক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর (পিএসআই) পরীক্ষায় বড় কেলেঙ্কারি ছিল। কালাবুরাগীর স্থানীয় বিজেপি নেতা দিব্যা হাগারাগি, যিনি একটি কোচিং প্রতিষ্ঠান চালাতেন, এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে ছিলেন, পুলিশ অফিসার-সহ আরও অনেকে এতে জড়িত ছিলেন।
২০২৩ সালে বিজেপির জন্য দুর্নীতি সংক্রান্ত সমস্যা অব্যাহত ছিল এবং দলের জন্য একটি বড় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি, বেল্লারিতে ‘বিজয় সংকল্প যাত্রায়’ ভাষণ দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কর্ণাটককে দুর্নীতিমুক্ত এবং দক্ষিণ ভারতের এক নম্বর রাজ্যে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ১০ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে কর্ণাটক লোকায়ুক্ত, ভি প্রশান্ত মাদলকে গ্রেপ্তার করে, যিনি চান্নাগিরির বিজেপি বিধায়ক মাদল বিরূপাক্ষপ্পার ছেলে। প্রশান্ত বেঙ্গালুরুর জল সরবরাহ এবং নিকাশি বোর্ডের প্রধান হিসাবরক্ষক হিসাবে কাজ করেন। প্রশান্ত তার বাবার অফিসে ৪০ লক্ষ টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। পিতা-পুত্র জুটির মালিকানাধীন বিভিন্ন সম্পত্তিতে অভিযান চালানোর পরে, লোকায়ুক্ত প্রায় ৭ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে।
বিরূপাক্ষপ্পাও তার উত্তর প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, তার এলাকার সুতোচাষিদের জন্য তাঁদের বাড়িতে নগদ ৪-৫ কোটি টাকা রাখা স্বাভাবিক। যে বিধায়ক তাঁর ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তার আয় হিসাবে ৫.৪ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিলেন, কোটি টাকা নগদ রাখা ঠিক ছিল বলে দাবি করায় কোনও দ্বিধা নেই তাঁর।
গত চার বছরে যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে, তার অনেক মন্ত্রী এবং বিধায়ক আদালতে গিয়ে মিডিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করার (গ্যাগ অর্ডার) আদেশ পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাসাভানাগুড়ির বিধায়ক রবি সুব্রহ্মণ্যম, রাজরাজেশ্বরী নগরের বিধায়ক মুনিরত্ন, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বত্থ নারায়ণ এবং গ্রাম উন্নয়ন ও পঞ্চায়েত রাজ মন্ত্রী ঈশ্বরাপ্পা।