shono
Advertisement

জোটের সুফল

রণকৌশলে কী বদল আনতে হবে বিজেপিকে?
Posted: 01:44 PM Sep 12, 2023Updated: 01:47 PM Sep 12, 2023

এবারের উপনির্বাচনের ফল স্পষ্ট করল যে, বিজেপিকে যদি লোকসভা ভোটে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তাহলে অপটিক্সের রাজনীতির উপর নির্ভরতা ছেড়ে সামাজিক সুরক্ষার দিকেই ঝুঁকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ধূপগুড়ি ও উত্তরপ্রদেশের ঘোসি কেন্দ্রে বিজেপির পরাজয় একরকম অপ্রত‌্যাশিত। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

ওয়ার্ম-আপেই এগিয়ে গেল ‘ইন্ডিয়া’ জোট। ত্রিপুরা ও উত্তরাখণ্ডে বিজেপির (BJP) কিছুটা মুখরক্ষা করলেও বড় ধাক্কা দিল পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গর ধূপগুড়ি ও উত্তরপ্রদেশের ঘোসি কেন্দ্রে বিজেপির পরাজয় একরকম অপ্রত‌্যাশিত। বিজেপির নেতৃত্ব এই দুই কেন্দ্রে হার মেনে নিতে পারছে না। লোকসভা ভোটের আগে কার্যত নিজেদের গড়ে এই হার বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। জি-২০-র (G20 summit) উৎসবের মধ্যে উপনির্বাচনের এই হার নিয়ে পর্যালোচনায় বসতে বাধ‌্য হয়েছেন বিজেপির নেতারা।

শুধুমাত্র অপটিক্সের রাজনীতি করে যে আর জয়লাভ সম্ভব হচ্ছে না, তা এই উপনির্বাচনের ফলের পর আরও একবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গেরুয়া শিবির। ছ’টি রাজ্যের মাত্র সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে এই উপনির্বাচন ছিল। ইন্ডিয়া জোট গঠিত হওয়ার পর এটিই ছিল প্রথম ভোট, যেখানে মুখোমুখি যুযুধান দুই শিবির। লোকসভা ভোটের আগে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট হবে। সেটিকে সেমিফাইনাল বলা যেতে পারে। সেদিক থেকে এই উপনির্বাচন ওয়ার্ম আপ ছাড়া কিছু নয়। খেলোয়াড়রা যেমন কোনও ম‌্যাচ খেলতে নামার আগে ওয়ার্ম আপ করেন, এই উপনির্বাচন সেরকমটাই ছিল। যেহেতু দুই জোট ওয়ার্ম আপেই প্রথম মুখোমুখি আসার সুযোগ পেল, তাই এই ভোট রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে। ওয়ার্ম-আপের খেলা জিততে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। দিনের শেষে যে ফল তাদের দিকে যায়নি, তা বলাই বাহুল‌্য।

[আরও পড়ুন: রামমন্দিরের উদ্বোধনে গোধরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, আশঙ্কা উদ্ধব ঠাকরের]

৪-৩ ফলাফলে বিজেপির আসন তিনটি এসেছে ত্রিপুরা ও উত্তরাখণ্ড থেকে। এই দু’টিই ছোট পাহাড়ি রাজ‌্য। তিনটি আসনের ভোটার সংখ‌্যাও কম। এই তিনটি কেন্দ্রকে দেশের মূল ধারার কেন্দ্রও বলা চলে না। এই তিন কেন্দ্রের ভোটারদের বিন‌্যাসে সর্বভারতীয় ছাপ কম। সে-কারণে রাজনৈতিক মহলে এই তিন কেন্দ্রের গুরুত্ব স্বল্প। উপরন্তু ত্রিপুরায় বিজেপির বিরুদ্ধে ব‌্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ তুলেছে মূল প্রতিপক্ষ বাম শিবির। এর মধে‌্য বক্সানগরে সিপিএম নামেই ভোটে দঁাড়িয়েছিল। সংখ‌্যালঘু অধু‌্যষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখানে গেরুয়া বাহিনীর ভয়ে কমরেডরা অাগেই এলাকা ছেড়েছিলেন। বিজেপি প্রার্থী ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বিধানসভা অাসনের ভোটে এটা রেকর্ডও হতে পারে। উত্তরাখণ্ডে রিগিংয়ের অভিযোগ না উঠলেও এই কেন্দ্রে বিজেপির জয়ের ব‌্যবধান সাংঘাতিকভাবে কমে গিয়েছে। কিছুদিন আগে বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী ১২ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। জয়ী প্রার্থীর প্রয়াণে এখানে উপনির্বাচন হয়েছে। উপনির্বাচনে ওই প্রয়াত প্রার্থীর পরিবারের সদস‌্যই বিজেপির হয়ে দঁাড়িয়েছিলেন। সহানুভূতির হাওয়াকে সম্বল করেও উপনির্বাচনে তঁার জয়ের ব‌্যবধান মাত্র দু’-হাজার।

যে চারটি কেন্দ্রে বিজেপির পরাজয় হয়েছে, তার মধে‌্য ধূপগুড়ি বিজেপির আসন ছিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটেও এই ধূপগুড়ি কেন্দ্রে বিরাট ব‌্যবধানে এগিয়ে ছিলেন বিজেপির প্রার্থী। রাজনৈতিকভাবেও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায় প্রধান এই অঞ্চল বিজেপির শক্ত ঘঁাটি হিসাবে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে পঁাচবছর অাগে বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে রাজবংশীদের সমর্থন এবং চা-বলয়ের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ধূপগুড়ি কেন্দ্রে রাজবংশীদের সঙ্গে সঙ্গে চা-বলয়ের ভোটও রয়েছে। উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয় কোনওরকম হিসাবের মধে‌্যই ছিল না রাজনৈতিক মহলের। এই কেন্দ্রে তৃণমূলপ্রার্থীর জয় এবং ৪৬ শতাংশের উপর ভোটপ্রাপ্তি সবাইকে চমকে দিয়েছে। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায়ও বলেছেন এটি তঁাদের বড় জয়। উত্তরপ্রদেশের ঘোসিতেও অনেকটা একই ছবি। এখানে উপনির্বাচনে পরাজিত বিজেপি প্রার্থী দারা সিং চৌহান পঁাচবারের বিধায়ক ছিলেন। তিনি এই এলাকা থেকে সাংসদও হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের শেষ বিধানসভা নির্বাচনে দারা সমাজবাদী পার্টির টিকিটে জয় পেয়েছিলেন। দলবদলের পর পদত‌্যাগ করে তিনি উপনির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন। নিজের দুর্গে দারা ৪০ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন। ঘোসি কেন্দ্রে উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বড় জয়।

[আরও পডৃ়ুন: নজরে অস্ত্র চুক্তি? পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে সশস্ত্র ট্রেনে রাশিয়া পৌঁছলেন কিম]

ঘোসিতে প্রথম ‘ইন্ডিয়া’ জোটের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে না থেকেও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি ঘোসিতে প্রার্থী দেয়নি। মায়াবতী তঁার দলিত ভোটব‌্যাঙ্ককে ‘নোটা’য় ভোট দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভোটের অঙ্ক বলছে, মায়াবতীর দলিত ভোট জয়ী সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীর দিকে গিয়েছে। ঘোসিতে বোঝা গিয়েছে, বিজেপির বিরুদ্ধে সবাই একজোট হলে গেরুয়া প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত। কেরলের পুথুপপল্লি কেন্দ্রে কংগ্রেস তাদের জয় ধরে রেখেছে। ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এনডিএ-র শরিক ‘আজসু’ প্রার্থীকে পরাজিত করেছে।

উপনির্বাচনের ফল এটা স্পষ্ট করল যে, বিজেপিকে যদি লোকসভা ভোটে ঘুরে দঁাড়াতে হয়, তাহলে অপটিক্সের রাজনীতির উপর নির্ভরতা ছেড়ে সামাজিক সুরক্ষার দিকেই ঝুঁকতে হবে। বিজেপি ব‌্যবসায়ীদের দল হিসাবে পরিচিত। সাধারণ মানুষের সমস‌্যা, মূল‌্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত‌্যাদি ইসু‌্য কখনওই বিজেপির রাজনীতিতে গুরুত্ব পায় না। বিজেপি নেতারা সাধারণভাবে মনেই করেন না যে, গ‌্যাসের দাম বৃদ্ধি বা পেট্রলের দাম বৃদ্ধির মতো বিষয় ভোটে জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক হতে পারে। ধর্ম, জাতপাত, জাতীয়তাবাদ ইত‌্যাদি আবেগই সাধারণ মানুষের ভোট টানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে তাদের অভিমত। যে-দলের উত্থান রামমন্দিরের আবেগকে ঘিরে তারা যে এমন ভাববে, অবাক হওয়ার কী আছে? এটাকেই বিজেপি নেতারা বলে থাকেন অপটিক্সের রাজনীতি। বিজেপি মনমোহন সিংয়ের অার্থিক সংস্কার কর্মসূচির সমর্থক। বাজার অর্থনীতির পক্ষে সংস্কার কর্মসূচিকে তারা অারও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা ভোটারদের ভাবাবেগের উপর অাস্থাশীল।

পরপর ভোটে ধাক্কা মনে হয় এখন মোদি-শাহদের অন‌্যভাবে ভাবাচ্ছে। শুধুমাত্র অপটিক্স নির্ভরতা ছেড়ে তঁারা এবার সামাজিক সুরক্ষার দিকেও মন দিচ্ছেন। গ‌্যাসের দাম ২০০ টাকা কমিয়ে দেওয়াই তার প্রথম নিদর্শন। কর্নাটক ও হিমাচল, দুই রাজে‌্য বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের জয়ের ক্ষেত্রে মুখ‌্য ভূমিকা নানাবিধ সামাজিক সুরক্ষার অাশ্বাস। গত লোকসভা ভোটের অাগেই কংগ্রেস দেশের সব নাগরিকের জন‌্য নূ‌্যনতম অায়ের প্রকল্পটির কথা প্রচারে ভাসিয়েছিল। বিশ্বজুড়ে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা প্রচার করছেন, বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে সর্বত্র শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। যেখানে উৎপাদনের খরচ কম, দক্ষ শ্রমিকের জোগান, সেখানে কলকারখানার কেন্দ্র হবে। বাকি অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন‌্য সরকারকেই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প করতে হবে। মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ একটি দৃষ্টান্তমূলক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। এই প্রকল্প গ্রামগঞ্জের সাধারণ পরিবারগুলির মাথার উপর এক অনন‌্য সামাজিক সুরক্ষা ও নিশ্চয়তার চঁাদোয়া বিছিয়ে দিয়েছে।

ওয়াকিবহাল মহলের মতে বাংলায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বিরোধীদের ধুন্ধুমার প্রচার যে কোনও ছাপ ফেলতে পারছে না, তার পিছনে কিন্তু মূল কারণ ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-সহ মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায়ের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি। পঞ্চায়েত ভোট-ই হোক বা ধূপগুড়ির উপনির্বাচন, সর্বত্রই তৃণমূলের জয়ের এটাকেই চাবিকাঠি ধরা হচ্ছ। ধূপগুড়িতে পোস্টাল ব‌্যালটেও তৃণমূল জয় পেয়েছে। পোস্টাল ব‌্যালটে ভোট দেন সরকারি কর্মীরা। সোশ‌্যাল মিডিয়ায় লেখালিখি হচ্ছে, পোস্টাল ব‌্যালটের ফল থেকে বোঝা যায় যে, ডিএ-এর দাবিতে অান্দোলন সরকারি কর্মীদের ভোটে কোনও প্রভাব ফেলতে পারছে না।

লোকসভা ভোটের ওয়ার্ম-অাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে মোদি-শাহরাও সমাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের দিকে ভিড়ছেন বলে রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা। ‘ইন্ডিয়া’-‘ভারত’ নিয়ে যে বিশেষ দৌড়-ঝঁাপ হচ্ছে না, তা বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকর স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অাপাতত দুটোই ব‌্যবহারে থাকবে। সংবিধান সংশোধন করে ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই। ‘এক দেশ এক ভোট’ বিশ বঁাও জলে। সবে কমিটি গঠিত হয়েছে। অাইন হওয়া বহু দূরের ব‌্যাপার। লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে সংসদের বিশেষ অধিবেশনেও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের কিছু ধামাকার জন‌্যই নাকি এখন অপেক্ষা রাজনৈতিক মহলের।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement