বৈচিত্রের বাংলায় উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল দু’টি অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। শাল, কেন্দুপাতায় মোড়া জঙ্গল, পোড়ামাটি, ছৌ নাচ ছাড়া যেমন বাংলা হয় না; তেমনই তিস্তা-তোর্সার কূলে চা-বাগানের দুনিয়া, কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহিত শোভা থেকে গৌড়ের হারিয়ে যাওয়া বাঙালির ইতিহাসকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গ হয় না। যাঁরা এদের বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছেন, হয় তাঁরা ইতিহাস জানেন না, নতুবা ভূগোলেও পিছিয়ে। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
তাহলে বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে জন বার্লা অথবা সৌমিত্র খাঁ-র ফারাক কোথায়? গুরুং দার্জিলিংকে ছিন্ন করে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য চেয়েছিলেন। সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া রাজ্য ভাগের আন্দোলন আরও হিংসাত্মক করে তুলেছিলেন গুরুং। বার্লা অথবা সৌমিত্রও কার্যত একই সুরে বাংলা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবি তুলেছেন। একজন উত্তরবঙ্গকে (North Bengal) আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত করতে চান, অন্যজন চান জঙ্গলমহল রাজ্য।
[আরও পড়ুন: ফসলে সফল বাংলা, কৃষকভাতার টাকায় লাঘব হবে চাষিদের ঋণের বোঝা]
সোজা কথায় দার্জিলিংয়ের পর তরাই-ডুয়ার্স তথা উত্তরবঙ্গ, এদিকে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়াকে নিয়ে রাঢ়বঙ্গ, আলাদা আলাদা রাজ্যের দাবি করছেন বিজেপির দুই সাংসদ। তাঁদের এই অদ্ভুত দাবিতে জনমনে হইচই পড়েনি। উত্তরবঙ্গ অথবা জঙ্গলমহলের মানুষের এই নিয়ে কোনও আগ্রহ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। আদৌ এসব সম্ভব নয় বলেই কি
মানুষ নিরুৎসাহী? হতেই পারে। যদিও রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া। টাটকা ইস্যু পেয়েছেন বিজেপি (BJP) বিরোধীরা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ বলেছেন, কিছুতেই বঙ্গভঙ্গ করতে দেবেন না। তাঁর অভিযোগ, এটা আসলে বিজেপিরই লাইন। হার মেনে নিতে পারছে না বলে বিজেপি বাংলাকে ভাগ করতে চাইছে।
দুই সাংসদের দাবি ভৌগোলিক দিক থেকে বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। তাঁরা কেউ সুন্দরবন, বীরভূম, বধর্মান অথবা কলকাতার জন্য আলাদা আলাদা রাজ্য দাবি করেননি। এমন দু’টি অংশ বাংলা থেকে কেটে বাদ দেওয়ার কথা বলেছেন, যেখানে বিধানসভা ভোটে বিজেপির ফল ভাল হয়েছে। ৭৭ বিধায়কের মধ্যে ৪৫-এর বেশি আসন এসেছে এই দুই এলাকা থেকে।
স্বভাবতই হঠাৎ করে বার্লা অথবা সৌমিত্রদের ‘বিমল গুরুং’ হয়ে ওঠা কৌতূহল জাগিয়েছে। অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারও অভিমত, সুকৌশলী চাল। ভোটে হেরে রাজ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। কারও ব্যাখ্যা, বাংলার গেরুয়া আগ্রাসন ঠেকানোর পর সর্বভারতীয় স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তাঁকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে একত্রিত হচ্ছে। এইসময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যাতে দিল্লির দিকে ‘স্টেপ আউট’ করতে না পারেন, সেজন্য তাঁকে নানাভাবে বিব্রত রাখতে চাইছে কেন্দ্রের শাসক দল। রাজ্যপালকে লেলিয়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে ৩৫৬-র জুজু দেখানো, অন্যদিকে রাজ্যভাগের দাবি তুলে স্থানীয় স্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি। লক্ষ্য: মমতা যেন বাংলা থেকে বেরতে না পারেন।
বিজেপি আদৌ কী কৌশল নিয়েছে সেটা তারাই বলতে পারবে। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh) অবশ্য বার্লা অথবা সৌমিত্রর দাবি ব্যক্তিগত মত বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। বিজেপি বাংলা ভাগ চায় না, সবাইকে পার্টি লাইন মানতে হবে বললেও তাঁর যুক্তি, ওই দুই এলাকা স্বাধীনতার পর থেকে বঞ্চিত। মানুষের ক্ষোভ আছে। তৃণমূল নেতা জিতেন্দ্র তিওয়ারির বিজেপিতে যোগদান আটকাতে সরব হয়ে শো-কজ খেয়েছিলেন কয়েকজন রাজ্য নেতা। সেদিন ‘পার্টি লাইন’ ভাঙার জন্য যত দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এবার কী হয়েছে? ফলে বিজেপি সত্যি কী চায়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
জাতীয় স্তরে পুরোদস্তুর কেন্দ্রীকরণ নীতি নিয়ে চলছে বিজেপি। ‘এক দেশ এক রেশন’-এর মতো তাদের নানা পদক্ষেপ বোঝাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নয়, দিল্লির হাতেই থাকবে সব ক্ষমতা। নীতিগতভাবে বিজেপি বহুদিন আগে থেকেই ছোট রাজ্যের পক্ষে। বড় রাজ্যকে ভেঙে দিলে অনেকটা শক্তিক্ষয় হয়। কেন্দ্রীভূত করা যায় ছোট রাজ্যের সাংবিধানিক ক্ষমতা। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাকে ছোট ছোট রাজ্যে ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি বিজেপি ভাবতেই পারে। এই রাজ্যকে নিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি বিব্রত। মমতার শাসনে পদে পদে সংঘাত কেন্দ্রের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। ভোটেও আশাপূরণ হয়নি। সেই প্রেক্ষিতে ৪২টি লোকসভা আসনের বাংলাকে খণ্ডিত করে শক্তি কমিয়ে দেওয়ার কৌশল বিজেপি নিতেই পারে।
বৈচিত্রের বাংলায় উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল দু’টি অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড। শাল, কেন্দুপাতায় মোড়া জঙ্গল, পোড়ামাটি, ছৌ নাচ ছাড়া যেমন বাংলা হয় না; তেমনই তিস্তা-তোর্সার কূলে চা-বাগানের দুনিয়া, কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহিত শোভা থেকে গৌড়ের হারিয়ে যাওয়া বাঙালির ইতিহাসকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গ হয় না। যাঁরা এদের বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছেন, হয় তাঁরা ইতিহাস জানেন না, নতুবা ভূগোলেও পিছিয়ে। বাঙালি মাত্রই নিজের রাজ্য, ভাষা, জাতিসত্তা নিয়ে আবেগপ্রবণ। দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাতেই খুশি বাঙালি- মানুষের এই আবেগ খুব ভাল বোঝেন মমতা। ২০১১ সালে বাংলায় ক্ষমতায় আসার আগে থেকে তাঁর নজরে ছিল জঙ্গলমহল ও উত্তরবঙ্গ। সে সময় জঙ্গলমহলে মাওবাদী হানায় রক্ত ঝরছে। বোমা-গুলির আওয়াজে সামাজিক জীবন ব্যাহত। অন্যদিকে পাহাড় জ্বলছে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে।
ভোটের প্রচারে মমতার ঘোষণা ছিল: বাংলায় সংবেদনশীল দুই অংশে শান্তি ফেরানোই হবে তাঁর প্রধান কাজ। পাহাড় ও জঙ্গলকে তিনি বাংলার ‘দুই বোন’ বলেও তখন উল্লেখ করেন। ক্ষমতায় আসার পর কথা রাখেন। জঙ্গলমহলে যেমন স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসে, তেমনই ‘জিটিএ’ তৈরির মাধ্যমে পাহাড়ের মানুষের হাতে কার্যত স্বায়ত্তশাসন তুলে দেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরবঙ্গের উন্নয়নেও প্রভূত জোর দেন তিনি। সেখানে তৈরি হয় নতুন সেক্রেটারিয়েট। জঙ্গলমহলে আর অশান্তি হয়নি। পাহাড়ে কখনওসখনও বিচ্ছিন্নতাবাদের স্ফুলিঙ্গ দেখা দিলেও সেখানকারা মানুষ বুঝে গিয়েছেন- যতদিন মমতা নবান্নে বসে থাকবেন, ততদিন বাংলা থেকে দার্জিলিংকে বিচ্ছন্ন করা যাবে না। এরপরও উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলকে আলাদা করার দাবির গুরুত্ব কতটা প্রাসঙ্গিক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।
দেশভাগের ক্ষত আজও বাঙালিকে কুরে কুরে খায়। গঙ্গা-পদ্মার আলাদা হয়ে যাওয়া, ফেলে আাসা ভিটের টান বাঙালির জীবনে দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে। তারপরও যাঁরা ভাগাভাগির কথা বলবেন, তাঁদের রাজ্যের মানুষ খুব ভাল চোখে দেখবেন বলে মনে হয় না। তবে জরুরি কথা হল, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ভোটের আগে যেমন বিজেপি নেতাদের তাড়াহুড়ো ছিল, হারের পর বড্ড বেশি দূর পর্যন্ত তাঁরা ভেবে ফেলছেন কেউ কেউ। ভোট তো এই হল। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে রায় দিলেন দু’মাসও কাটেনি। বিজেপিকেও তাঁরা কিছু আসন দিলেন। ৭৭ সংখ্যাটা ভদ্রস্থ। তাহলে তাড়াহুড়ো কীসের? গণতন্ত্রে অপেক্ষা করতে হয়। নিজের ভুল কোথায় তা নিয়ে যখন অনুসন্ধান করা উচিত, তখন বিজেপির কিছু কিছু নেতা এমন হাঁকপাঁক করছেন যেন কালই বুঝি আবার বিধানসভা ভোট হবে রাজ্যে! ক’দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর ফুসফুসটা সতেজ করে নামলে ভাল হত না কি? তাতে অক্সিজেন লেভেলও যথাযথ থাকত।
বিজেপি এত জাঁকজমক করে নামলেও ভোটে হারল কেন? একটা বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে সে-ও বলে দেবে, ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’র মন বুঝতে না পারা। দেখা যাচ্ছে, এখনও তারা সেই সংক্রমণে আচ্ছন্ন। সবুজ ধানের স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলেছেন। বাঙালি কী চায়, তা হয় বুঝতেই পারছেন না, নতুবা বুঝতে চাইছেন না। বুঝতে পারছেন না বিমল গুরুং কেন চক্ষুশূল। যে-বাঙালি লড়াই করে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ রুখে দিয়েছিল, ’৭১-এর যুদ্ধে ‘ভাই’ বলে ওপারের বাঙালিকে আশ্রয় দিয়েছিল, হাজার ষড়যন্ত্রে যে-বাঙালি দার্জিলিংকে বুকে আঁকড়ে রাখতে চায়, তারা পাহাড়, ডুয়ার্স, মল্লরাজাদের ভূম আলাদা করতে দেবে?
এতই ছেলেখেলার বিষয় নাকি বঙ্গভঙ্গ? ১৯০৫ সালে হাতে রাখি পরে রবীন্দ্রগীত গেয়ে বাঙালি বলেছিল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। গণ আন্দোলনের পর ১৯১১ সালে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলেন লর্ড কার্জন।সেই ঐতিহ্য, পরম্পরা ছিল, আছে, থাকবে। যখনই ভঙ্গের কথা আসবে, আবার বাঙালি রাখি পরবে। তাই দিলীপবাবুর উচিত সত্যিই যদি রাজ্যভাগ দলের লাইন না হয়ে থাকে, তাহলে সাংসদদের বিরত করা। সংবেদনশীল ইস্যুতে ‘ব্যক্তিগত মত’ বলা বন্ধ রাখা।‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ আবেগটাও মাথায় রেখে চলা উচিত। ওটাই মাথাব্যথা হয়ে উঠছে।