সেমিজ বা ব্লাউজ সেলাই করা বস্ত্র, তা আদতে এঁটো এবং অশাস্ত্রীয়, কাজেই শুভ অনুষ্ঠানে কোনওমতেই তা পরা যাবে না– সামাজিক বিধান ছিল এমনই। নিজের কন্যার বিবাহে সেই নিগড় প্রথম ভেঙেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। লিখলেন সিদ্ধার্থ সিংহ
দীর্ঘকাল পর্যন্ত, এমনকী, বিগত শতাব্দীতেও হিন্দু মেয়েরা ব্লাউজ পরে বিয়ে করতে পারতেন না। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো প্রভাবশালী মানুষও তঁার মেয়ে সুনন্দিনীর বিয়ের সময়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও তৎকালীন সমাজপতিদের কাছ থেকে মেয়েকে ব্লাউজ পরানোর অনুমতি পাননি।
আসলে সে-সময় বিয়ে বা শ্রাদ্ধের মতো অনুষ্ঠানে সেলাই করা কাপড় পরা হিন্দু শাস্ত্রে ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। কারণ, ব্লাউজ মানেই সেলাই করা। আর সেলাই করার জন্য সুচে সুতো পরাতেই হবে। আর সেটা করতে গেলেই সুচের ছিদ্রে সুতো পরানোর জন্য তো সুতোর মাথা উঁচু করতেই হবে। সেজন্য সুতোর মাথা জিভের ডগায় নিয়ে লালা দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিতে হয়। অর্থাৎ, সুতোটা এঁটো হয়ে যায়। তাই ধর্মীয় উৎসবে বা কোনও শুভ কাজে সুচ-সুতোয় সেলাই করা কোনও কাপড় পরা যেত না। মেয়েরা হয় শাড়ির কিছু অংশ পেঁচিয়ে কিংবা অন্য একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে শরীরের উপরের অংশ ঢাকতেন। এই প্রথা উনিশ শতকের মাঝামাঝি অবধি ভারতে চালু ছিল। ঠাকুরবাড়ি থেকেই প্রথম ভাঙা হল সেই প্রাচীন প্রথা।
[আরও পড়ুন: মেলেনি হুইলচেয়ার, বিমানবন্দরেই লুটিয়ে পড়ে মৃত ৮০ বছরের বৃদ্ধ! কাঠগড়ায় এয়ার ইন্ডিয়া]
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন উনিশ শতকের কলকাতায়, বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জলরঙে ছবি অঁাকা শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে জাপানি চিত্রকলায় প্রভাবিত হন। পশ্চিমি নান্দনিকতাও আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। ছবি অঁাকার পাশাপাশি ভালবাসতেন থিয়েটার করতেও, শিশুসাহিত্যেও রেখেছিলেন সাবলীলতার পরিচয়। একই সঙ্গে সামাজিক নিগড় ভাঙায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন পথপ্রদর্শক।
তঁার বড় মেয়ে সুনন্দিনীর বিয়ের সময় এত দিন ধরে চলে আসা সেলাই করা পোশাক না-পরার প্রথাকে তিনি ভাঙতে চাইলেন। পুরোহিত থেকে শুরু করে বহু শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করেও তঁার মেয়েকে সেলাই করা সেমিজ বা ব্লাউজ পরানোর অনুমতি পেলেন না। পুরোহিতরা বললেন, তঁারাও বিয়ে দেওয়ার সময় ধুতি বা চাদর পরেই কাজটা করেন, কোনও পাঞ্জাবি পরেন না। কারণ শুভ কাজে সেলাই করা জিনিস পরা অশুভ লক্ষণ।
১৯০১ সালে প্রভাতনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তঁার ৯ বছরের মেয়ে সুনন্দিনীকে সম্প্রদান করার জন্য বিয়ের আসরে নিয়ে এলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অপরূপ সেই সাজ। কিন্তু পাত্রীকে দেখেই পাত্রপক্ষ অভিযোগ করল, পাত্রীকে সেলাই করা ব্লাউজ পরানো হয়েছে। বরের জ্যাঠামশাই অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বললেন, সেলাইয়ের কাপড় পরা মেয়েকে সম্প্রদান করা যাবে না। পাত্রের বাবাও সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন। তিনি তঁার ছেলের সঙ্গে সুনন্দিনীর বিয়ে দেবেন না– সাফ জানিয়ে দিলেন। হিন্দু পণ্ডিতরাও ফোড়ন কাটলেন, এই বিবাহ অশাস্ত্রীয়।
[আরও পড়ুন: ‘সব গুণই আছে’, নীতীশ সরতেই প্রধানমন্ত্রী পদে রাহুলকে সমর্থন লালুর]
ছেলে এবং বরযাত্রীদের নিয়ে পাত্রের বাবা যখন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় পা বাড়িয়েছেন, ঠিক তখনই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধীর-স্থির গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ের গায়ে সেলাই করা কোনও কাপড় নেই। উপস্থিত কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন সুনন্দিনীর ব্লাউজ সেলাই করা, তবে আমি তঁাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেব।’
না, ওই এক লক্ষ টাকা আর কারওরই ভাগ্যে জোটেনি। কারণ ছেলের বাড়ির মেয়েরা পরীক্ষা করে দেখলেন যে, কন্যার ব্লাউজ সেলাই করা নয়। শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ নিজেই তঁার মেয়ের জন্য বানিয়েছেন এই অভিনব ব্লাউজ। দামি আঠা দিয়ে কাপড়ের বেশ কয়েকটি টুকরো এমন নিপুণ কৌশলে জোড়া দিয়েছিলেন যে, কে বলবে ওটা সেলাই করা নয়।
বরকর্তার অভিযোগের স্রোত গেল থেমে। খুব আনন্দের সঙ্গে, ধুমধাম করে সুনন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেল। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়ার আগে গগনেন্দ্রনাথ তঁার মেয়ের একটি প্রমাণ সাইজের ছবি অঁাকিয়ে নিলেন একজন শিল্পীকে দিয়ে। সেই ধঁাচে শাড়ি-ব্লাউজ পরা, হাতে কাজললতা। পরে সেই ছবি সুনন্দিনীর ছেলে দ্বারকানাথ চট্টোপাধ্যায়ের হেফাজতে চলে যায়।
প্রথম কোনও বাঙালি মেয়ের ব্লাউজ পরে বিয়েতে বসার ঐতিহাসিক ক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং ওই ‘ব্লাউজ’টিকে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসামান্য একটি শিল্পকীর্তি হিসাবে কলেজ স্ট্রিটের মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। আর গগনেন্দ্রনাথের ওই কীর্তির পরেই বাংলার মেয়েদের সেমিজ বা ব্লাউজ পরে বিয়ে করার প্রচলন ধীরে ধীরে শুরু হয়।